আমাদের দেশে কমিউনিস্ট পার্টি আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ প্রায় একই সঙ্গে পথচলা শুরু করেছিল। কমিউনিস্ট পার্টি কানপুরে ১৯২৫ সালে, সিপিএম-এর হিসেবে তাসখন্দে ১৯২০ সালে। এদিকে আরএসএস ১৯২৫-এ নাগপুরে তাদের যাত্রা শুরু করে। তারা আপাতত ভারতের রাজনীতিতে, সমাজনীতিতে কে কোথায় তা নিয়ে কথা বলার কোনও মানে হয় না, সবাই জানেন। কমিউনিস্ট পার্টি পথচলা শুরু করেছিল সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে, এক সাম্যবাদী সমাজের লক্ষ্য নিয়ে। ওদিকে আরএসএস-এর ঘোষিত লক্ষ্য এক অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্র, অখণ্ড ভারত। কমিউনিস্ট পার্টি তার লক্ষ্য থেকে কীভাবে কবে থেকে সরে এসেছে, কীভাবে তারা বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে, তাদের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত ইত্যাদি নিয়ে আরেকদিন কথা বলা যাবে। আজকের আলোচনা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক নিয়ে। কতটা বিস্তার সেই ১৯২৫ থেকে তার একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। যে পাঁচটা রাজ্যে ভোট হচ্ছে সেই পাঁচটা রাজ্যে ঠিক এই সময়ে ২২ হাজারের বেশি শাখা সক্রিয়। যাঁরা জানেন না আরএসএস-এর শাখার কথা তাঁদের বলি, আরএসএস-এর ছোট ব্রাঞ্চ, প্রতিদিন সকালে বা বিকেলে নিয়ম করে এনারা ড্রিল করেন, ব্যায়াম করেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। বিভিন্ন সামাজিক কাজ ইত্যাদিতে শাখার তরফে যোগ দেওয়া হয়, বিভিন্ন সেবামূলক কাজও করেন এবং তার সঙ্গেই বিজেপির নির্বাচন ইত্যাদির প্রচারেও তাঁরা থাকেন, কেউ প্রকাশ্যে কেউ অপ্রকাশ্যে। তো এই আরএসএস-এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হিন্দুরাষ্ট্রের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা, এমনই ধারণা তাঁদের। এই দোরগোড়াতে এসে তাঁদের পিছিয়ে পড়তে না হয় তার জন্য তাঁরা জি জান লাগিয়ে দিয়েছেন।
সমস্ত অর্থনীতি তাঁদের বিরুদ্ধে, সাড়ে ৯ বছর ধরে মোদিজি এক চূড়ান্ত অপদার্থতার পরিচয় দিয়েছেন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এতটাই টলমল যে পান থেকে চুন খসলে বাজার তাসের ঘরের মতো কাঁপছে। বেকারত্ব এরকম চেহারা আগে কখনও নেয়নি, শিল্পে মন্দা এখনও কাটেনি যা সেই নোটবন্দি থেকে শুরু হয়েছিল। বিদেশি বিনিয়োগ বলে যা দেখানো হচ্ছে তা এক স্টাটিসটিক্স, বাস্তবের অবস্থা হল দেশের যাবতীয় সম্পদ কয়েকটা ক্রোনি ক্যাপিটাল, অসৎ ব্যবসায়ীদের হাতে জমা হচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধি এমন এক জায়গায় যা প্রতিদিন টাকার দাম কমিয়েই চলেছে, আমদানি বাড়ছে, রফতানি কমছে। ওদিকে বিশ্বগুরু হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় প্রতিবেশী দেশের কাছে ভারত এখন এক বিপদ, এক দেশ, যাকে তারা বিশ্বাসই করে না। বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষ ভারতবর্ষকে তাদের শত্রু বলে মনে করে। নেপালে যান, আমাদের ১০০ টাকা ওদেশের ১৬০ টাকা কিন্তু একজনও ওই হিসেব মানে না, ১৫০ টাকায় দিন তো দিন, না হলে যান, এটাই সাধারণ নিয়ম। পাকিস্তানের কথা বাদই দিলাম। শ্রীলঙ্কা আপাতত চীনের কব্জায়, তার আলাদা করে কিছু করার নেই, মালদ্বীপের নতুন শাসক বলেছেন ভারতের একজন সেনাও আর সে দেশে থাকতে পারবে না। ভারত বিরোধিতাই তাঁর রাজনৈতিক হাতিয়ার। আফগানিস্তানে ভারতের বিরাট বিনিয়োগ আছে, সেই বিনিয়োগ কীভাবে সুরক্ষিত রাখা যায়, তা নিয়ে চিন্তায় ভারত, মায়ানমারেও একই অবস্থা, সেই বিনিয়োগ সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে উত্তর পূর্বাঞ্চলে জটিল রাজনৈতিক সমীকরণের জন্ম হচ্ছে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | রামরাজ্যে ভুখা মানুষ
এদিকে দেশের মধ্যে মোদি সরকারের হাজার চেষ্টার পরেও হিন্দু জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের বেশি এখনও বিজেপির সঙ্গে নেই। গোদের ওপর বিষফোঁড়া দক্ষিণ ভারত হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। আদিবাসীরা নারাজ আর জাতি জনগণনা আর সংরক্ষণের গোলমেলে হিসেবের ফলে দেশের রাজনৈতিক সমীকরণ, সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং লাটে উঠতে বসেছে। এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই আরএসএস-এর হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্নের গোড়ায় নাড়া পড়েছে। দেশের বহু মানুষ, বিরোধী দল যেমন এটা জানে যে এবারে আবার যদি নরেন্দ্র মোদির সরকার এক বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরে আসে তাহলে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধানের আর কিছুই বাঁচানো যাবে না, ঠিক সেইরকমই আরএসএস-বিজেপিও জানে যে এবার ক্ষমতায় না ফিরতে পারলে আর কোনওদিনও ওই হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণ হবে না। কাজেই দু’ পক্ষের কাছে এটা হয় এবার নয় নেভার-এর জায়গাতে দাঁড়িয়ে আছে। বিরোধীরা তাদের চেষ্টায় কতটা সিরিয়াস জানি না কিন্তু আরএসএস বা সঙ্ঘ পরিবার এ ব্যাপারে অত্যন্ত সিরিয়াস, তারা যে কোনও মূল্যে এই লক্ষ্যে পৌঁছতে বদ্ধপরিকর। ৯ নভেম্বর, তারিখটা ভারতের রাজনৈতিক আলোচনায় বহুবার উঠে আসে, আসবেও। এই ৯ নভেম্বর ১৯৮৯ শ্রীরাম জন্মভূমির শিলান্যাস হয়েছিল, এক দলিত যুবক কামেশ্বর চৌপালের হাতে এই শিলান্যাস হয়েছিল। রাজীব গান্ধী মন্দিরের দরজা খুলে দিয়েছিলেন, কিন্তু আরএসএস, সঙ্ঘ পরিবার, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বিজেপিই তার থেকে রাজনৈতিক ফায়দাটা তুলেছিল। কী আশ্চর্য সেই ৯ নভেম্বরেই ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায় এল, অযোধ্যা রামমন্দির আইনি সিলমোহর পেল। সেই ৯ নভেম্বরেই দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী ভাষণ দিতে এলেন ছত্তিশগড়ে, এতদিন তাঁকে আমরা গেরুয়া উত্তরীয়তে দেখেছি, এদিন তাঁর গলায় গেরুয়া উত্তরী তে লেখা ছিল জয় শ্রীরাম। এক্কেবারে ওই একই উত্তরীয় পরে ওই দিনেই আদিত্যনাথ যোগীর ১৮ জন ক্যাবিনেট মন্ত্রী বৈঠকে বসে ওই রামমন্দিরের পাশাপাশি আরও কত কিছু হবে তার সিদ্ধান্ত নিলেন। ছত্তিশগড়ে নির্বাচনী সভায় মোদিজি বললেন রাম কাজু কিনহে বিনু মোহি কঁহা বিশ্রাম, রাম কাজ করা ছাড়া আর আমার বিশ্রাম কোথায়। পুরাণ কথায় হনুমান রামের আদেশে সীতাকে খুঁজতে বেরিয়েছেন, তাঁকে একটু বিশ্রাম নিতে অনুরোধ করা হচ্ছে, তিনি বলছেন, রামের কাজ হাতে আছে, এখন আমি তো বিশ্রাম নিতে পারব না। তো এটাই আপাতত নরেন্দ্র মোদির লক্ষ্য। এবং এই একই লক্ষ্য নিয়ে দুটো বড় আয়োজন বা বৈঠক হয়ে গেল। একটা নাগপুরে, ৫ থেকে ৭ অক্টোবর, আরএসএস-এর ৩৫৭ জন কার্যকর্তা সেই বৈঠকে হাজির ছিলেন। এতদিন রাম জন্মভূমি ইত্যাদি নিজে বিজেপির বা সঙ্ঘ পরিবারের অন্যদের বিভিন্ন কর্মসূচির কথা আমরা জানি। এবারে জল দেওয়া, মাটি আনা, ২২-এ জানুয়ারির আগে পয়লা জানুয়ারি থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত আরএসএস কর্মীদের প্রতি ঘরে ঘরে যাওয়া, এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে দেশের প্রতিটি হিন্দুকে জুড়ে নেওয়ার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত নিজেই এই অনুষ্ঠানে হাজির থাকছেন।
অর্থাৎ খোলস ছেড়ে এবার নিজের পরিচয়ে মাঠে নামছে আরএসএস। অন্য বৈঠকটা হয়েছে ভুজে, সেখানে হাজির ছিল অখিল ভারতীয় কার্যকারিণী মণ্ডল, ছিলেন আরএসএস-এর মাথারা, ছিলেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মকর্তারা, ছিল অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, ছিল ভারতীয় মজদুর সংঘ, ভারতীয় কিষাণ সংঘ, বনবাসী কল্যাণ সমিতির কর্মকর্তারা। সামনের নির্বাচন এবং তার আগে রামমন্দির, হিন্দুত্বের এক প্রবল জোয়ার বইয়ে দিতে হবে, তার বিস্তৃত আলোচনা এবং পরিকল্পনার শেষে তাঁরা কাজ শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু সমস্যাটা কোথায়? প্রথম সমস্যা হল অর্থনীতি, মানুষ এই রামমন্দির, হিন্দু মুসলমান ইত্যাদি শুনতে শুনতে ক্লান্ত। এই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনের ইস্যুই দেখুন না, বিজেপি তো চাইছে বাইনারিটা হিন্দু-মুসলমানে চলে যাক, কিন্তু হচ্ছে কী? গত ৯ বছর ধরে অক্লান্ত চেষ্টা করার পরেও হিন্দু জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ বিজেপির দিকে গেছে। তার উপরে এখন পিছড়ে বর্গ, দলিত ইত্যাদি নিয়ে জাতিগণনা বিজেপির সমস্যা বাড়িয়েছে। মাথায় রাখুন ঠিক ওই ৯ নভেম্বরেই নীতীশ কুমার বিহারের জাতিগত জনগণনার ভিত্তিতে পিছিয়ে পড়া জাতির মানুষদের জন্য ৬৫ শতাংশ সংরক্ষণের ঘোষণা করলেন। বিজেপির সমস্যাটা এখানেই, তারা জাতিগত জণগণনা মেনে নিলে, সেই ভিত্তিতে সংরক্ষণের দাবি উঠবেই আর সেটা করতে গেলেই তাদের উঁচু জাতির ভোটব্যাঙ্ক, ব্রাহ্মণ, রাজপুত বানিয়াদের সমর্থন সরে যাবে। সব মিলিয়ে এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে ভারতের ভবিষ্যৎ। বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়লে, জাতিগত জনগণনার দাবিকে সামনে রেখে লড়লে, ধর্মনিরপেক্ষতা, কল্যাণকামী রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে সামনে রেখে লড়লে বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারকে রোখা সম্ভব। কিন্তু তাদের বিচ্ছিন্নতা আর বিভাজন কিন্তু বিজেপিকে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছিয়ে দেবে, দেশের চেহারা বদলে যাবে।