বার্কলেজ-হুরুন ইন্ডিয়া চ্যাপ্টারের রিপোর্টে চোখ রাখুন, এরা দেশে বিদেশে সম্পদশালীদের সম্পদের হিসেব-নিকেশ করে দুনিয়াজুড়ে সম্পদশালীদের বৃদ্ধির হার, তাদের মধ্যে চলতে থাকা প্রতিযোগিতার হিসেব দিয়ে থাকে। তো সেই রিপোর্ট এসেছে ক’দিন আগেই, বলা হয়েছে দেশের জিডিপির ১০ শতাংশ কেবল একটা ফ্যামিলির হাতে, তাদের সম্পত্তি ২৫.৭৫ ট্রিলিয়ন টাকা। ১৪০ কোটি মানুষের দেশের ১০ শতাংশ সম্পদ এক পরিবারের হাতে। এবং প্রথম প্রজন্মের ব্যবসায়ী হিসেবে সফলতম পরিবার হল আদানির, তাদের সম্পদ ১৫.৪৪ ট্রিলিয়ন টাকা। এই বছরের মার্চ মাসের হিসেবে এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে। আচ্ছা এর মধ্যে ওইসব পরিবারের প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট, নগদ বা সোনাদানার হিসেব কিন্তু ধরা নেই। বলাই বাহুল্য যে বেনামে, অন্য নামে বিদেশে গচ্ছিত টাকার হিসেবও এরমধ্যে নেই, ভুয়ো কোম্পানির হিসেব ধরলে মনে করা হচ্ছে আদানি আম্বানি খুব দূরে থাকবে না। মানে এই দুই গুজরাতি পরিবার দেশের ২০ শতাংশ জিডিপির মালিক হয়ে বসে আছেন, আর আমরা ভাবছিলাম তিন চার পাঁচ মাস ধরে বিয়ে চলছে কেন? ভাবা উচিত, থামল কেন? আদানিকে বাদ দিন, ও তো প্রথম প্রজন্মের ব্যবসায়ী, প্রতিষ্ঠিত হাউসগুলোর মধ্যে আম্বানির পরে আছে বাজাজ, ৭.১৩ ট্রিলিয়ন টাকা, তিন নম্বরে বিড়লা, ৫.৩৯ ট্রিলিয়ন টাকা, সজ্জন জিন্দাল আর নাদার পরিবার রয়েছে চার আর পাঁচে। প্রথম প্রজন্মের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আদানি প্রথমে, তার পরেই আছে সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার মালিক আদর পুনাওয়ালা। ডারউইন বলেছিলেন, সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট। সক্ষমতম প্রজাতিই বেঁচে থাকে, বিবর্তিত হয়, কিন্তু টিকে যায়। যারা সক্ষম নয়, যারা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি, তারা উবে গেছে, এক্সটিঙ্কট হয়ে গেছে। যেমন?
যেমন কয়েক লক্ষ বছর আগেই ডাইনোসরাসের যাবতীয় প্রজাতি উবে গেছে, তারা এখন ফসিল, তারা এখন শিশুপাঠ্য বা হাড় হিম করা সিনেমা। আবার ১৬৬২ সালেও যে ডোডো পাখিদের দু’ একটাকে দেখা যেত, তাদের একজনও বেঁচে নেই, তারাও পৃথিবী থেকে মুছে গেছে। ডারউইন একেই বলেছিলেন সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট। এই ফিটেস্ট কারা? যারা নিজেদের খাদ্য আহরণে সক্ষম, নিজেদের বংশবৃদ্ধিতে সক্ষম, নিজেদের প্রতিরক্ষা করতে সক্ষম, ডারউইন এদেরকেই ফিটেস্ট বলেছেন, সেই ফিটেস্টরা বেঁচে রয়েছে। কিন্তু একটা বড়সড় তালিকা এখনও আছে, যারা তেমন সক্ষম নয়, এদেরকে সংরক্ষণ না করা হলে, এরাও উবে যাবে, এদেরকে আপাতত পৃথিবীর মানুষ এনডেনজারড স্পিসিসের তালিকায় ঝুলিয়ে রেখেছে। বছর পাঁচ, বছর দশ পরে পরে এদের কেউ কেউ উবে যাচ্ছে, উবে যাবে। প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু মানুষ? মানুষ পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক, শারীরিক কারণে তার উবে যাওয়ার কোনও কারণই নেই। বিজ্ঞানের বহু আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে তার আয়ু বেড়েছে, খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে, বাসস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। কাজেই যে বিশাল সম্পদ মানুষের কাছে আছে, কেবলমাত্র তার সুষ্ঠু ব্যবহার করলেই মানুষের উবে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু প্রশ্ন ঠিক এইখানটাতেই, ওই যে বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ, যা কারও একলার ছিল না, বানর থেকে মানুষের বিবর্তনের পরেও যে সম্পদ ছিল সব্বার, সেই সম্পদ কিছু মানুষ কুক্ষিগত করতে শুরু করল। অঢেল জল জমি জঙ্গলের উপর কিছু ব্যক্তির মালিকানা সমাজে শ্রেণি বিভাজন আনল। সেই থেকে কিছু মানুষ বসে খায়, কিছু মানুষ খেটে খায়। এই বসে খাওয়া মানুষের চারধারে থাকে কিছু বুদ্ধিমান মানুষ, কিছু শক্তিমান মানুষ, কিছু ছকবাজ মানুষ, কিছু কূটকৌশলে, ছলাকলায় রপ্ত মানুষ। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাড়তে থাকে কুক্ষিগত হওয়া সম্পদ।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | চৌকিদার চোর হ্যায়
সে সম্রাট অশোকই বলুন আর সম্রাট আওরঙ্গজেব, একলা একলাই তো সাম্রাজ্য বাড়িয়ে নেননি, সঙ্গে মন্ত্রী ছিল, সান্ত্রী ছিল, পরামর্শদাতারা ছিল, ছিল মাইনে পাওয়া সৈনিক। রাজার ছেলে রাজা হয়েছে, পুরোহিতের ছেলে পুরোহিত, মুচির ছেলে মুচিই হয়েছে, নাপিতের ছেলে নাপিত হয়েছে, কৃষকের ছেলে লাঙল ধরেছে। কখনও সখনও এর ব্যত্যয় ঘটেনি? ঘটেছে, কিন্তু এক্সসেপশন প্রুভস দ্য রুল ওনলি। এই মধ্যযুগ থেকেই বিষয়টা খুব দ্রুত বদলাতে থাকল। কলকারাখানা এল, পুঁজি এল, শ্রমিক নামের এক নতুন শ্রেণি তৈরি হল। কল কারখানা শ্রমিক কোথা থেকে এল তা তো আমরা জানি, জেমস ওয়াট বাষ্পচালিত ইঞ্জিন আবিষ্কা করলেন, কিন্তু তাকে কিনে এনে উৎপাদন বাড়নোর যে কারখানা, তার পুঁজি এল কোত্থেকে? হাতে লোটা নিয়ে জামসেদপুরে গেলেই তো ইস্পাত কারখানা গড়ে তোলা যায় না। প্রথম পুঁজি এল জমি বেচে, জমিদারি বেচে, দ্বিতীয় পুঁজি এল বেনিয়াদের সঞ্চয় থেকে, বহু পরে পরবর্তী স্তরের পুঁজি এল মানুষ ঠকিয়ে, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে ঠকিয়ে। যারা লেঠেল দিয়ে, সৈনিক দিয়ে জমি লুটেছিল, যারা তাদেরই সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে মাল নিয়ে কেনাবেচা করে পয়সা কামাল আর যারা ধূর্ত, ঠকবাজ তাদের পুঁজিতেই বেড়ে উঠল অর্থনীতি। তারা তখন সব দুধে ধোওয়া দেবশিশু। নিজের পয়সা কাজে লাগিয়ে, বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে কী বিশাল বড়লোক হয়েছে, এটাই প্রচার, তাদের নতুন নাম আন্ত্রেপেনিওর। হ্যাঁ, বিবর্তনের ইতিহাসে একমাত্র মানুষই এই কাজ করেছে, দুনিয়ার সম্পদকে কুক্ষিগত করেছে। পাখিরা করেনি, মাছেরা করেনি, কীটপতঙ্গেরা করেনি, মানুষ করেছে। সেই সম্পদ কুক্ষিগত হতে হতে আজ এক নতুন তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে, সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট নয়, সারভাইভাল অফ দ্য রিচেস্ট। বেঁচে থাকবে কেবল বড়লোকেরা, তারা যাদের হাতে আছে অঢেল অর্থ, অঢেল সম্পদ। প্রাকৃতিক সম্পদের নির্লজ্জ ব্যবহারের পরে এখন নিশ্বাস নেওয়ার অক্সিজেনও পণ্য, তাই যাদের হাতে থাকবে সেই অক্সিজেন কেনার ক্ষমতা, পরিস্রুত পানীয় জল কেনার ক্ষমতা, যাদের হাতে থাকবে ক্রমশ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে যেতে থাকা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চাবিকাঠি। যাদের হাতে থাকবে দামি, আরও দামি হতে থাকা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ জোগানোর রেস্ত, তারাই বেঁচে থাকবে। বাকিরা ধুঁকবে, কেউ কেউ মইয়ে চড়ে উপরতলার বাসিন্দা হতে চাইবে, দু’ একজন পারবে, তাদের এই পারাটাই গণতন্ত্রের জয় বলে চিহ্নিত হবে। কিন্তু ঠিক সেই সময়ের মধ্যেই উবে যাবে বহু জনজাতি, বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতি। সারভাইভাল অফ দ্য রিচেস্ট। সেটা এবছরের অক্সফ্যাম রিপোর্ট আবার মনে করিয়ে দিল।
আগেই বলেছি অক্সফ্যাম হল এক সংস্থা যারা পৃথিবীর দেশে দেশে সমীক্ষা করে দারিদ্রের, আজ থেকে নয়, ১৯৪২-এ যুদ্ধের মাঝখানেই গ্রিসের দুর্ভিক্ষে সাহায্য করতে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির কিছু অধ্যাপক, কিছু বিশিষ্ট মানুষ মিলে এই কাজ শুরু করেন। আজও তাঁদের সমীক্ষা দেশে দেশে চলে, তাঁরা এই দারিদ্রকে কমানোর কথা বলেন, বৈষম্যকে কমানোর কথা বলেন। ফেমিন, দুর্ভিক্ষের সময় গড়ে ওঠা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এই সংগঠনই আজকের অক্সফ্যাম। তাদের রিপোর্টও আমাদের হাতে। তাতেও আমাদের দেশের আর্থিক বৈষম্যের কথা উঠে এসেছে এবং তা ভয়ঙ্কর। সে রিপোর্ট বলছে, আমাদের দেশের ১ শতাংশ মানুষ, দেশের ৪১ শতাংশ সম্পদের মালিক। আর ঠিক উল্টোদিকে সবথেকে গরিবের দিক থেকে, তলার দিক থেকে ৫০ শতাংশ মানুষের কাছে আছে মাত্র ৩ শতাংশ সম্পদ। কিন্তু এরাই, মানে এই ৫০ শতাংশ মানুষের কাছ থেকে আদায় হয় ৬৪ শতাংশ জিএসটি। দেশের ১০ শতাংশ ধনীদের কাছ থেকে আদায় হয় মাত্র ৪ শতাংশ জিএসটি। মানে কী দাঁড়াল? ওই ৫০ শতাংশ মানুষের কাছ থেকে আদায় হওয়া ৬৪ শতাংশ জিএসটির টাকায় ফ্লাইওভার হবে, বুলেট ট্রেন ছুটবে, সেখানেই সব থেকে প্রাইভেট কার চলবে, সবথেকে বেশি বড়লোকেরা চড়বে। উন্নয়ন হবে গরিবের পয়সায়, সেই ফোরজি, ফাইভজি, ১২ লেনের রাস্তা, ফ্লাইওভার ব্যবহার করবে বড়লোকেরা। এই ২০২৩ সালে দেশের সবথেকে বড়লোকের প্রথম ১০০ জনের কাছে আছে ৫৪.১২ লক্ষ কোটি টাকা। প্রথম ১০ জনের কাছে আছে ২৭.৫২ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২১-এর তুলনায়, ২০২৩-এ এদের সম্পদ বেড়েছে কত? ৩২.৮ শতাংশ। গৌতম আদানির একলারই সম্পদ বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। ৩০ শতাংশ ভারতীয়দের কাছে আছে ৯০ শতাংশের বেশি সম্পদ। মানে খুব পরিষ্কার, এই ৩০ শতাংশ বাঁচুক, তলায় জোরদার কম্পিটিশন চলুক, কিন্তু বেঁচে থাকুক। এরা বাঁচলেই বাজারে বিক্রি হতে থাকবে ফ্রিজ, টিভি, ওভেন, এরাই যাবে উচ্চশিক্ষায়, এরাই পাবে চিকিৎসার সুযোগ।
বাকিরা? ওই যে ডোডো পাখি, উবে যাবে। ২০২০তে আমাদের দেশের বিলিওনিয়ারের সংখ্যা ছিল ১০৬ জন, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৬ জন। তার মানে ক্রমশ সম্পদ আরও কুক্ষিগত হচ্ছে, বৈষম্য আরও বাড়ছে। এই বড়লোকেদের কাছ থেকে ট্যাক্স নিয়ে কিছুটা বৈষম্য কমানো যেত, তা না করে আজকের সরকার এই করোনার মধ্যে কর্পোরেট ট্যাক্স ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২২ শতাংশ করেছিল, রাজস্বখাতে আয় কমেছিল ১ লক্ষ ৮৪ হাজার কোটি টাকা। এই রিপোর্টই বলছে ২০১৭-২০২৩-এ গৌতম আদানির অবিক্রীত উৎপাদনের ওপর কেবল এককালীন কর বসালেই সরকার পেত ১ লক্ষ ৭৯ হাজার কোটি টাকা, এ দিয়ে সারা দেশের ৫০ লক্ষের বেশি প্রাথমিক শিক্ষকদের ১ বছরের মাইনে দেওয়া যেত। দেশের ১৬৬ জন বিলিওনিয়ারের উপর কেবল ২ শতাংশ অতিরিক্ত ট্যাক্স বসালে পাওয়া যাবে ৪০ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা, তিন বছর অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের খাবার দেওয়া যাবে। সবথেকে ধনী ওই ১০ জনের আয়ের উপর যদি ৫ শতাংশ ট্যাক্স বসানো যায়, তাহলে সরকার পাবে ১ লক্ষ ৩৭ হাজার কোটি টাকা যার পরিমাণ কেন্দ্রে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রক আর আয়ুষ মন্ত্রকের বাজেটের দেড় গুণ। কিন্তু সরকার তা করছে না, তা করবেও না, কারণ এই সরকার ওই ফড়ে পুঁজিপতিদের সরকার, এই সরকার, এই সরকার আদানি আম্বানিদের সরকার, গরিব আমজনতার জন্য এদের গাজর হল ওই রামমন্দির, কাশী, মথুরা, ব্যস। এবং প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার দোরগোড়ায় বসে থাকা দেশের ৭০ শতাংশ মানুষের পিঠ ঠেকে গেছে দেওয়ালে, তাদের কাছে দুটো অপশন, এক তারা ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, নয় তারা রুখে দাঁড়াবে।