হাসিনা তো পালিয়ে বেঁচেছেন, কিন্তু বাংলাদেশ? দাউ দাউ করে জ্বলছে। সেনাবাহিনী কি সময় নিচ্ছে? সবকিছু যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে তখন তারাই ফেরেস্তা হয়ে মাঠে নামবে? জায়েজ হবে সেনা শাসন? যাই হোক, এক হারকুলিয়ান টাস্ক রাখা হল নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য যাদের মধ্যে কোনও কোহেসিভনেস নেই, কোনও কাজ চালানোর মতো সম্পর্কও নেই। যাঁরা প্রশাসন কোনওদিনও চালাননি, সরাসরি রাজনীতির মানুষও নন। কেন? সরাসরি রাজনীতির মানুষ না হলে কী হয়? আর হলেই বা কোন সুবিধে? রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকজন মানুষের নাড়ির স্পন্দন খানিক বেশিই বুঝতে পারেন, আর তাঁদের দু’ পা পিছনোর মধ্যে পাহাড়প্রমাণ ইগো জমা হয় না। একজন রাজনীতিবিদ যেদিন এই দুটো বিষয় মাথা থেকে সরিয়ে দেন, তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে, শেখ হাসিনার যা হয়েছে। ক্রমশ ক্রমশ ছাত্রদের ভূমিকা কমে আসছে, তারা এখন রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছে, ট্রাফিক সামলাচ্ছে কিন্তু আগামী সরকার কেমন হবে? রাষ্ট্রের চেহারা কেমন হবে? তা নিয়ে তাদের ধারণা নেই, ধারণা থাকার কথাও নয়। দেশ কী করে ধীরে ধীরে তার মাথা পিছু রোজগার বাড়াচ্ছিল, কী করে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল এই ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে কথা বলব, ওই ব্যাপারে চীনের সঙ্গে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মুখের উপর না বলার ক্ষমতা এই রাষ্ট্র কোথা থেকে কী করে পেয়েছিল তা এই ছাত্ররা জানেন না। এই আন্দোলনের শুরুয়াত তাঁরাই করেছেন, কিন্তু শেষের দায় অন্যরা নেবেই।
এই আন্দোলনের কোথাও ছিল যে জামাতের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে? ছিল নাকি এই দাবি যে খালেদা জিয়াকে অবিলম্বে জেল থেকে মুক্তি দিতে হবে? ছিল না তো। তাহলে হাসিনা দেশ ছাড়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এই সিদ্ধান্তগুলো কী করে হয়ে গেল? আগে থেকেই চিত্রনাট্য রচনা হয়ে থাকলেই এরকম সুচারুভাবেই সব কিছু একটা প্যাটার্ন মেনেই হতে থাকে। এই আন্দোলনের কোথাও ছিল নাকি যে আওয়ামি লিগ দেখলেই মারো, তাদের সম্পত্তি জ্বালিয়ে দাও, হচ্ছে তো। এই আন্দোলনের দাবি সনদের কোনখানে লেখা ছিল দেশের প্রত্যেক মুজিবের মূর্তিগুলোকে উপড়ে ফেলতে হবে, হচ্ছে তো। বাকি তো ছেড়েই দিলাম বেগম রোকেয়ার মূর্তি, জয়নুল আবেদিনের মূর্তি ভাঙা হচ্ছে, কারা করছেন? ছাত্ররা? তাঁরাই আগুন লাগালেন ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে? স্বাধীনতার পরে আবার স্বাধীনতা, সেই স্বাধীনতার পরে আবার, আবার আবার স্বাধীনতা, অথচ দেখুন এত আন্দোলনের পরে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা শোনা যাচ্ছে তাতে একজন, একজন নারীও নেই, জামাতের শর্ত? অর্ধেকেরও বেশি তীব্র ভারত বিরোধী, জামাতের শর্ত? ছাত্রদের আন্দোলনের মধ্যে ঢুকেছে এজেন্ট প্রোভোকেটররা, ফিফথ কলামনিস্টরা, তাদের হাত থেকে রাশ এখন অন্যদের হাতে চলে যাচ্ছে, খুব দ্রুত। শেখ হাসিনা পালয়ে যাওয়ার তিনদিনের মাথায় ঢাকা পল্টনে দাঁড়িয়ে বিএনপি-র জমায়েতে খালেদা জিয়ার ভাষণ শুনুন, সাফ বলে দিয়েছেন তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করান, তিন মাসের মধ্যে ট্রান্সফার অফ পাওয়ার। পুলিশ রাস্তায় নেই, মিলিটারি আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না, শেখ হাসিনা পালানোর পরেও মৃত্যুর সংখ্যা ২০০ ছুঁই ছুঁই। যাঁরা আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন তাঁদের অনেকেই বুঝতে পারছেন কী হয়েছে, এবং আগামী দিনগুলো এই চেনা ছকের বাইরে কিচ্ছু হবে না। আন্দোলনের শুরু আর হাসিনার পালানো আর এখন যা যা ঘটছে তার ফলে কোন কোন পক্ষের ক্ষতি, কোন কোন পক্ষের লাভ?
বাংলাদেশের বিষয়, তাই আগে বাংলাদেশের স্টেকহোল্ডারদের নিয়েই আলোচনাটা শুরু করা যাক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে প্রথম স্টেকহোল্ডার আওয়ামি লিগ ভ্যানিশ। প্রধানমন্ত্রী পালিয়েছেন, মন্ত্রীরা পালিয়েছেন, কিছু ধরা পড়েছেন, যে মুহূর্তে লিখছি সেই মুহূর্তের খবর, কম করে ২৬ জন আওয়ামি লিগ নেতাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, আরও বেশ কিছু মরবে। হাসিনা পালানোর পরেও মৃত্যুমিছিল তো কমেনি, তাও তো ১০০ পার করে গেছে, বাড়ছে। তাদের দোকান, ঘরদোর, ব্যবসা বাণিজ্য যাকে বলে মায়ের ভোগে। ১৫ বছর অন্যের মানবাধিকার কেড়েছে অতএব তাদের মানবাধিকার কাড়াটা জায়েজ, এবার মানবাধিকার থাকবে আর এক পক্ষের, এটাও জায়েজ। কাজেই সেই ৭৩ বছর বয়সি মহিলার অন্তর্বাস এনে মিম তৈরি করাও জায়েজ। তো মোদ্দা যা বলার তা হল দেশের মূল দুই রাজনৈতিক শক্তির একটি গায়েব হলে অন্য আরেকটির সুবিধে তো হবেই। তারা এই মুহূর্তে পল্টন বাজারে জমায়েতে ভাষণ দিচ্ছে, পাসপোর্ট পেয়ে গেছেন খালেদা জিয়া, তারেক ফিরছে বাংলাদেশে বা ফিরেই এসেছে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | রাজা দুষ্ট, রাজা মন্দ, রাজা ভণ্ড…
এতদিন লুকিয়ে চুরিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করছিল জামাত, মুজিব নয় জাতির পিতা ইব্রাহিম বলছিল জামাত, ইসলামি শাসনের কথা ইনিয়ে বিনিয়ে বলছিল জামাত, ৮ শতাংশের বেশি ভোট পাচ্ছিল না জামাত। এবার যদি বিএনপি আর জামাত মুখোমুখিই লড়ে তাহলে জামাত নিশ্চিত ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পাবে, বলে রাখলাম মিলিয়ে নেবেন। ইয়েস, হিসেব করুন হু স্ট্যান্ডস টু গেইন? সামরিক বাহিনী জল মাপছে, কতটা গেলে ডুব জল, কতটাতে ভাসা যাবে মাপছে, সুযোগের অপেক্ষায়। এসব আলোচনা যখন করছি, তখন আর এক নির্বাসিতা তসলিমা নাসরিন কিছু দাবি জানালেন, এই আন্দোলন তাঁর জন্যে বাংলাদেশের দরজা যে খুলে দেবে না তা তো জানাই আছে। তবুও এক বাংলাদেশি মানুষ, এক লেখিকা যে দাবিগুলো তুললেন একবার দেখে নিন। উনি সমাজমাধ্যমে লিখলেন, যারাই নতুন সরকার গঠন করুক, আশা করছি তাঁরা এই কাজগুলো করবেন।
১) ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়ির মিউজিয়ামটি অবিকল পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
২) শিল্পী রাহুল আনন্দের বাড়ি অবিকল আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
৩) সংখ্যালঘুদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে হবে। আর কেউ যেন দেশত্যাগ করতে বাধ্য না হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ভাঙা মন্দির এবং মূর্তি নতুন করে গড়ে দিতে হবে।
৪) গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাকস্বাধীনতা যেন বহাল থাকে।
৫) নির্বাচনে আওয়ামি লিগকে বাদ দেওয়া চলবে না। নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলই অংশ নেবে।
৬) শেখ হাসিনা মাদ্রাসার ডিগ্রিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির সমতুল্য করে ভুল করেছিলেন। সমতুল্য করাটি যেন বাতিল করা হয়।
৭) নারীবিদ্বেষী এবং হিন্দুবিদ্বেষী ধর্ম ব্যবসায়ীদের ওয়াজ যেন বন্ধ করা হয়। মনে রাখতে হবে মগজধোলাইয়ের মাধ্যমে জিহাদি সংখ্যা বাড়লে নতুন সরকারের সবাইকে আল্লাহু আকবার বলে একসময় কোপাবে এরা।
৮) নাস্তিকদের ১০০ ভাগ নিরাপত্তা দিতে হবে। যে নাস্তিকেরা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে, তারা যেন দেশে ফিরে আসতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
৯) মাদ্রাসাগুলোকে সাধারণ ইস্কুলে পরিণত করতে হবে। বিজ্ঞান শিক্ষায় ছাত্র ছাত্রীদের শিক্ষিত করতে হবে।
১০) নির্বাচনে প্রতিটি দল যেন নারীদের ৫০ শতাংশ নমিনেশন দেয়।
১১) সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে নারীর জন্য কোটা থাকবে ২০ শতাংশ।
১২) শেখ হাসিনা আর শেখ মুজিব এক নয়। শেখ মুজিবের ভালো কিছু মূর্তি, বীরশ্রেষ্ঠদের ভাস্কর্য পুনর্নির্মাণ করতে হবে।
১৩) আওয়ামি লিগ করা কোনও অন্যায় নয়। আওয়ামি লিগের নেতা-কর্মীকে হত্যা করা, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার অধিকার কারও নেই। অচিরে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে।
১৪) ময়মনসিংহের শশীলজে ১২০ বছরের পুরোনো ভেনাস মূর্তি ফের প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জয়নুল আবেদিনের মূর্তি নতুন করে গড়ে দিতে হবে।
১৫) সুনামগঞ্জের জাদুঘর ফের নির্মাণ করতে হবে। কুমিল্লার বীরচন্দ্র গণপাঠাগার এবং সারা দেশে আর যেসব জাদুঘর এবং পাঠাগার ধ্বংস করা হয়েছে, সব গড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
১৬) ধ্বংসযজ্ঞে যারা অংশ নিয়েছে তাদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৭) কয়েক হাজার পুলিশ হত্যা করেছে বিএনপি জামাত শিবিরের সন্ত্রাসিরা। হত্যাকারীদের বিচার করতে হবে।
১৮) পাঠ্যপুস্তকে বাদ পড়া লেখাগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে। লজ্জাসহ সকল নিষিদ্ধ বই থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে। লেখক, ব্লগার, মুক্তচিন্তক হত্যার বিচার করতে হবে।
১৯) সবার জন্য শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা ফ্রি করতে হবে।
২০) যদিও নতুন নেতা মুহম্মদ ইউনুস, আসিফ ইকবাল, সলিমুল্লাহ খান, পিনাকী ভট্টাচার্যরা ভারত বিদ্বেষী, দেশের স্বার্থে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।
তাঁর এই কুড়ি দফা দাবির ৫০ শতাংশও যদি করা হয় আমরা এক নতুন বাংলাদেশকে দেখতে পাব আমরা। কিন্তু এই মুহূর্তের ছবি তা বলছে না, এই মুহূর্তের ছবি রক্ত আগুন ধোঁয়া, ঘৃণা আর কান্নায় ভরা, পড়শি হিসেবে আমাদের দেখে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায়ও তো নেই।