আমরা বাংলায় তিলোত্তমা আর জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের বাইরে বের হতে পারিনি আর তার ফাঁকেই কাশ্মীরে নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচন হবে হরিয়ানায়, প্রার্থী তালিকা ফাইনাল হয়ে গেছে। মহারাষ্ট্র আর ঝাড়খণ্ডে এ বছরের শেষেই ভোট। আর বিজেপি খুব ভালো করেই জানে যে ঝাড়খণ্ডে ওই চম্পাই সোরেনকে নিয়ে তারা বড়জোর লড়াইয়ে ঢুকেছে, সেটাও ব্যুমেরাং হবে কি না তা তাদের কেন আমাদেরও জানা নেই। মানুষ যদি চম্পাই সোরেনকে গুরুজির কথামতো দিকুদের দালাল, মানে বহিরাগতদের দালাল মনে করে, তাহলে ঝাড়খণ্ডও যাবে। কাশ্মীর থেকে শুরু করা যাক। জম্মুতে তবু রাস্তাঘাটে নেমেছে বিজেপি, কারণ জম্মুতে হিন্দু পপুলেশন আছে, তাদের কিছু জমি আছে। কিন্তু কাশ্মীর ঘাঁটিতে? ওই শেখ আব্দুল রশিদ, যাঁকে ইঞ্জিনিয়ার রশিদ বলে ডাকা হয়, যিনি সাংসদও বটে, তাঁকে ম্যানেজ করে বিজেপি কল্কে পেতে চায়। সমস্যাটা হল বিজেপির সঙ্গে তাঁর ন্যূনতম সম্পর্ক আছে এ খবর রটে যাওয়ার পরে আব্দুল রশিদ নিজেই খানিক দ্বিধায়। কাশ্মীর ঘাঁটিতে এতদিন পরেও বিজেপিকে মানুষ ঘৃণা করে। অমিত শাহ একটা সভাও করেননি, দেশের প্রধানমন্ত্রী মোদিজিও হাজির হতে পারেননি, অবস্থাটা এতটাই গুরুতর। ওদিকে কংগ্রেস আর ন্যাশনাল কনফারেন্স জোট বেঁধেছে, একটা আসন সিপিএমকে দিয়ে সেই জোট আপাতত বেশ শক্তিশালী। তিন চারটে আসনে খানিক জট আছে, তা বাদ দিলে ইন্ডিয়া জোট কাশ্মীর ঘাঁটি ক্লিন সুইপ করবে। ওদিকে ক্ষতি করতে পারত, অন্তত ক্ষতি করবে এমনটা মনে করেছিল বিজেপি, গুলাম নবি আজাদের দল, সেখানেও হাল খারাপ, সেখানেও শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে বিজেপিকে, তাঁর নতুন দল ভেঙে চুরমার এবং তাঁরা নির্বাচনে অংশই নিচ্ছেন না। একই ব্যাপার পিডিপিতে, মেহবুবা মুফতির দল নির্বাচনে নেই। সব মিলিয়ে কাশ্মীর ঘাঁটিতে সবচেয়ে বড় জোট ওই কংগ্রেস ন্যাশনাল কনফারেন্স বাম। কাজেই কাশ্মীরে বিজেপির কোনও আশা কোনওদিনও ছিল না আজও নেই, উলটে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের এলাকাতেও কিছু আসন এবারে বিজেপি হারাবে।
এবার চলুন হরিয়ানাতে। কংগ্রেস এখানে আগে থেকেই নিজেদের জমি ঠিক করেছে, জাঠভূমিতে জেজেপি, দেবীলালের নাতি দুষ্মন্ত চৌতালা বিজেপির জোট ছেড়ে বাইরে এসে একলাই লড়ছেন, কংগ্রেস একটা আসন ছেড়েছে সিপিএমকে, বাকি আসনের সবক’টাতেই লড়ছে। আপও ৯০টা আসনেই প্রার্থী দিয়েছে। কিন্তু গোটা ১৫-১৮ আসন ছাড়া তারা লড়াইয়ের মধ্যেই নেই। এমনিতে হরিয়ানাতে বিজেপি বরাবরই ল্যাজ পার্টি, মানে তারা সমর্থন দিয়ে বা নিয়ে সরকার তৈরি করে, এবারে তাদের সমর্থনে ওখানে কেউ নেই। হয় কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, না হলে জেজেপি কংগ্রেস সরকার তৈরি হওয়ার একটা সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। দুষ্মন্ত সিং এবার মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সির দিকে নজর দিয়েছেন, তার কমে তিনি সমঝোতা করবেন বলে মনে হয় না। আপ যদি দশের বেশি আসন পায় তাহলে তারাও এই গদি দখলের খেলাতে শরিক হতে পারবে। কিন্তু এদের কেউই নির্বাচনের পরে বিজেপির সঙ্গে যাবে না, কাজেই হরিয়ানা বিজেপির হাত থেকে যেতে বসেছে, এটা বিজেপির নেতারা জানেন, জানে মানুষ। প্রতিদিন বিজেপির যে ক’টা নিশ্চিত আসনও ছিল সেই আসনগুলোতে বিরোধী প্রচারের তীব্রতা বাড়ছে। পুজোর পরে, সম্ভবত নভেম্বরে নির্বাচন মহারাষ্ট্রে। এক প্রবল হারের জন্য দিন গুনছে বিজেপি শিন্ডে শিবসেনা জোট। গত লোকসভার ক্ষত এখনও শুকোয়নি, বরং বাড়ছে। আসন ভাগাভাগিতেই শুরু হয়ে গেছে রক্তক্ষরণ, বিজেপির বেশ কিছু রাজ্য নেতা এনসিপি অজিত গোষ্ঠীকে বোঝা বলে মনে করছেন, তাঁরা যে ক’টা আসনে লড়বেন সবকটাই চলে যাবে শরদ পওয়ারের হাতে এটাই সাধারণ ধারণা। এনসিপি অজিত গোষ্ঠীর আরও কিছু নেতা ভোটের আগেই পাড়ি দেবেন অন্য পথে, ফিরে যাবেন শরদ পওয়ারের আশ্রয়ে। ওদিকে শিবসেনা শিন্ডে গ্রুপের সঙ্গে আসন সমঝোতা হওয়া কঠিন, সব জায়গাতে হবে না এটাও বিজেপি বুঝেছে, তারা কিছু আসনে বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই হচ্ছে সেটাও বলেই রেখেছে, স্থানীয় কয়েকটি খবরের কাগজের সমীক্ষা বলছে, মুখ থুবড়ে পড়বে শিন্ডে-বিজেপি-অজিত জোট।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | এক দেশ এক নির্বাচন আসলে মোদিজির বাওয়াল
এদিকে কংগ্রেস শিবসেনা উদ্ধব আর শরদ পওয়ারের জোটে কংগ্রেসের কিছু বেশি আসনের দাবি এখনও পর্যন্ত হার্ড বার্গেনিং বলেই মনে হচ্ছে। মহারাষ্ট্র বিকাশ আগাড়িতে এবারে আম্বেদকরের নাতি প্রকাশ আম্বেদকরের দল বঞ্চিত বহুজন আগাড়ির সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব নিয়েছেন শরদ নিজে, প্রায় ৮ শতাংশ ভোট আছে এই দলের কাজেই লোকসভাতে বিরাট কিছু না করতে পারলেও বিধানসভাতে তারা ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে। আর তাদের সঙ্গেও যদি একটা আসন সমঝোতাও হয় তাহলে সেই জোট কিন্তু এক ল্যান্ডস্লাইড ভিক্ট্রির দিকে যাবে। মানে মহারাষ্ট্রও বিজেপির হাতের বাইরেই যাবে। রইল পড়ে ঝাড়খণ্ড। হেমন্ত সোরেনকে জেলে পোরার পরে যখন চম্পাই সোরেন মুখ্যমন্ত্রী হলেন, তখন থেকেই তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষায় ধোঁয়া দিয়ে গেছে বিজেপি। এই বাংলাতেই বসে ওই চম্পাই সোরেনের সঙ্গে ডিল হয়েছে, এখান থেকেই দিল্লি গেছেন তিনি এবং সেখান থেকে ফিরে রাঁচিতে বসে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। কিন্তু চম্পাই সোরেনের জমি কতটা? ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার কতটা জমি তিনি দখল করতে পারবেন? বা তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতাই বা কতটা? গুরুজি শিবু সোরেন বলেছেন চম্পাই দিকুদের দালাল, মানে বহিরাগতদের দালাল, আর এখনও ওই ৮০ বছরের শিবু সোরেনের মাটিতে পা আছে, বাড়ির বাইরে খাটিয়াতে বসে যে কথা বলেন তা এখনও আদিবাসী মানুষের কাছে বেদবাক্য। হেমন্ত সোরেন জেল থেকে বেরিয়ে এসে ভিকটিম কার্ড খেলছেন, কিন্তু কোথাও চম্পাই সোরেনের জন্যই ঝাড়খণ্ডের নির্বাচনী ছবিতে কিন্তু পরন্তু থেকেই যাচ্ছে, চম্পাই সোরেন এপিসোড না থাকলে আর তিনটের মতো এখানেও বিজেপি গোহারান হারত, এখন জিতবেই বলা যাবে না কিন্তু এ রাজ্যে লড়াই হবে। মানে ফলাফল ৩–১ হতে পারে, ৪–০ হতে পারে। চার-শূন্য হলে কিন্তু শরিকদের গলায় অন্য সুর শোনা যাবে। এমনিতেই কানাঘুষো চলছে ওয়ান নেশন ওয়ান ইলেকশন নিয়ে নাকি নীতীশ বা চন্দ্রবাবু কেউই রাজি নন। তাঁদের অমত থাকার ফলেই বেশ কিছু বিল আনার পরেও, ওয়াকফ বোর্ডের মতো বিল আনার পরেও বিজেপিকে পাল্টি খেতে হয়েছে। কাজেই এই চারটে নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে দেশের রাজনৈতিক ম্যাপ বদলাতে থাকবে। এক ঝটকায় বদলে যাবে? না তা তো হয় না, কিন্তু লক্ষ রাখুন কিছু বড় প্লেয়ারের দিকে।
প্রথম প্লেয়ার কিন্তু সেমসাইড গোল করে দিতেই পারেন। তিনি হলেন নীতিন গড়করি। ক’দিন আগেই হালকা করে বলে রেখেছেন নির্বাচনের সময়ে নাকি ওঁকে বিরোধী দলের একজন নেতা প্রধানমন্ত্রিত্বের অফার দিয়েছিলেন, কিন্তু এতদিন পরে সেটা ওঁর মনে পড়ল বলে বলে দিলেন? নাকি প্রকাশ্যেই জানালেন, দরজা খোলা আছে। ক্লিন ইমেজের এই নেতা বহু বিরোধী দলের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছেন, কাজেই এঁর দিকে নজর রাখতেই হবে। এরপর নজর রাখুন চন্দ্রবাবু নাইডুর দিকে, ছেলে নারা নাইডুকে রাজ্যপাট দিয়ে তিনি সেন্টার স্টেজে নামার প্রস্তুতি কি নিচ্ছেন? অন্ধ্র আর তামিলনাড়ু মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে দুরন্ত র্যাপোর্ট এই ধুরন্ধর নেতা দক্ষিণী লবির সাহায্য পাবেন, উত্তরেও ওঁর বন্ধু আছেন। কাজেই ওঁর দিকে নজর রাখতেই হবে। বিশাল অর্থবল নিয়ে দক্ষিণী লবির সমর্থন নিয়ে আর নিজের সেকুলার ইমেজকে সামনে রেখে দেশের সর্বোচ্চ আসনে বসার ছক তিনি করছেন না, সেটা বিজেপি বা নরেন্দ্র মোদিও বিশ্বাস করে না। প্রশ্ন হল কতদিনে তিনি খোলস ছেড়ে বের হবেন। তিন নম্বর প্লেয়ার হলেন নীতীশ, উনি আপাতত টাইটুলার হেড হওয়ার তালে আছেন। মানে অনেক হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সমর্থন বা সামর্থ্য কোনওটাই ওঁর নেই, কাজেই রাষ্ট্রপতি হতে পারলেও সেটা ওঁর এত বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বের পরে একটা প্রোমোশন তো নিশ্চয়ই। আর সেটা পাওয়ার জন্য উনি যে কোনও পক্ষে যেতে রাজি। সমস্যা হল তাঁর সঙ্গে আছেটা কে? কংগ্রেস নেতৃত্ব জানে খেলা ঘুরছে, তাঁরা ধৈর্য ধরে বসে ভুল না করলেই খেলা তাদের পক্ষে যাবে। বিজেপিও জানে খেলা ঘুরছে, কিছু বড় না করতে পারলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মাঠ ছাড়তে হবে। বছর শেষের আগেই কিন্তু ছবি অনেকটা সাফ হয়ে যাবে।