এমন নয় যে খ্রিস্টান বা মুসলমান এমনকী বৌদ্ধ বা জৈনদের মধ্যে কোনও ভাগাভাগি নেই, আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান নেই। আছে বইকি। ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট থেকে শুরু করে আরও খানদশেক বিভাজনের কথা তো বলাই যায়। তেমনিই মুসলমানদের মধ্যেও আছে, শিয়া, সুন্নি আছে, আছে আরও নানান ভাগ, যেমন বোহরা মুসলমানরা, তারা একদমই আলাদা। কিন্তু হিন্দুদের ব্যাপারটা না এক্কেবারে আলাদা। কে যে হিন্দু, কে যে হিন্দু নয় এটা গবেষণার বিষয়। ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বেশ কিছু প্রতিবাদী ধর্ম গড়ে উঠেছিল, চৈতন্যদেব থেকে শুরু করে হরিচাঁদ ঠাকুর, কবির থেকে রামদাস, কত শত প্রতিবাদী ধর্ম। তারা উচ্চকণ্ঠে হিন্দু সনাতন ধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে, নিজেদের জান মাল সম্পত্তি বাঁচাতেই একজোট হয়েছে। আবার ধরুন চার্বাকপন্থীরা, তারা ঘোষিতভাবেই নাস্তিক, ঈশ্বরে বিশ্বাসই করেন না, ইহকালেই যা করার করে নাও, পরকাল আবার কী? তো অবাক কাণ্ড হল, সেই চার্বাকও মহর্ষিদের মধ্যে একজন। কাজেই যাঁদের পাঠশালাতে ঢুকতে দেওয়া হল না, এক পুকুরের জল খেতে দেওয়া হল না, যাদের ছোঁওয়া লাগলে খাবার অশুচি হয়ে যায় তাঁরাও হিন্দু আবার ভাটপাড়ার সেই বামুনেরাও হিন্দু যাঁদের বিধানে গফুরকে গ্রাম ছেড়ে চটকলে পালিয়ে আসতে হয়। তারাও হিন্দু যাঁরা ইহকালেই বিশ্বাস করেন, পরকাল বা ইশ্বরে যাঁদের বিশ্বাস নেই তাঁরাও হিন্দু, আবার যাঁরা এক ইশ্বরে বিশ্বাস করেন বা বহু ইশ্বরে বিশ্বাস করেন তাঁরাও হিন্দু। কিন্তু এক অসম্ভব ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যের মনোভাব নিয়েই হিন্দু উচ্চবর্ণরা রাজত্ব করেছে বহুকাল। সমস্যার সূত্রপাত ইসলাম আর খ্রিস্টানদের আসার সময় থেকে। যাদেরকে পাঠশালাতে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না তারা চার্চে যেতে শুরু করল, বেশ কেষ্টর মতোই তো দেখতে, বলে খ্রিস্ট উপাসনা শুরু করল আর যদি সমাজ বহির্ভূত হয়েই থাকতে হয়, যদি ব্রাহ্মণদের সেবার শর্তেই জীবন কাটাতে হয় তাহলে তারচেয়ে ইসলাম কবুল করা ভালো। এবং খেয়াল করুন যাঁরা এদেশে এলেন তাঁরা ক্যাথলিক খ্রিস্টান বা সুন্নি মুসলমান, কাজেই বাস্তবে ওই যে ক্যাথলিক প্রোটেস্টান্ট বা সিয়া সুন্নি ভেদাভেদও তখন ছিল না। ওই দলিত, নমশূদ্র মানুষদের কাছে, ডোম চাঁড়াল, মুচি মেথরদের কাছে খ্রিস্টান হওয়া বা মুসলমান হওয়া এক ধরনের সমানাধিকার এনে দিল।
এবং ঠিক সেই সময়ে থেকেই প্রমাদ গুনলেন হিন্দু উচ্চবর্ণের মানুষজন, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যরা। তাঁরা সংখ্যায় কম কিন্তু এতদিন এক বিরাট হিন্দু সমাজের নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁরা আজ হঠাৎ ওই চ্যালেঞ্জের মুখে। তখন আবার হিন্দু পুনরুত্থানের চেষ্টা শুরু হল। মন্দিরে ঢুকতেই দেওয়া হত না যাঁদের, তাঁদের অনেকে চার্চে গেছেন, বিরাট সংখ্যক মসজিদে গেছেন, অনায়াসে গেছেন, পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ পড়তে হবে এই তো? দাড়ি রাখতে হবে এই তো? প্রভুর কৃপায় দাড়ি গজায় ভাল্লুকে খায় শাঁকালু প্রভু আমার পরম দয়ালু বলতে হবে, এই তো। আর বাকিরা তাঁদের নিজেদের হিন্দুদের মূলস্রোত থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। ইতিমধ্যে আবার সব ধর্মের মানুষজনের ভেতরের সহজিয়া সাধন শুরু হয়েছে, সে অন্য ব্যাপার পরে একদিন তা নিয়েও আলোচনা করা যাবে। কিন্তু টনক নড়েছে হিন্দুদের। বিবেকানন্দের ভাষণটা দেখুন, “নতুন ভারত বেরুক। বেরুক লাঙল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে মালা মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে। বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে। বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে। বেরুক ঝোপঝাড় জঙ্গল পাহাড় পর্বত থেকে। এরা সহস্র সহস্র বৎসর অত্যাচার সয়েছে, নীরবে সয়েছে – তাতে পেয়েছে অপূর্ব সহিষ্ণুতা। সনাতন দুঃখ ভোগ করেছে – তাতে পেয়েছে অটল জীবনীশক্তি। এরা এক মুঠো ছাতু খেয়ে দুনিয়া উলটে দিতে পারবে; আধখানা রুটি পেলে ত্রৈলোক্যে এদের তেজ ধরবে না; এরা রক্তবীজের প্রাণ – সম্পন্ন। আর পেয়েছে অদ্ভুত সদাচার – বল, যা ত্রৈলোক্যে নাই। এত শান্তি, এত প্রীতি, এত ভালোবাসা, এত মুখটি চুপ করে দিনরাত খাটা এবং কার্যকালে সিংহের বিক্রম!! অতীতের কঙ্কালচয়! এই সামনে তোমার উত্তরাধিকারী ভবিষ্যৎ ভারত।”
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ইন্ডিয়া জোট জোট-রাজনীতির সব শর্ত না মেনেই গড়ে উঠেছে
কেন বলছেন? কাদের বলছেন? সেই সব মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানুষকে ফেরাতে হবে, না হলে হিন্দু ধর্ম বিপন্ন, এটা যাঁরা বুঝেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিবেকানন্দ, হিন্দু পুনরাভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা। অন্যদিকে পাশ্চাত্যের শিক্ষা নিয়ে যুক্তিবাদ হিন্দু ধর্মের সংস্কারে নেমে পড়ল। সতীদাহ প্রথা রদ থেকে বিধবা বিবাহ, রামমোহন, বিদ্যাসাগর। যাকে রেনেসাঁ বলা হচ্ছে তা ছিল বাংলার, তা ছিল আদতে হিন্দু ঐক্য গড়ে তোলা আর তারজন্য যে সংস্কারের দরকার তাকে ত্বরান্বিত করা। কিন্তু হল কী? দক্ষিণে দ্রাবিড় আন্দোলন চূড়ান্ত ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের ফলে শক্তিশালী হয়ে উঠল সেখানকার হিন্দু অবশিষ্টরা, বাকি অংশে ধর্মান্তরণ থামেনি তা চলতে থাকে। খানিক গান্ধীজি আর খানিক সাভারকর মিলে আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য হলেও ওই হিন্দু ব্র্যাকেটের মধ্যে সব্বাইকে নিয়ে আসার চেষ্টা চালিয়েছেন। গান্ধীজি উচ্চবর্ণের শাসন শোষণের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের এক ঐক্য যেমন চেয়েছিলেন তেমনই এই বর্ণভেদের বিরুদ্ধে লড়াইও করেছিলেন। একধারে হরিজন আখ্যা দিয়ে নিম্নবর্ণের একটা আইডেন্টিটি তৈরি করা, আবার তাঁদের হরিজন বলে বুকে জড়িয়ে ধরে এক সমন্বয় তৈরি করার চেষ্টা করলেন। সাভারকর কিন্তু এক্কেবারেই হিন্দু ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা মুসলমান বা ইসলামকে মোকাবিলা করার জন্যই চেয়েছিলেন। তিনি ব্র্যাকেটের মধ্যে এক ঐক্য চেয়েছিলেন যেখানে দলিতরাও থাকবে তাঁদের নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে, ব্রাহ্মণরাও থাকবেন তাঁদের যাবতীয় রীতি নীতি উপাচার নিয়ে, কিন্তু তাঁরা সবাই হবেন হিন্দু, কারণ মুসলমানরা আসল শত্রু। এটাই তাঁর আন্দামান জেল থেকে বার হওয়ার পরে একমাত্র স্লোগান ছিল, ব্রিটিশ নয়, ইসলামের বিরুদ্ধে হিন্দু ঐক্য। কাজেই তিনিও বর্ণভেদের বিরুদ্ধে লড়েছেন, শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্যবাদকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই। এসবের মাঝখানে উত্তর ভারত জুড়ে দলিতরা দলিত থেকে গেছেন, কিন্তু মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক সাধারণ হিন্দু ঐক্য ভারতবর্ষে বরাবরই ছিল। দেশ স্বাধীন হল, ইসলাম ধর্মের মানুষজন আলাদা দেশ দাবি করলেন, পেলেনও, তার উল্টোদিকে এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র তৈরি তো হল কিন্তু তার অসংখ্য ফল্ট লাইন। এক ফল্গু ধারার মতোই হিন্দু উচ্চবর্ণের বা বলা যাক হিন্দু ধর্মের আধিপত্য থেকেই গেল সমাজে, সরকারে, প্রশাসনে, শিক্ষা ব্যবস্থায়। সে ব্যবস্থায় দলিতরা, সংখ্যালঘুরা বারবার মার খেয়েছে, তাদের কোণঠাসা হতে হয়েছে, না হলে ওই লখিমপুর বাথের মত, জেহানাবাদের মতো দলিত হত্যা হয় কী করে? কেন জন্ম নেন ফুলন দেবী? আবার দাঙ্গার বিরাট ইতিহাস থেকে গেল এই ভারতে, মূলত উত্তর ভারতে।
দক্ষিণ ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদকে অস্বীকার করেই যে দ্রাবিড় সংস্কৃতি তা আগেই থামিয়েছে ধর্মান্তরণের প্রক্রিয়া আর সেখানে সংখ্যালঘুরা ওই নন-ব্রাহ্মিণ দ্রাবিড়দের কাছেই পেয়েছেন সুরক্ষার আশ্বাস। আর এই হালে এই হিন্দু ব্র্যাকেটকে আরও বড় করার জন্যই আদিবাসীদেরও জোড়া শুরু করেছে আরএসএস-বিজেপি, তারা বনবাসী মূলবাসী বলত যাদের, তাদের মধ্যে কাজ করত কেবল খ্রিস্টানদের মোকাবিলা করার জন্য। এখন তারা সেই আদিবাসীদের হিন্দু ব্র্যাকেটে এনে আদিবাসী মুসলমান লড়ানোর চেষ্টাও করছেন, ঝাড়খণ্ডের নির্বাচনে সেই চেষ্টা আমরা দেখেছি। ওদিকে মূলত সুন্নি মসলমান, ধর্মান্তরিত মুসলমানরা পেলেন পূর্ব পাকিস্তান, সেখানকার উচ্চবর্ণের বাবুদের কলকেতায় ঘরবাড়ি ইতিমধ্যেই বানানো হয়েছে, এপার বাংলাতে তাঁদের ব্যবসা বাণিজ্য আয়ের বিকল্প ব্যবস্থা হয়ে গেছে কাজেই তাঁদের বেশিরভাগ চলে এলেন এপার বাংলায়, ভারতে। ওপারে থেকে গেলেন মাঝারি ব্যবসায়ী আর দলিত হিন্দুদের সেই অংশ যাঁদের কাছে খুব বেশি বিকল্প ছিল না। কিন্তু এক বিশাল মুসলমান আইডেন্টিটির সামনে সেই ৪৭ সাল থেকেই সে দেশের হিন্দুরা শঙ্কিত ছিলেন, যেমনটা পৃথিবীর সর্বত্র সংখালঘুরা থাকেন। কিন্তু অন্য দেশের, বিশেষ করে ভারতবর্ষের সঙ্গে বাংলাদেশের ফারাক হল, আমাদের দেশের মুসলমান সংখ্যালঘুরা এক ওই বোরহা মুসলমানদের বাদ দিলে অর্থনৈতিকভাবে ভীষণ পিছিয়ে। অন্যদিকে বাংলাদেশের হিন্দুদের মধ্যে উচ্চবর্ণ, বা সাহা, যারা ব্যবসায়ী তাঁদের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো, আবার ওই দলিত হিন্দুদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। আর ওই দলিত হিন্দুদের মধ্যে হঠাৎ কেমন করে এক সনাতন ধর্ম ঐক্য ইত্যাদি গড়ে উঠল, যে সনাতন ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধেই তাঁরা জন্মভোর লড়েছেন, তাঁরা হঠাৎ সনাতনী হয়ে উঠলেন। এঁদের সঙ্গে বৈষ্ণবরাও যোগ দিলেন যাঁদের মূল শাখা থেকে সেই কবে বেরিয়ে গিয়ে তৈরি হয়েছিল ইসকন। সেই ইসকন নাকি এখন হঠাৎ করে বাংলাদেশে হিন্দুদের মসিহা, রক্ষাকর্তা।
আবার সেই ইসকন থেকে খুব গর্হিত অপরাধের অভিযোগে, শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়নের অভিযোগে বহিষ্কৃত চিন্ময় মহারাজ হয়ে উঠলেন হিন্দুদের আইকন, যিনি ক’দিন আগে বহিষ্কৃত হওয়ার পরে আওয়ামি লিগের দুই মুসলমান নেতার আশ্রয়েই তাঁর আখড়া গড়ে তোলেন। সবটাই বিরাট গোলমেলে, আর সেটা আরও গোলমেলে হয়ে ওঠে যখন দেখি সেই মহারাজ জয় শ্রীরাম বলে চিৎকার করছেন। আসলে সংখ্যাগুরুদের যেমন সাম্প্রদায়িকতাবাদ থাকে, এদেশে আরএসএস ওদেশে জামাত সেই রাজনীতি করে, তা ভয়ঙ্কর, তেমনিই সংখ্যালঘুর সাম্প্রদায়িকতাবাদও সাংঘাতিক। তার মুখ এদেশে মিম, আসাদউদ্দিন ওয়েইসি হলে বাংলাদেশে ইসকন বা ওই চিন্ময় মহারাজ, এই আন্দোলনের পিছনে কিছু মানুষ কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালে, এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়, এবং খেয়াল করে দেখুন বাংলাদেশের যে দুটো জায়গাতে ওই চিন্ময় কৃষ্ণদাসের সভা হয়েছে, যেখানে যেখানে উনি গরম বক্তৃতা দিয়ে গ্যালারি গরম করেছেন তা হল রংপুর আর চট্টগ্রাম, দুটোই বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সীমান্ত। এদিকে সীমান্তে বাণিজ্য কমছে, কার স্বার্থ কাজ করছে এর পিছনে? মার খাচ্ছে কিন্তু দু’ দেশের ব্যবসায়ীরা, সেগুলো দেখার দরকার আছে আর কেবল চিৎকার করছে বলেই এক স্বয়ম্ভু সন্ন্যাসীর কথা মেনে নিতে হবে তারও তো কোনও কারণ নেই, কারণ ঐতিহাসিকভাবেই ওই চিন্ময় মহারাজ বাংলাদেশের হিন্দু মানুষজনের প্রতিনিধি নন। কখনও সনাতনী ধর্ম সভা কখনও ইসকনের নাম করে যাঁরা প্রতিনিধি হওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা আসলে শাসকের হয়েই কাজ করছেন না তো?