যদি কেউ প্রশ্ন করে পাগলা রাজা কাকে বলে? অনায়াসে আমেরিকার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেওয়া যায়। এক উন্মাদ বসেছে সে দেশের মাথায়। সে উন্মাদ আবার আমাদের দেশের চৌকিদারের ভারি আপন, গলায় গলায় বন্ধু। হঠাৎ ওনার মনে হল আমেরিকাকে সব্বাই ঠকাচ্ছে, আমরা প্রচুর শুল্ক, ট্যাক্স দিচ্ছি, পৃথিবীর সব দেশকে, অন্য দেশগুলো কই আমাদের তো সেই ট্যাক্স দেয় না? হঠাৎ তাঁর মনে হল। যেমন মোদিজির মনে হয়েছিল ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট বাতিল করলেই দেশের অর্থনীতিতে জাপানী তেল লাগানো হয়ে যাবে, খাড়া হয়ে উঠে বসবে দেশের অর্থনীতি। তিনি কাউকে না বলেই, মিত্রোঁ ওঁ ওঁ ওঁ বলে এসে হাজির হয়েছিলেন, আপনাদের মনে আছে। ইনি আবার রঘু ডাকাত, সব্বাইকে বলে কয়েই জানিয়ে দিলেন অমুক তারিখ থেকেই রেসিপ্রোকাল ট্যাক্স লাগু হয়ে যাবে, যে যত ট্যাক্স চাপাচ্ছ, সে তত ট্যাক্স দেবে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কোনও গবেষণা? কী হবে, কী হতে পারে, তার সামান্য গবেষণা হয়েছিল? আমেরিকাতে পণ্ডিতের অভাব নেই, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছিল? আমাদের দেশের চৌকিদার যেমন হার্ভার্ডে নয়, হার্ডওয়ার্কে বিশ্বাস করেন বলে জানিয়ে খিল্লি করেছিলেন দেশের শিক্ষিত মানুষদের, তেমনিই ট্রাম্প সাহেবও বলেছেন ও পণ্ডিতরা সব বামপন্থী, ওদের কথা কে শোনে, ইত্যাদি বলেই চালু করে দিলেন নতুন শুল্ক নীতি। ব্যস, সারা বিশ্ব টালমাটাল, কিন্তু তারমধ্যে সবচেয়ে বড় পতন কিন্তু আমেরিকাতেই।
৪ এপ্রিল, ২০২৫-এ S&P 500 ৫.৯৭ শতাংশ পড়ে যায়, মানে ৩২২.৪৪ পয়েন্ট নেমে যাওয়া, এটা ২০২০ সালের মার্চ মহামারীর পর থেকে সবচেয়ে বড় একদিনের পতন। যার ফলে ৫ ট্রিলিয়ন ডলার মানে প্রায় ৫ লক্ষ কোটি ডলার উবে গেল। ৪ এপ্রিল নাসডাক ৫.৮২ শতাংশ নীচে নামে মানে ৯৬২.৮২ পয়েন্ট কমেছে। ডিসেম্বরের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে ২০ শতাংশের বেশি কমেছে। ৪ এপ্রিল ডাও জোন্স ২,২৩১.০৭ পয়েন্ট (৫.৫ শতাংশ) কমে ৩৮,৩১৪.৮৬-এ বন্ধ হয়। এটাও ২০২০ সালের জুনের পর সবচেয়ে বড় একদিনের পতন। মোদ্দা কথা খোদ আমেরিকার বাজারেই ত্রাহি মধুসূদন। আরও একটু হিসেব দিই। আমেরিকার বাজারের বড় খেলোয়াড় অ্যাপল, ওয়ালমার্ট, জেনারেল মোটরস (GM), ফোর্ড, নাইকি, অ্যামাজন, টেসলা, এবং প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল (P&G) এই কোম্পানিগুলোর মিলিত ব্যবসার পরিমাণ প্রায় ২.২৮ ট্রিলিয়ন ডলার বা ২২৮০০০ কোটি ডলার। টাকায় হিসাব করলে (১ ডলার = ৮৪ টাকা ধরে), এটা হবে ১৯১.৫২ লক্ষ কোটি টাকা। মানে এরাই হল আমেরিকার দুধেল গরু, আমেরিকার অর্থনীতি চালনা করে এই কোম্পানিগুলো। এই ট্যারিফ মানে শুল্ক বাড়ার ফলে এই কোম্পানিগুলোর অবস্থা কেমন? ১. অ্যাপল অ্যাপলের আইফোন, আইপ্যাড, ম্যাকবুকের বেশিরভাগ উৎপাদন চীনে হয়। চীনের উপর ৩৪ শতাংশ আগের আর ২০ শতাংশ নতুন মোট ৫৪ শতাংশ শুল্ক চাপানো হয়েছে, ভিয়েতনামের উপর ৪৬ শতাংশ ভারতের উপর ২৬ শতাংশ শুল্ক চাপানো হয়েছে। অ্যাপল আমেরিকাতে উৎপাদন খরচ বেশি বলেই তাদের প্রডাক্ট চীন, ভিয়েতনাম, ভারতে তৈরির ব্যবস্থা করেছিল, এবারে এই বিশাল শুল্ক লাগু হওয়ার ফলে দুনিয়ার সবথেকে বেশি আইফোন ব্যবহারকারী হিসেবে আমেরিকাকে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম থেকে ওই উৎপাদন নিজের দেশে রফতানি করতে বিরাট টাকা শুল্ক হিসেবে দিতে হবে। না হলে ফ্যাক্টরিগুলোকেই বন্ধ করতে হবে। সব মিলিয়ে নিজের বাঁশ নিজের কঞ্চি, বাকিটা বুঝে নিন। ২. ওয়ালমার্ট চীন, ভিয়েতনাম, এবং মেক্সিকো থেকে বিপুল পরিমাণ পণ্য, ইলেকট্রনিক্স, পোশাক, গৃহস্থালি সামগ্রী আমদানি করে। চীনের উপর ৫৪ শতাংশ, মেক্সিকোর উপর ২৫ শতাংশ, এবং ভিয়েতনামের উপর ৪৬ শতাংশ শুল্ক চাপানোর ফলে এই পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হবে ওয়ালমার্ট, বিক্রি আর বাজারের শেয়ারে ঝাড় অনিবার্য। ৩. জেনারেল মোটরস মেক্সিকোতে গাড়ি ও যন্ত্রাংশ তৈরি করে আমেরিকায় আমদানি করে। মেক্সিকোর উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক এবং চীন থেকে আমদানি করা যন্ত্রাংশের উপর ৫৪ শতাংশ শুল্ক উৎপাদন খরচ বাড়াবে। ফলে গাড়ির দাম বাড়বে, বিক্রি কমবে।
৪. ফোর্ড মেক্সিকোতে পিকআপ ট্রাক ও অন্যান্য গাড়ি তৈরি করে। ২৫ শতাংশ শুল্ক এবং চীন থেকে যন্ত্রাংশ আমদানির উপর ৫৪ শতাংশ শুল্ক খরচ বাড়াবে। ফোর্ডের ৬০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হতে পারে, যা তাদের গ্লোবাল রেভিনিউয়ের ৭৫ শতাংশ। ৫. নাইকি জুতো ও পোশাকের বেশিরভাগ উৎপাদন ৫০ শতাংশের বেশি ভিয়েতনাম আর চীনে হয়। ভিয়েতনামের উপর ৪৬ শতাংশ এবং চীনের উপর ৫৪ শতাংশ শুল্ক চাপানো হয়েছে, যা খরচ বাড়াবে। নাইকি দাম বাড়াতে বাধ্য হবে যেমন ১০০ ডলারের জুতো ১৪০ ডলারে বিক্রি করতে হতে পারে, যা বিক্রি কমাবেই। ৬. অ্যামাজন চীন, ভারত, এবং অন্যান্য দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করে আমেরিকাতে বিক্রি করে। তাদের ব্যবসা বিরাট মার খাবে ফলে অ্যামাজন হয় দাম বাড়াবে, যা গ্রাহকদের কম কেনার দিকে ঠেলবে, নয়তো লাভ কমাবে। ৭. টেসলা, ইলন মাস্কের টেসলা চীন থেকে ব্যাটারি ও যন্ত্রাংশ আমদানি করে এবং সাংহাই গিগাফ্যাক্টরি থেকে গাড়ি রফতানি করে। চীনের উপর ৫৪ শতাংশ শুল্ক এবং চীনের পাল্টা শুল্ক টেসলার ব্যবসাকে বিরাট ভাবেই আঘাত করবে। ইলন মাস্ক নিজেই ট্রাম্পকে শুল্ক তুলে নিতে বলেছেন, উনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন কী হতে চলেছে। ৮. প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল গৃহস্থালি পণ্য যেমন টয়লেট পেপার, ডিটারজেন্ট তৈরির জন্য কাঁচামাল চীন, মেক্সিকো, এবং কানাডা থেকে আসে। শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত খরচ বাড়াবে। আর দাম বাড়লে গ্রাহকরা সস্তা বিকল্প খুঁজতে পারে, যা বাজার শেয়ার কমাতেই পারে। মানে আটখানা বড় কোম্পানি বিরাট ঝাড়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু ট্রাম্পের তাতে কিছু যায় আসে না, তিনি হ্যা হ্যা করে হেসে বলেছেন যে আই অ্যাম অ্যা ট্যারিফ ম্যান। মানে শুল্ক বাড়ছেই, তাঁর উন্মাদনা এতটাই বেড়েছে যে তিনি জনমানব শূন্য দ্বীপপুঞ্জে ১০ শতাংশ শুল্ক বসানোর কথা ঘোষণা করেছেন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | শুভেন্দু অধিকারীর ২ কোটির হিসেবে গ্যামাক্সিন ছিটিয়ে দিল বাংলার মানুষ
বিশ্বাস হচ্ছে না? শুনুন তাহলে, ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্ক নীতিতে সত্যিই কিছু অদ্ভুত জায়গাকে টার্গেট করা হয়েছে, যার মধ্যে হার্ড এবং ম্যাকডোনাল্ড দ্বীপপুঞ্জও রয়েছে। এই দুটো ছোট্ট, দূরবর্তী অ্যান্টার্কটিক দ্বীপে কেবল পেঙ্গুইন আর সিল মাছ আছে, কোনও মানুষ থাকে না। দ্বীপগুলো অস্ট্রেলিয়ার অধীনে, পার্থ থেকে সাত দিনের নৌকাযাত্রায় পৌঁছানো যায়, আর গত প্রায় দশ বছরে সেখানে মানুষের পা পড়েনি। অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী ডন ফারেল বলেছেন, “বেচারা পেঙ্গুইন, জানি না তারা ট্রাম্পের কী করেছে! কিন্তু সত্যি বলতে, এটা দেখায় যে এই শুল্ক নীতিটা তাড়াহুড়ো করে তৈরি করা হয়েছে।” এটা পরিষ্কার পাগলামো, এই ঘটনা সত্যিই অবাক করার মতো। হার্ড এবং ম্যাকডোনাল্ড দ্বীপপুঞ্জে কোনও রফতানি বা বাণিজ্য নেই, তাই এখানে ১০ শতাংশ শুল্ক বসানোর যুক্তি কার মাথায়, কীভাবে এল? ট্রাম্প বলেছেন, আছে আছে সব আছে, পরে বলবেন। আমাদের মনে পড়ে যেতে বাধ্য সেই নোটবন্দির পাগলামির কথা, ২৪ ঘন্টার নোটিসে লকডাউনের কথা, থালা বাজানো বা মোমবাতি জ্বালিয়ে করোনা তাড়ানোর কথা। আর এই ট্যারিফ বাড়ানো নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং নরেন্দ্র মোদির দুজনেরই সিদ্ধান্তগুলো আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতের অর্থনীতির উপর বেজায় খারাপ এক প্রভাব ফেলবে, সেটা তো জানা কথা। আসুন দেখা যাক সেই প্রভাবগুলো কেমন আর কোথায় পড়বে। ট্রাম্পের আমদানির উপর শুল্ক চাপানো, যাকে ভুলভাবে শুদ্ধ বাংলায় একটা পারস্পরিক শুল্ক কর্মসূচি, রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ প্রোগ্রাম বলে বোঝানো হলেও আসলে তা এক ডিজাস্টার, সারা বিশ্বের বাজার পড়েছে, আমেরিকার বাজার তছনছ হয়েছে, ভারতের বাজারের কথা তো আপনারা জানেন, গত এক দিনেই ২০ লক্ষ কোটি টাকা উবে গেছে। অনেকেই বলছেন যে এটা কেবল একটা পারস্পরিক শুল্ক চাপানো নয়, বরং একটা পরিকল্পিত শাস্তির ফতোয়া।
আসলে দুনিয়ার বাণিজ্য ঘাটতির ভিত্তিতে একটা বড়সড় শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা ট্রাম্প সাহেব করেছেন, যা সারা দুনিয়ার বাজারে এক দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রে মন্দার হুমকি এবং স্ট্যাগফ্লেশন, সিবিএস নিউজের ট্রেড অ্যানালিস্ট জিল শ্লেসিঙ্গারের মতো মানুষজন ক’দিন আগে থেকেই সতর্ক করছিলেন যে, ট্রাম্পের শুল্কগুলো যদি কয়েক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বহাল থাকে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়বে এবং মন্দার দিকে যেতে পারে, যার ফলে দাম বাড়তে শুরু করবে এবং স্ট্যাগফ্লেশন দেখা দেবে। অনিশ্চয়তা এবং বাজারের অস্থিরতা: ট্রাম্পের বক্তব্য এবং প্রশাসনের সম্ভাব্য আলোচনা থেকে উঠে আসা যে ইঙ্গিত সেগুলোই সংকেতগুলি বাজারে উল্লেখযোগ্য অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছিল, যার ফলে এই বাজারের যথেষ্ট অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, মজার কথা হল সেই অনিশ্চয়তা কাটানোর বদলে ট্রাম্প সাহেব আরও নতুন করে বাজারের অস্থিরতা ডেকে আনছেন। বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার উপর প্রভাব: সারা বিশ্বে রাজনৈতিক নেতারা, বাণিজ্য বা অর্থনীতির মাথারা ট্রাম্পের শুল্ক ব্যবস্থাকে একটা ভূমিকম্পের মতো পরিবর্তন করার চেষ্টা বলেই চিহ্নিত করেছে, যা সাধারণ গ্লোবালাইজেশন, মুক্ত বাণিজ্যের দফারফা করেই ছাড়বে বলে মনে করছেন। রফতানি ও বাণিজ্য ভারসাম্যের উপর আঘাত: ট্রাম্পের শুল্ক ব্যবস্থা যদি স্থায়ী হয়, তবে ভারতের শুধু নয়, বিশ্বের বহু দেশের বাণিজ্য ভারসাম্যের উপর বড়সড়রকমের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পারে, আমাদের দেশের অ্যাগ্রো ইকনমির যে সাধারণ গ্রোথ এই ক বছরে হয়েছে, সেটাও মার খাবে। মোদ্দা কথা হল এক উন্মাদ আমেরিকার মাথায় বসে সারা বিশ্বের অর্থনীতির দুনিয়াকে বিপন্ন করে তুলেছে আর পাগলামি সেখানেই সীমাবদ্ধ নয়, আজ আমার কানাডা চাই, কাল পানামা চাই, পরশু গ্রিনল্যান্ড চাই গোছের কথাবার্তা অন্যদিকে এক যুদ্ধ উন্মাদনার জন্ম দিচ্ছে, এবং তারই সঙ্গে ইজরায়েলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে আবার নতুন করে রণাঙ্গন তৈরি করার একটা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প সাহেব যা আগামী দিনে আরও নতুন নতুন সমস্যার জন্ম দেবে।