একটু রিওয়াইন্ড বাটনটা টিপুন, কিছুটা পিছনের দিকে তাকান। কর্নাটকের ভোট এবং বিজেপির বিরাট হার। হ্যাঁ, সেদিনের কিছু কথা মনে করুন। কর্নাটকের সবচেয়ে কদ্দেবার, ওজনদার জনপ্রিয় নেতা ইয়েদুরিয়াপ্পাকে ভালো করেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে আপনার দিন শেষ, কিন্তু এক পদও দেওয়া হয়েছে যা ওনার কোনও কাজেই লাগবে না। কর্নাটকে বিজেপির প্রার্থী নির্বাচনের সময়েও ইয়েদুরিয়াপ্পাকে পাত্তা দেওয়া হয়নি। অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদি লবিই সেসবের দায়িত্বে ছিল। প্রচারে জনপ্রিয় লিঙ্গায়েত নেতা ইয়েদুরিয়াপ্পাকে সঙ্গে রাখলেও মুখ ছিলেন মোদিজি, সর্বত্র মোদিজি। আর প্রচারের বিষয় কমবেশি একইরকম, ডাবল ইঞ্জিন সরকার, কংগ্রেস হল ডাইনাস্টিক রুল, এক বংশানুক্রমিক শাসন আর বিরোধীদের, কংগ্রেসের দুর্নীতি। ফলাফল? সবার জানা বিজেপির বিরাট পরাজয়। এবারে ফাস্ট ফরোয়ার্ড বাটন টিপে আজকের রাজস্থান, তেলঙ্গানা, মধ্যপ্রদেশ আর ছত্তিশগড়ের দিকে তাকান। দেখবেন ছবিটা হুবহু এক। হুবহু। কেন? বিজেপি কি বুঝতে পারছে না যে তাদের নির্বাচন পরিকল্পনায় বিরাট ভুল হয়ে যাচ্ছে? বুঝতে পারছে না যে অতি ব্যবহারের ফলেই নরেন্দ্র মোদিজির ধার কমছে? বুঝতে পারছে না যে বিজেপি আশির দশকের কংগ্রেস হয়ে উঠছে? যেখানে হাইকমান্ডই শেষ কথা। না, ক্ষমতার এক স্তরে এসে ভুল বোঝা যায় না, অত্যন্ত ক্ষমতাশালীদের পতনের ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখুন, তাঁরা কেউ বুঝতে পারেননি যে ভুল হয়ে যাচ্ছে, বিরাট ভুল হয়ে যাচ্ছে। ধরুন হিটলার তাঁর সেনাধ্যক্ষদের কথা শুনে স্তালিনগ্রাদের দিকে হাত না বাড়িয়ে যদি মস্কোটাই দখল করতে এগিয়ে যেতেন, ৩০ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে আগে স্তালিনগ্রাদ পরে মস্কো দখলের সিদ্ধান্ত না নিতেন? গোটা যুদ্ধের ইতিহাস বদলে যেত।
ইন্দিরা গান্ধী যদি জরুরি অবস্থা জারি না করে এলাহাবাদ আদালতের রায়ের পরেই ফ্রেশ নির্বাচন ডেকে দিতেন? বুদ্ধ ভট্টাচার্য যদি বলতেন থাক সিঙ্গুর, থাক নন্দীগ্রাম, যখন মানুষ একমত হবেন, বিরোধীরা একমত হবেন, তখন এই প্রকল্পে হাত দেব। আসলে যে কোনও ক্ষমতার এক টক্সিসিটি আছে, এক বিষাক্ত প্রভাব আছে, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাবান মানুষজনদের সত্যিটা বুঝতেই দেয় না। বিজেপি আজ ক্ষমতার সেই বিষাক্ত নেশায় আচ্ছন্ন। কবে থেকে? এর শুরুয়াত কিন্তু বিজেপির জন্মলগ্ন থেকে নয়। কারণটা বিজেপির স্ট্রাকচার, তার সংগঠন আর কাজকর্মের ধারার মধ্যে লুকিয়ে আছে। এক আপাত সামাজিক সংগঠনের আড়ালে এক হিন্দু রাষ্ট্রবাদী, জঙ্গি জাতীয়তাবাদী সংগঠন আরএসএসই বিজেপির চালিকা শক্তি। আরএসএস-ই বিজেপিকে চালায়, বিজেপির সরকার থাকলেও তারা বহু প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তাঁদের অমতের কথা জানায়। অটলবিহারী বাজপেয়ী, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর বহু সিদ্ধান্তের সরাসরি বিরোধিতা করেছে আরএসএস। কিন্তু ২০১৪ থেকে সেই বিরোধিতার স্বর নেমেছে, পাঞ্চজন্য ইত্যাদি মুখপত্রে দু’ একটা লেখা ছাড়া বিরোধিতার স্বর গায়েব। এখন মোহন ভাগবত সরকার আর নরেন্দ্র মোদির দেখানো পথে, মোদিজির তৈরি করা স্লোগান নিয়েই চলছে। তাদের চোখের সামনে নিতিন গড়কড়ি বা বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া বা শিবরাজ সিং চৌহানদের অবজ্ঞা চলছে। আরএসএস-এর নেতারা ক্ষুব্ধ, অনেকেই বসে আছেন মোদি-মুক্ত বিজেপির জন্য। কিন্তু মোহন ভাগবত থেকে বড় নেতারা চুপ, কারণ জো জিতা ওহি সিকন্দর। মোদি জয় এনে দিচ্ছেন, মোদিজির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, কাজেই ওনার বিরোধিতা করা যাচ্ছে না। ওদিকে সেই চূড়ান্ত জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতার শীর্ষে বসা মানুষটি, তাঁর টিম ক্রমাগত ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েই যাচ্ছে। তাকিয়ে দেখুন চার রাজ্যের দিকে, রাজস্থানে বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া, মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ সিং চৌহান, ছত্তিশগড়ে রমন সিং, তেলঙ্গানায় বন্দি সঞ্জয় কুমার নির্বাচনের আসরে উপেক্ষিত। বসুন্ধরা ৭১, রমন সিং ৭০, শিবরাজ সিং তো ৬৪, ওনারা রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রিত্বের মুখ নন। কিন্তু মোদিজি ৭৩, বলেই দিয়েছেন ২০২৪-এও তাঁরই নেতৃত্বে সরকার আসছে। পাঁচ রাজ্যের মধ্যে ২ রাজ্য মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ে বিজেপি নিশ্চিত হারছে। মিজোরাম আর তেলঙ্গানাতে তাঁরা লড়াইয়ের বৃত্তের বাইরে। একমাত্র জয়ের সম্ভাবনা আছে রাজস্থানে।
চার রাজ্যের বিরাট হারের ৫ মাসের মধ্যেই লোকসভা নির্বাচন। এই হার নিয়েই নির্বাচনে আবার নামবেন সেই এক মানুষ, নরেন্দ্র মোদি। এবং এবারে কর্নাটক নির্বাচনের সময়কার ছবির সঙ্গে তুলনা করুন। একইভাবে রাজ্যের জনপ্রিয় মুখ উপেক্ষিত, একইভাবে প্রচারের মুখ নরেন্দ্র মোদি, একইভাবে নির্বাচনে প্রার্থী নির্বাচন হয়েছে দিল্লি থেকে। প্রচারের ইস্যুও এক। সেই ডাবল ইঞ্জিন সরকার যা এখন বিরাট প্রশ্নের মুখে। মণিপুর থেকে মহারাষ্ট্র বলে দিচ্ছে ডাবল ইঞ্জিন সরকারের চরম ব্যর্থতার কথা। সেই একই প্রচার ডায়নাস্টিক কংগ্রেসের, বংশানুক্রমিক শাসন, যেখানে বিজেপির প্রায় সব বড় নেতাদের ছেলেমেয়েরা দলের নেতা বনে বসেছে, বা অকারণে ক্ষমতার শীর্ষে বসে আছে। জয় শাহ কেন যে ক্রিকেট কমিটির মাথায় কেউ জানে না, সুষমা স্বরাজের মেয়ে কোন জাদুবলে মোদি সরকারের যাবতীয় বড় লিগ্যাল দায়িত্ব পাচ্ছেন এবং ক্রমশ দলেও জায়গা পাচ্ছেন, তার কারণও সব্বাই জানে। এবং করাপশনের যাবতীয় প্রচার মানুষের মনে দাগ কাটছে না কারণ এটা মানুষের কাছে পরিষ্কার যে বিজেপিতে দুর্নীতিগ্রস্তরা গেলে ছাড় পাচ্ছে। করাপশনের ৯৫ শতাংশ অভিযোগ কেবল বিরোধীদের দিকে। শুভেন্দু অধিকারী থেকে হিমন্ত বিশ্বশর্মা, অজিত পাওয়ার থেকে প্রফুল্ল প্যাটেলের করাপশনের কথা তো বিজেপি নেতারাই জানিয়েছেন। কাজেই আজ কেজরিওয়াল থেকে তেজস্বী যাদব থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হচ্ছে বটে, কিন্তু সে অভিযোগে মানুষ কতটা কান দেবে? তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। একতরফা অভিযোগের ফলে করাপশনের অস্ত্রেও জং ধরছে। অন্যদিকে কর্নাটক নির্বাচনের আগে ঠিক যেমনভাবে কংগ্রেসে যোগদানের হিড়িক পড়েছিল, ঠিক তেমনভাবেই মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানাতে বিজেপি ছেড়ে, বিআরএস ছেড়ে কংগ্রেসে যোগদানের পালা চলছে। রাজ্যের টেস্টেড জনপ্রিয় নেতাদের স্পেন্ট ফোর্স, ফুরিয়ে যাওয়া শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। হোক, কিন্তু চার রাজ্যে নির্বাচনে হারের পরে এই মামাজি মানে শিবরাজ সিং চৌহান বা রমন সিং বা বন্দি সঞ্জয় কুমারেরা দলের মধ্যে যে আক্রমণ শুরু করবেন তা সামলাতে পারবেন মোদিজি? তার উপরে থাকবেই আরএসএস-এর এক বিরাট অংশ, থাকবেন নিতিন গড়করি বা রাজনাথ সিংয়ের মতো নেতারা, যারা এখন বিপাকে পড়েই চুপ করে আছেন। ইন ফ্যাক্ট অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক মোদি-শাহ বিজেপির এই পরিবর্তন এনেছেন। যেখানে তাকিয়ে দেখুন অটল মন্ত্রিসভার একমাত্র রাজনাথ সিং ছাড়া বাকি সবাই বাইরে। আজকের বিজেপিই আরএসএস, কারণ আরএসএস-এর এক প্রচারক আজ ক্ষমতার শীর্ষে। হিন্দুত্বের নয়া পয়গাম আজ আর আরএসএস-এর কাছ থেকে আসছে না, তা নরেন্দ্র মোদি আর তাঁর সরকারই ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আরএসএস-এর নেতারা, বিজেপির পুরনো নেতারা জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে লড়েছেন, সত্যিই লড়েছেন। নরেন্দ্র মোদি নিজেকে সেই লড়াইয়ের অন্যতম যোদ্ধা হিসেবে দাঁড় করাতে চাইলেও তা ওনার প্ল্যাটফর্মহীন স্টেশনে চা বিক্রি বা স্কুল থেকে ফেরার পথে পুকুর থেকে কুমির ধরার মতোই এক অলীক কল্পনা। কিন্তু সেদিন যে বিজেপি বা আরএসএস নেতারা জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, তাঁরাই অবাক হয়ে দেখছেন গোটা দেশে নেমে এসেছে এক অঘোষিত জরুরি অবস্থা। সরকারের বিভিন্ন এজেন্সিকে কাজে লাগিয়ে বিরোধীদের জেলে পোরা হচ্ছে, তাঁরা কিছু বলতেও পারছেন না, কিন্তু সেই ক্ষোভ জমে থাকছে। একবার পতন শুরু হলে গোটা দেশে বিজেপি দফতরে নরেন্দ্র মোদির একটা ছবিও খুঁজে পাবেন না। আজ যেমন হিটলার এক ঘৃণ্য নাম, স্তালিনের নামও নেয় না রাশিয়ার মানুষজন, ইন্দিরার জরুরি অবস্থার কথা উঠলেই কংগ্রেস কুঁকড়িয়ে যায়, ঠিক সেইরকমই আজকের জো জিতা ওহি সিকন্দর নরেন্দ্র মোদিজি এক ভিলেন হয়ে উঠবেন।
একটা সবখোল চাবি আছে বলেই সব তালাই খোলা যাবে এমন চিন্তা এক বালখিল্য মনের কল্পনা, মানুষ ক্রমাগত ক্লান্ত হচ্ছে ওই মিত্রোঁ শুনতে শুনতে। ২০১৯-এর আগে উজ্জ্বলা যোজনা থেকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, বালাকোট, পুলওয়ামা ছিল, এই মুহূর্তে সেসব তো নেইই, উলটে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব নিয়ে নাজেহাল মানুষ কিন্তু হিন্দুরাষ্ট্র, মুসলিম বিদ্বেষ ইত্যাদির মতো বায়বীয় বিষয় থেকে মাথা ফেরাতে শুরু করেছে। চার রাজ্যের বিরাট হার নিয়ে দলের মধ্যে আর দলের বাইরে নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদিজি ক্রমশঃ চিন্তিত, শঙ্কিত এবং খেই হারাচ্ছেন। তার ছবিও স্পষ্ট, রাত পোহালে নির্বাচন, যে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর বিকাশের স্বার্থে আমাদের প্রধানমন্ত্রী গত ৯ বছরে ৬০ বার গেছেন, ধামসা বাজিয়েছেন, উত্তর পূর্বাঞ্চলের পোশাক আর টুপি পরেছেন, সেই হেন জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আগে মিজোরামে যাওয়ার সাহসও দেখাতে পারলেন না। কেন পারলেন না? কারণ মণিপুর এখনও জ্বলছে এবং এবারের মিজোরাম নির্বাচনে মণিপুর সবথেকে বড় ইস্যু আর মণিপুরের এখনও চলতে থাকা দাঙ্গা আর অশান্তি নিয়ে মোদিজির একটা কথাও বলার নেই। তিনি কেন? তাঁর উপচ্ছায়া অমিত শাহও যাওয়ার সাহস দেখাননি। নির্বাচন হয়ে যাক, এমনিতেও বিজেপি ওখানে একটাও আসন পাবে না, কাজেই মুখ পুড়িয়ে লাভ নেই, এক্কেবারে শেষে এসে এক ভার্চুয়াল বক্তৃতা দিয়েছেন, মজার কথা হল সেই বারো তেরো মিনিটের বক্তৃতাতে একবারের জন্যও মণিপুর শব্দটা আসেইনি। নির্বাচন চলছে, কিছুদিন আগেও যিনি বিভিন্ন অবিজেপি রাজ্য সরকারের ডায়রেক্ট বেনিফিট দেওয়ার প্রকল্পগুলোকে সমালোচনা করতেন তিনিই ৮০ কোটি মানুষকে আগামী ৫ বছর ফ্রিতে রেশন যেমন দেওয়া হচ্ছিল, তা বজায় রাখার কথা বললেন। জানিয়েই দিলেন যে করোনা শেষের পরেও এমন বিকাশ আর উন্নয়ন তিনি করেছেন যে দেশের ৮০ কোটি মানুষ এখনও ফ্রিতে রেশন না পেলে পেটের ভাত জোগাতে পারবে না। আসলে ভয় ঢুকেছে, ৬ রাজ্যের নির্বাচনে একমাত্র ভরসা রাজস্থান, সেটাও যায় যায়, এবং গেলে যাবে ওনার জন্যই।