এই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনের অনেকগুলো আলাদা আলাদা কারণে গুরুত্ব আছে। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে এই নির্বাচনের গুরুত্ব তো আছেই। কংগ্রেস কেমন ফল করবে তার উপর নির্ভর করবে আগামী দিনে বিজেপি বিরোধী জোটের ভবিষ্যৎ সেটাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। মোদি–শাহ মিলে বিজেপির যে হাইকমান্ড পলিটিক্সের শুরুয়াত করেছেন তা প্রশ্নের সামনে পড়বে যদি এই নির্বাচনে তারা গোহারান হারে। অন্তত মধ্যপ্রদেশ আর রাজস্থান যদি বিজেপি জিতে যায় তাহলে কিন্তু ওই হাইকমান্ড পলিটিক্সের ওপর সিলমোহর পড়বে। এগুলো তো আছেই, কিন্তু তার সঙ্গে এই নির্বাচনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আদিবাসী এলাকা আর তাদের মতামত। মিজোরাম, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় আর রাজস্থান, প্রত্যেকটা রাজ্যেই এক বিরাট সংখ্যক আদিবাসী ভোটার আছেন, তাঁরা কোন দিকে গেলেন এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আদিবাসীরা খ্রিস্টান হোক বা হিন্দু বা অন্য কোনও ধর্মের, তাদের এক সমভাবনা চালিত করে, এক আদিবাসী অন্য আদিবাসীর সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেখতে ভালোবাসে, তার আইডেন্টিটিকে নিজেদের এক বড় আইডেনটিটিতে মিলিয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর থেকেই আদিবাসীরা এইভাবেই প্রায় একভাবে ভোট দিয়ে আসছে, সে ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য যাই হোক না কেন, তাদের ভোট ছিল কংগ্রেসের দিকে। আর কে না জানে যে কংগ্রেস কালিদাস, যে ডালে বসে সে ডাল কাটতে তাদের ভারি মজা। তারা আদিবাসী, মুসলিম, দলিতদের ভোট টেকেন ফর গ্রান্টেড হিসেবেই নিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই কিছুদিন পর থেকে তাদের কাছ থেকে দলিত, আদিবাসী মুসলমানেরা আলাদা হতে থাকে, তারা তাদের আইডেনটিটি পলিটিক্স শুরু করে বা বিজেপির দিকে যায়।
স্বাধীনতার আগে ১৯৪৬-এ তখন মধ্যপ্রদেশ, এখনকার ছত্তিশগড়ের যশপুরে আরএসএস-এর উদ্যোগে শুরু হয়েছিল বনবাসী কল্যাণ সমিতি। তারা মূলত খ্রিস্টান ধর্মান্তরণকে ইস্যু করে মধ্যভারতের আদিবাসী এলাকা, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড অঞ্চল, অসম হয়ে উত্তর পূর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। একলব্য বিদ্যালয় খোলে, বিভিন্ন ধরনের আদিবাসী কল্যাণের সঙ্গেই হিন্দুত্বকে জুড়ে তাঁদের হিন্দু মূল স্রোতে আনার চেষ্টা চালিয়ে যায়। সবচেয়ে বেশি সফলতা এই মধ্যভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়াই ছিল না, জনসঙ্ঘের ভোটও বেড়েছিল ওই সময় থেকেই। তারপর যত দিন গেছে, কংগ্রেসের ক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গেই সমান্তরাল ভাবে বেড়ে উঠেছে এই বনবাসী কল্যাণ সমিতি, আরএসএস-এর শাখা চালু হয়েছে। কিন্তু তারা খ্রিস্টান মিশনারিদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি, সেসব মিশনারি স্কুলে পড়া মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের কাছে আধুনিক সমাজের জীবনযাত্রাই বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। তারা তাদের আদিবাসী সত্তাটাকেই গুরুত্ব দিয়েছে আর বছরের শেষে ক্রিসমাস। সবমিলিয়ে আদিবাসীদের অধ্যে যে আকর্ষণ আরএসএস জনসঙ্ঘ তৈরি করেছিল, তা কমতে থাকে। আরও কমে যখন আদিবাসীরা তাদের নিজেদের আইডেন্টিটি পলিটিক্স নিয়ে পৃথক রাজ্যের আন্দোলনে নামে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি আসার পরে সে ছবির এক পরিবর্তন আমরা দেখতে পারি, বা তার কিছু আগে থেকেই খ্রিস্টান বনাম হিন্দু লড়াইতে আদিবাসীদের বিজেপি শামিল করতে পেরেছিল। ওড়িশায় গ্রাহাম স্টেনের হত্যা বা ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগে খ্রিস্টান হিন্দু আদিবাসীদের সংঘর্ষ। এরই অধ্যে আবার আদিবাসীদের এক বিশাল এলাকা দখল নেয় মাওবাদীরা, বিজেপি আরও শক্তি হারায়। নরেন্দ্র মোদি আসার পরে সেই হারানো জমি পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু হয়।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদিজি হয়ে উঠেছেন সবখোল চাবি, কিন্তু কতদিন?
ছত্তিশগড়ে খুব একটা এগোতে না পারলেও, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড আর উত্তর পূর্বাঞ্চলে স্ট্রাটেজিক অ্যালায়েন্স-এর ফলে বিজেপি বেশ খানিকটা জমি দখল করে। কিন্তু মণিপুরের ঘটনা সব ইকুয়েশনকে গোলমালে ফেলে দিয়েছে। এই আদিবাসী সমর্থ যে তাঁদের বাড়াতে হবে সেটা বুঝেই দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়ে মোদি-শাহ তাঁদের রাজনৈতিক চালটা চেলেছিলেন। কিন্তু মণিপুর, তার বীভৎস জাতিদাঙ্গা, নারী ধর্ষণ এবং সবার ওপরে মোদিজির মৌনতা গোটা দেশের আদবাসী সমাজের উপরে এক প্রভাব ফেলেছে। কতটা প্রভাব? মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেতা এনডিএ-র শরিক জোরামথাঙ্গাকে প্রতিটি সভায় বলতে হচ্ছে, বিজেপির সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। ক’দিন আগের বিজেপি-এমএনএফ জোট ভেঙে খান খান। কতখানি খারাপ অবস্থা? প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একবারের জন্যও নির্বাচনী প্রচারে যেতে পারেননি, ৪০টা আসনে ৪০ জন প্রার্থী খুঁজে পাননি। কেন? কারণ তো মণিপুর, সেখানে বেমক্কা হিন্দু কার্ড খেলতে গিয়ে আমও গেছে, ছালাও যাবে। উত্তর পূর্বাঞ্চলে একমাত্র অসমেই এই মণিপুরের জাতিদাঙ্গা থেকে খানিক লাভ পেলেও পেতে পারে বিজেপি। বাকি জায়গায়? অরুণাচলে ২০ শতাংশ, মণিপুরে ৪১ শতাংশ, মিজোরাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ডে ৭৫ থেকে ৯০ শতাংশ খ্রিস্টান। এবং তাঁরা খালি খ্রিস্টান নয়, আদিবাসীও। ত্রিপুরাতে বিজেপির এবারের জয়ের পিছনে আছে আদিবাসী সংগঠন তিপ্রা মথার সমর্থন। এই মিজোরাম, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় আর রাজস্থানের আদিবাসী সমাজ যদি বিজেপির উপর থেকে সমর্থন তুলে নেয় তাহলে ২০২৪-এ মোদিজিকে গুজরাত ফিরে যেতে হবে। আর যদি এতকিছুর পরেও সেই সমর্থন থাকে, তাহলে হাজারটা ইন্ডিয়া জোট করেও মোদিজিকে হারানো যাবে না। অন্য দিক থেকে দেখুন, দক্ষিণ ভারতে বিজেপির ঘটি উল্টেছে, কেরল, তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, কর্নাটকে বিজেপি নেই, তেলঙ্গানাতে গোটা ৮ আসন পেলেও বিরাট পাওয়া হবে বলেই মনে করছে তেলঙ্গানার বিজেপি নেতারা।
দাক্ষিণাত্য বন্ধ, এবার যদি আদিবাসী ভোট ঘুরে যায় তাহলে বিজেপি টাল সামলাতে পারবে না। সেই কারণেই এই পাঁচ রাজ্যের মধ্যে মিজোরাম, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় আর রাজস্থানের আদিবাসী অঞ্চলের দিকে চোখ রয়েছে সবার। সেই নির্বাচনের প্রথম দিনে কী খবর এল? মিজোরামের ৪০টা আসনে নির্বাচন হয়েছে, এমএনএফ ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে, নাকি নতুন উঠে আসা জোরাম পিপলস ফ্রন্ট জিতবে? নাকি দুই মিজো সংগঠনের ভোট কাটাকাটির সুযোগে কংগ্রেস বাজিমাত করবে সেটা নিয়েই আলোচনা চলছিল। বিজেপি গতবারে একটা আসন জিতেছিল, এবারে একটাও জিতবে না। কিন্তু ভোটের প্রবণতা দেখে ওখান থেকে আমাদের বন্ধু সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন, স্পষ্ট রায় কিন্তু আসছে না। মানে এমএনএফ ১৫টার মতো আসন পাচ্ছে বাকি ২৫টা আসন জোরাম পিপলস ফ্রন্ট আর কংগ্রেসের মধ্যে ভাগাভাগি হবে। নির্বাচনের আগে মনে হয়েছিল কংগ্রেস অন্তত ১৭-১৮টা আসন পাবে, এখন দেখা যাচ্ছে কংগ্রেস সাকুল্যে ১০-১১টা আসন আর জোরাম পিপলস পার্টি ১৩-১৪টা আসন পেতে চলেছে। যদি তাই হয় তাহলে কংগ্রেসের হাত ধরেই এক মিলিজুলি সরকার হতে চলেছে। বিজেপির কাছে এটা নিঃসন্দেহে বাজে খবর। ভোটের বাক্স খোলার অপেক্ষায় থাকতে হবে তবে গতকালের নির্বাচনে মিজোরামে কোনও একটা দলের সরকার তৈরি হচ্ছে না। এবারে চলুন ছত্তিশগড়ে, ভোট হয়েছে ২০টা আসনে এরমধ্যে ১১টা আসন শিডিউল ট্রাইব বা আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত। যে অঞ্চলে ভোট হয়েছে সেগুলো হল বাস্তার, রাজনন্দনগাঁও, দান্তেওয়ারা, গোন্ডা, চিত্রকূট ইত্যাদি। নামগুলো মনে পড়বেই কারণ এটা আদিবাসী অঞ্চল আর এইসব এলাকায় মাওয়িস্টরা একসময় রাজত্ব করত, এখন তারা খানিক পিছিয়েছে। কিন্তু তার পরেও গতকাল বেশ কয়েক জায়গায় ভোট বয়কট হয়েছে, কিছু জায়গায় পুলিশ সিআরপিএফ-মাওবাদী সংঘর্ষ। এই এলাকায় কেবল নকশাল নয় একসময় বামপন্থীদেরও বড় সংগঠন ছিল দল্লি রাজহারা অঞ্চলে সংঘর্ষ আউর নির্মাণের স্লোগান দিয়ে শঙ্কর গুহনিয়োগী এক বিরাট আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সে যাই হোক, এই ২০টা আসনের ১৭টাই কংগ্রেস জিতেছিল গতবার। রাজনন্দনগাঁও অঞ্চলের ডোংগারগাঁও বিধানসভা থেকে জিতেছিলেন রমন সিং, আর দান্তেওয়াড়াতে বিজেপির প্রার্থী জিতেছিলেন, খৈরাগড় থেকে জিতেছিলেন কংগ্রেস ছেড়ে বের হওয়া অজিত যোগী, যোগী ছত্তিশগড় কংগ্রেস আর বাকি আসনে কংগ্রেস। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে যা খবর এসেছে তাতে ছবি কিন্তু প্রায় একইরকম। রমন সিং নিজের আসন বাঁচাবেন, খৈরাগড়েও কংগ্রেস জিতবে। কাজেই এই আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে কংগ্রেস তাদের শক্তি ধরে রাখছে এবং বিজেপি কিছুই করে উঠতে পারছে না। ইভিএম খোলার পরেও আমরা আজ যা বলছি তা যদি মিলে যায় তাহলে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের আদিবাসী আসনেও বিজেপি হারবে। দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি করা হল, তাঁকে নতুন সংসদ ভাবন উদ্বোধনে ডাকা হল না, প্রথম অধিবেশনেও ডাকা হল না। কারণ তিনি এলে আর্ক ল্যাম্পের সব আলো গিয়ে পড়ত তাঁর মুখে, প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতির মুখে, আদতে লাভ হত বিজেপির। কিন্তু সেদিন ওই প্রচারের আলো সবটা শুষে নেওয়ার জন্যেই মোদিজি রাষ্ট্রপতিকে সেদিন ডাকেননি। মণিপুরে হিন্দু ভোট জড়ো করার জন্যই পরিকল্পিত দাঙ্গা লাগানো হয়েছে, কর্পোরেটদের হাতে জল জঙ্গল জমি বেচে দিয়ে মোদিজি নিজের গদি বাঁচাতে চেয়েছেন। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে সেই আদিবাসীরা আসলে বিজেপির কাছ থেকে সরে গেছে। এই নির্বাচন সেই সত্যিটাকেই সামনে তুলে ধরবে। দক্ষিণ গেছে, আদিবাসী ভোট এবং এলাকা যাবে, কেবল রামলালা কি মোদিজিকে ২০২৪-এ বাঁচাতে পারবে?