মমতা চার দিন অপেক্ষা করেছেন, ধৈর্য দেখিয়েছেন, চূড়ান্ত ধৈর্য, তারপর বৈঠক হয়েছে এবং উনি প্রায় সমস্ত দাবি মেনে নিয়েছেন। পুলিশ কমিশনার থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য কর্তাদের পদ থেকে সরানোর কথা বলেছেন, এ নিয়ে কোনও তর্কবিতর্কও হয়নি, উনি ঠিকই করে রেখেছিলেন, এটা উনি করবেন। এই মহিলাকে জোর করে কিছু করানো প্রায় অসম্ভব, উনি না মনে করলে এগুলো করতেন না। এবং কেবল করেননি, রাতেই সাংবাদিকদের ডেকে তা ঘোষণাও করে দিয়েছেন, জুনিয়র ডাক্তারেরা কালীঘাট থেকে স্বাস্থ্য ভবনের সামনে ধরনাস্থলে পৌঁছনোর আগেই তিনি রাজ্যের মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন। এবং রাজ্যের মানুষ এটাও দেখলেন যে বেলা চারটে পর্যন্ত জুনিয়র ডাক্তারেরা এসব হওয়ার পরেও তাঁদের কাজে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তও ঘোষণা করে উঠতে পারলেন না। বোঝা হেল যে অত্যন্ত অপরিণত এক নেতৃত্ব যাঁদের না আছে ভরসা নিজেদের সংগঠনের অন্য ডাক্তারদের উপর, না আছে ভরসা মানুষের উপর, না আছে ভরসা তাঁদের সংগঠনের শক্তি সামর্থ্যের উপর। আবার মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঝিনচ্যাক নৃত্যও হয়ে গেল ওই শোকাহত মঞ্চের এক পাশেই। সেই নাচের এক কুঁচো ছবি রইল। এদিকে গত ছ সাত দিনে আন্দোলন বলতে তো বেঁচে ছিল এই জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন, তাকে ঘিরেই সিভিল সোসাইটির কিছু মানুষের পথে অবস্থান বা মিছিল। জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফিরে যাওয়ার পরে যে শূন্যস্থান ভরাট করার মতো কোনও আন্দোলন নেই, ইন ফ্যাক্ট ইস্যুটাই বা কী? বিচার তো নিয়েই নিয়েছে নিজের গতিপথ, শুরু হয়ে গেছে তার সেই দীর্ঘসূত্রিতা, সে এখন পাত্রাধারে তৈল না কি তৈলাধারে পাত্র নিয়ে চুলচেড়া গোয়েন্দাপনা জানাবে এবং আজ বলছি মিলিয়ে নেবেন খুব তাড়াতাড়ি হলে বছর দেড়েক পরে সেদিন যা যা বলেছিলাম, তার ভিত্তিতেই ওই সঞ্জয় রায় দোষী সাব্যস্ত হবে। তখন আবার ক’দিন খুব আমোদ প্রমোদের সময় না হলে সেই সঞ্জয়ের ফাঁসিতে কিছু মিটিং মিছিল হতে পারে।
তাহলে দাঁড়ালটা কী? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর সরকার ২০১১-র পর থেকে এই প্রথম তাদের সবথেকে বড় ফাঁড়া, সবথেকে বড় বিপদটা কাটিয়ে উঠতে পারলেন, প্রথম এবং প্রধান অভিনন্দন প্রাপ্য বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের। এই মামলা সিবিআই-এর কাছে না গেলে, চোখ বন্ধ করে দেখুন অবস্থাটা কী হত। তখন তো আর বলাই যেত না যে ভাইসকল, তদন্ত সিবিআই-এর হাতে, নজরদার সুপ্রিম কোর্ট, কাজেই শুধায়ো না মোরে শুধায়ো না। বরং মিছিলের পর মিছিল আছড়ে পড়তে পারত যে এই খুন ধর্ষণের জন্য অমুক অমুককে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না, উনি উনি বা উনি কেন পদত্যগ করতে পারছেন না? ঠিক যেমনটা হয়েছিল ২০০৭-এ, নন্দীগ্রাম সিঙ্গুরের সময়ে, সেরকম একটা কেয়স শুরু হয়ে যেত। এবং এই মামলা, প্রতিবাদ ইত্যাদি ছড়াল, কিন্তু ছড়াল কেবল শহর আর শহরতলিতে। কাজেই মমতার ভোটব্যাঙ্ক অটুট রইল, আর যেটুকুও বা হারাতে বসেছিলেন, সেটাও ভাগাভাগি হয়ে গেল। জুনিয়র ডাক্তারেরা কী পেলেন? ৩৪ দিনের আন্দোলনের শেষে কিছু আশ্বাস, আর যাঁকে শিরদাঁড়া দিয়ে এসেছিলেন, তাঁর ট্রান্সফার। মাথায় রাখুন সাসপেনশনও শাস্তি নয়, আর এ তো ট্রান্সফার। তাঁরা পেলেন শহুরে মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত মানুষের এক বড় অংশের সমর্থন, যাঁরা কেবল তাঁদের ট্যালেন্ট, সুপ্ত প্রতিভা দেখাতেই, নাচ গান আবৃত্তি শুনিয়েছেন, মিছিলে হেঁটেছেন, ফোন পে-তে টাকা পাঠিয়েছেন। যাঁদের পেটভরা খিদে আর মাথাভরা চিন্তা নেই, সেই তাঁদের সমর্থন পেয়েছেন, জুনিয়র ডক্টররা খেয়াল করলেন না তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছেন এক বিরাট সংখ্যক সাধারণ গরিব মানুষ যাঁদেরকে বোঝানো হয়েছে যে ওই ডাক্তারবাবুরা তাঁদের চিকিৎসা করেননি, দিদি তাঁদের বাবা বাছা করে কাজে ফেরালেন। মানে জুনিয়র ডাক্তারেরা এরপর বহুবার শুনবেন যে আপনারা তো মানুষের চিকিৎসাই করেন না, হ্যাঁ এই প্রচারটা মমতা সফলভাবে করতে বা করাতে পেরেছেন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | আরজি কর তদন্ত, ধোঁয়াশা কোথায়? ধোঁয়াশা কেন?
সিভিল সোসাইটি কী পেল? জেলা বা প্রত্যন্ত এলাকার আম আদমি, প্রান্তিক মানুষ সঙ্গে না থাকলেও তাঁদের ডাকে লক্ষ লক্ষ নাগরিক মানুষ পথে নামতে পারে, সরকার নড়েচড়ে বসতে পারে, প্রশাসন নড়েচড়ে বসতেই পারে। মোটের উপর এই ঘটনাতে নতুন করে আবার বিরাট কোনও ভূমিকা না থাকলেও, এরপরে এরকম ঘটনাতে কিন্তু এই বদলের গান থাকবে। সিভিল সোসাইটি একটা পথ খুঁজে পেল, রাজনৈতিক দল নয়, তারাও এরপর থেকে আন্দোলনের ডাক দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করল। পুলিশ আর আমলা বুঝল, যে কোনও সময়ে সিবিআই ধরতে পারে, যে কোনও আদেশ বিনা প্রশ্নে মেনে চললে তা নিয়ে ভুগতে হতে পারে। একটা ধর্ষণ আর খুন যদি দু’জন আইপিএস অফিসারের ট্রান্সফার আর একজন ওসির গ্রেফতারের কারণ হতে পারে তাহলে এরপর থেকে তাদেরও প্রিকশন নিতে হবে, নিজের পিছন বাঁচিয়েই কাজ করা শিখে নেওয়ার কথাই ভাববেন পুলিশ আমলারা। সাংবাদিক বা বলা ভালো সংবাদ মাধ্যম বুঝল মিথ্যে আর ফেক নিউজে টিআরপি বাড়ে, কাজেই এরপর এরকম বহু ঘটনাতেই দেখবে যে, কাউকে দিয়ে কিছু বলিয়ে নিয়ে এই ভিডিওর সত্যতা আমরা যাচাই করে দেখিনি বলেও চালানো যায় এবং সে সবের ফলে টিআরপি বাড়ে। কাজেই এবারে যে মিথ্যের চাষ হল, তা এরপরের কোনও ঘটনাতে দুগুণ তিনগুণ হতেই পারে। পাবলিককে যা খাওয়ালে পাবলিক উত্তেজিত হয়, সেটা দেখিয়েই টিআরপি তোলার সহজ পথটা পেয়ে গেল মিডিয়া। সাংবাদিকদের অনেকেই নিজেদের অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে, এক প্রতিবাদী মানুষ হিসেবে প্রজেক্ট করার সুযোগ পেলেন, বড়সড় সামাজিক আন্দোলনের সময় এটা হয়েই থাকে। সংবাদপত্রের মালিক বা সংবাদমাধ্যমের মালিকরা অবশ্য হিসেব কষছেন, এমনিতে ধরুন ওই পুজোসংখ্যা ইত্যাদির বিজ্ঞাপন এসেছে, এই আন্দোলনের সময় টিআরপি ইত্যাদিও বেড়েছে কিন্তু এবারে পুজোর ব্যবসাটা কি মার খেল সেরকম একটা চিন্তা তাঁদের মাথায় ঘুরছে, খুব তাড়াতাড়ি উৎসব মোডে ফিরে আসাটা তাঁদের কাছে খুব জরুরি।
সিপিএম খানিক গা ঝাড়া দিয়েই উঠেছিল বটে কিন্তু বকলমে লড়াই আর নিজেদের সংগঠন নিয়ে লড়াই সবকিছু করার পরে এক্কেবারে কোর সাপোর্ট, একান্ত আপন সমর্থনভূমির বাইরে কি সেরকম কিছু পেলেন? এবং শেষপাতে এসে কলতানের মামলা অত্যন্ত গোলমেলে জায়গাতে ঠেলে দিল তাঁদেরকে এখন দেখার সেই ঘটনা থেকে তাঁরা বের হন কীভাবে বা আদৌ বের হতে পারবেন কি না। এবং বিজেপি হাতে পেনসিল মুখে বুড়ো আঙুল, এই সেদিনেও ছেলের বিরুদ্ধে যৌন লাঞ্ছনার অভিযোগ সামলাতে ব্যতিব্যস্ত মিঠুন চক্রবর্তীকে বাজারে নামানোর পরেও বিজেপির বাজার যেই কে সেই। আসলে তাঁদের গুণে নুন দেওয়ারও জায়গা নেই, এত ধরনের বিচিত্র ধর্ষণ, মহিলা নির্যাতন ইত্যাদির মামলা বিজেপির বিরুদ্ধে আছে যে একটা অভিযোগ করার আগে দশটা অভিযোগ তাঁদের বিরুদ্ধে এসে হাজির হয়। তারপরে বকলমে নবান্ন অভিযান বা বাংলা বনধ সুপার ডুপার ফ্লপ, সব মিলিয়ে এত বড় হলচল থেকে বিজেপির প্রাপ্তি বিগ জিরো। কিন্তু সব্বাই কিছু না কিছু তো পেলেন, কিছু না পেলেও অগ্নিমিত্রা পোল বা অভিজিৎ গাঙ্গুলি অন্তত গো ব্যাক গো ব্যাক খ্যাদানোর ধ্বনি তো পেলেন। কিন্তু সেই দু’জন? যাঁদের সন্তান ধর্ষিতা হলেন, নৃশংসভাবে খুন হলেন, আশ্বিনের শারদপ্রাতে বসে তাঁরা হঠাৎই দেখবেন তাঁদের গেছে, সবটাই গেছে, হঠাৎই তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে করতালি আর সমবেদনা মাখা মানুষের জমায়েতে, সেখানে কিছু বলেছেন তাঁরা কিন্তু পাওয়া তো দূরস্থান আরও আরও অনেক কিছু হারিয়েছেন তাঁরা, প্রতিদিন অজস্র মিথ্যে আর অজস্র অকথা কুকথায় ভরেছে আকাশ। প্রতিদিন পাত্রাধারে তৈল না তৈলাধারে পাত্রের লড়াইয়ের মাঝখান দিয়ে অন্তত তাঁরা তো বুঝতেই পেরেছেন দূরে দূরে সরে যাচ্ছে ন্যায় বিচারের নৌকো। কবে আসবে সেই অধরা বিচার জানা নেই, আরও একদিন শুনানি শেষ হল, সেখানে সিসিটিভির হিসেব, সেখানে ডাক্তারবাবুদের নতুন টয়লেট আর রেস্টরুমের হিসেব নিয়ে বিস্তর কথা হল, কিন্তু তাঁরা তো মনে করেছিলেন সেখানে বের হয়ে আসবে খুনি বা খুনি ধর্ষকদের নাম, তা তো আসছে না। আত্মজাকে হারিয়ে দুটো মানুষের তো সেটাই আপাতত চাহিদা, সে চাহিদা মিটে গেলেও পড়ে থাকবে শূন্যতা। হ্যাঁ সব্বাই কিছু না কিছু তো পেল, ওঁরা সত্যিই থেকে গেলেন না পাওয়ার দলে।