এর আগে একদিন দেখিয়েছিলাম, আজ আবার ছবিটা দেখাচ্ছি আবার দেখুন। তিনজন মহিলা তিনজন শিশুর, জিরিবামে এক রিলিফ ক্যাম্প জ্বালিয়ে দেয় দুষ্কৃতীরা, তার আগে একজন মহিলাকে ধর্ষণ করে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়। তারপর থেকে এঁরা নিখোঁজ ছিল। এঁদের লাশ পাওয়া গেছে, ভাবুন আড়াই মাসের শিশুসন্তান, সে মারা গেল জাতিদাঙ্গায়। মোদিজি মহারাষ্ট্রে জ্ঞান ঝাড়ছেন, এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়। এই ৬ জন মেইতেই হিন্দু, রিলিফ ক্যাম্পে একসঙ্গেই ছিলেন। এঁদের মৃত্যুর খবর ওনার কাছে গেছে কি না জানি না কারণ উনি ব্রাজিলে চলে গেছেন, পৃথিবীর ক্ষুধা আর দারিদ্র নিয়ে কথা বলতে। এধারে মণিপুর জ্বলছে, আক্ষরিক অর্থে। রাজ্যের দুজন মন্ত্রী তাদের বাড়ির সামনে বাঙ্কার তৈরি করেছেন, অস্ত্রশস্ত্র মজুদ করেছেন, ২৪ ঘণ্টা পাহারা দিচ্ছে সিকিউরিটি গার্ডরা, পুলিশ নয়, পুলিশের ওপর মন্ত্রীদের ভরসা নেই। মুখ্যমন্ত্রী বৈঠক ডাকছেন, সেই বৈঠকে হাজির নেই জনা ২০ বিধায়ক, অন্য দলের নয়, বিজেপির বিধায়করা হাজির নেই, এনপিপি-র ৭ জন বিধায়ক লিখিতভাবেই তাদের সমর্থন তুলে নিয়েছে। কিন্তু কেউ নেই কিচ্ছু বলার। অমিত শাহ সেনাবাহিনী পাঠিয়েই চলেছেন, সবাই জানেন এ এক সামাজিক রাজনৈতিক সমস্যা, দেশের মধ্যে এক প্রান্তে জাতিদাঙ্গা, সেনাবাহিনী পাঠিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না, আলোচনা চাই, বৈঠক চাই, এবং এখনই রাজ্য প্রশাসনকে নতুন ভাবে সাজানো দরকার। বীরেন সিংয়ের উপরে মানুষের কেন তাঁর দলের লোকজনদের বিশ্বাস নেই কিন্তু কোথায় কী? সেই এক বীরেন সিংয়ের উপর ভরসা করে বসে আছে দিল্লি, মণিপুরে নতুন করে জাতিদাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়ছে নতুন নতুন জায়গাতে। মানুষের লাশ, রক্ত, কান্না আর ঘেন্নার পাহাড়ের উপর বসে মোদি–শাহ রাজনীতি করেই যাচ্ছেন। মোদিজি, বা এই বিজেপি সরকার মণিপুর নিয়ে কথা বলতে রাজি নন কেন? কেন ডাকছেন না সর্বদলীয় বৈঠক? মণিপুরে যা ঘটেছে, যা ঘটছে তা এক জাতিদাঙ্গা, ধর্মকেও কাজে লাগানো হয়েছে। বিজেপির এক সুপরিকল্পিত চক্রান্তের পরেই এই দাঙ্গা শুরু হয়েছে, এন বীরেন সিংয়ের সরকার মনে করেছিল যে দাঙ্গা কিছুদিন চলুক, মেইতেই, কুকি, জো, হিন্দু বৈষ্ণব, খ্রিস্টান, মুসলমান বিভাজনটা পরিষ্কার হোক, সংখ্যাগুরু মেইতেইদের সমর্থন তো আমাদের হাতেই থাকবে, ওদিকে কুকি আর জো বা রাজ্যের মুসলমানরা তো এক জায়গায় আসবে না, কাজেই ওই ৪১-৪২ শতাংশ মেইতেইদের সমর্থন পেলেই ভবিষ্যৎ ফুরফুরে।
কিন্তু সে দাঙ্গা সামাল দেওয়া যায়নি, দেওয়া যায় না, কারণ অত ছোট রাজ্য হলেও উপজাতিরা ওয়ারিয়র ক্লাস, যোদ্ধা জাতি, পাশে মায়ানমার বর্ডার, বাংলাদেশ বর্ডার থেকে অস্ত্রের জোগান আছে, মারলে পাল্টা মারও আসবে, এটা ভেবে উঠতে পারেনি এন বীরেন সিং সরকার। এসেছে, এবং এখনও সেই আগুন নেভানো যাচ্ছে না, মণিপুরে ঠিক কার শাসন চলছে তাও আমাদের জানা নেই। মধ্যে বলা হয়েছিল, ৩৫৫ ধারা অনুযায়ী একজন সামরিক প্রশাসককে বসানো হয়েছে, যাঁর নেতৃত্বে আইন শৃঙ্খলার দেখরেখ চলবে। কিছুদিন পরেই মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করেই জানিয়ে দিয়েছেন আইন শৃঙ্খলা তাঁর হাতেই আছে। সেনাবাহিনী আনা হয়েছে, তাঁরা কোন রেজিমেন্ট, কোন জাতির, সেসব তথ্য আগেই ফাঁস হয়ে গেছে, স্বাধীন ভারতবর্ষে এই ঘটনা এই প্রথম, সেনাবাহিনীর কমান্ডার, তার নাম জাতি প্রকাশ্যে আসার কোনও ঘটনা আজও ঘটেনি, মণিপুরে সেটা ঘটল। এর থেকে এটা অন্তত পরিষ্কার যে কেবল রাজ্য সরকার নয়, মোদি-শাহের সরকারও এই দাঙ্গার জন্য সমান দায়ী। পুলিশের আর্মারি লুঠ হল, অটোরিকশা ভাড়া করে আর্মস অ্যামুনেশন নিয়ে চলে গেল দুষ্কৃতীরা, বিনা বাধায়, একজনও পুলিশ গুলিই চালায়নি। বিজেপির বিধায়কদের মধ্যে ৮ জন কুকি উপজাতির সদস্য আছে, তাদের মধ্যে একজন ভুঞ্জাগিন ভালতেকে রাস্তায় রড দিয়ে পেটানো হয়েছে, তারপর তাকে স্থানীয় এক ক্লাবে নিয়ে গিয়ে ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া হয়েছে। তিনি কথা বলার মতো অবস্থায় নেই, তাঁর স্ত্রী বলছেন, উনি একদিনও ছুটি নিতেন না, এখন অখণ্ড ছুটিতেই আছেন, বিছানায় শুয়ে আছেন, কথাও বলতে পারছেন না। ওনারা অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করে অপরাধীদের গ্রেফতার করতে বলেছিলেন, সেখান থেকে কোনও জবাব পাননি। এন বীরেন সিং একবার ফোন করেছিলেন, তারপর থেকে আর ফোন করেননি, ওনার স্ত্রী মিডিয়ার সামনেই বীরেন সিংয়ের পদত্যাগ চেয়েছেন। বাকি সাতজন বিজেপি নেতৃত্বের কাছে এন বীরেন সিংয়ের পদত্যাগ চেয়েছেন। বৈঠক ডাকলেও বিজেপির এই বিধায়করা বীরেন সিংয়ের সঙ্গে আলোচনাতেই আসতে রাজি নন। কার্গিলে লড়েছেন যে সৈনিক, সেই সৈনিকের স্ত্রীকে নগ্ন করে প্যারেড করানো হয়েছে, ধর্ষণ করা হয়েছে, সেই সৈনিক বলেছেন, আমি আমার দেশকে রক্ষা করেছি, পরিবারকে রক্ষা করতে পারলাম না। এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর আশি ঊর্ধ্ব বিধবা স্ত্রীকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। কিন্তু আমাদের তথাকথিত দেশপ্রেমিক নরেন্দ্র মোদি এসব নিয়ে মুখ খোলেননি, তাঁর মুখ খোলানোর জন্যই এই অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছিল।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | রাত পোহালে ভোট, ঝাড়খণ্ড আর মহারাষ্ট্রে কারা আসবে ক্ষমতায়?
এদেশে ভয়ঙ্কর জাতিদাঙ্গা, ধর্মের ভিত্তিতে দাঙ্গা হয়নি তা তো নয়। অসমে বঙাল খেদাও হয়েছে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাতেই হয়েছে। হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। তার আগুন আজও নিভেছে? না, জাতিদাঙ্গার আগুন সহজে নেভে না। কিন্তু এই দাঙ্গা নিয়ে বহু পরে হলেও কংগ্রেস থেকে অসম গণ পরিষদ নেতারা দুঃখপ্রকাশ করেছেন, ক্ষমা চেয়েছেন। শিখ নিধন যজ্ঞ চলেছিল দিল্লিতে, বহু পরে হলেও কংগ্রেস দল, নেত্রী সোনিয়া গান্ধী ক্ষমা চেয়েছেন, ঘা শুকিয়েছে? না, ভেতরে ভেতরে সে আগুন আছে, সময় হলেই তা বার হবে। কাশ্মীরে কাশ্মীরি ব্রাহ্মণদের ক্লিনজিং, আজও, এমনকী বিজেপি যারা নাকি এই ইস্যু নিয়ে প্রবল চিন্তিত, তাদের ৯ বছরের প্রবল রাজত্বের পরে ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়ার পরেও একজন কাশ্মীরি ব্রাহ্মণকেও ফেরানো যায়নি, এ ঘা শুকোবার নয়। কিন্তু এমনকী বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চিহ্নিত কাশ্মীরি নেতারা বা মেন স্ট্রিমের ফারুক আবদুল্লার ন্যাশনাল কনফারেন্স বা মেহবুবা মুফতির পিডিপি ক্ষমা চেয়েছে, দুঃখপ্রকাশ করেছে। ২০০২-এর গুজরাটের স্টেট স্পনসর্ড রায়ট। ১১০০-র বেশি মানুষ খুন হয়েছেন, বাড়ি জ্বলেছে অসংখ্য, জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে প্রাক্তন সাংসদকে, ধর্ষিতা হয়েছেন অসংখ্য মহিলা, কিন্তু না, এই দাঙ্গার জন্য একবারও দুঃখপ্রকাশ করেননি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বরং জাস্টিফাই করেছেন, গোধরায় হিন্দু তীর্থযাত্রীদের ট্রেনের কামরায় পুড়িয়ে মারার প্রতিক্রিয়া এই গুজরাটের দাঙ্গা এমনটা বহুবার বলেছেন, না মামলা দায়ের হয়নি, হলেও তা তুলে নেওয়া হয়েছে, সঠিক সময়ে মিলিটারি ডিপ্লয় করা হয়নি। এমনকী যাদের বিরুদ্ধে এই দাঙ্গা লাগানোর অভিযোগ তারা প্রায় প্রত্যেকে একে একে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে, প্রমাণের অভাবে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আজ সেই ঘটনার সমর্থনে ফিল্ম এসেছে বাজারে, ফ্যাসিস্ট প্রোপাগান্ডা। বিলকিস বানোর যে মামলায় ধর্ষকদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, তাদের সাজা কমিয়ে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, আবার আদালতের হস্তক্ষেপে সেই পশুরা জেলে। কিন্তু এই বিরাট দাঙ্গার জন্য না নরেন্দ্র মোদি না বিজেপি, কেউ ক্ষমা চায়নি, দাঙ্গা নিয়ে সব থেকে কটু কথা কে বলেছেন? অটলবিহারী বাজপেয়ী। কী বলেছেন? তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে বলেছিলেন, রাজধর্ম পালন করো। ব্যস, এই পর্যন্তই। এই দাঙ্গার রক্ত লেগে আছে মোদি-শাহের হাতে। এবং এ নিয়ে মোদিজী কতটা সেনসেটিভ?
তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি বিবিসির ডকুমেন্টারি রিলিজের সময়ে, ২০০২-এর দাঙ্গা, ডকুমেন্টারি রিলিজ হচ্ছে ২০২২-এ, কিন্তু তাকে আটকানোর জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করলেন মোদি-শাহ। বিবিসির ঘরে রেডও হয়ে গেল, এমন নয় যে রেডের বিষয় ২০২২-এ তৈরি হয়েছে, যা নিয়ে রেড তা ২০১৯-এও করাই যেত। ফেলে রেখে দিয়েছিলেন, ডকুমেন্টারি বন্ধ করা গেল না, রেড হল। আজ মণিপুরের এই ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী মুখ খুললেই সেদিনের অতীত বেরিয়ে আসবে, সেদিন যে রক্ত লেগেছিল হাতে সে রক্তের দাগ তো মোছা যায়নি, তা আরও গাঢ় হয়ে বসবে মণিপুরের ঘটনায় মুখ খুললে। এই পৃথিবীতে অপরাধ করলে তার বিচার অন্য কোথাও হয়? অনেকে তা বিশ্বাস করেন, আমি করি না, এই পৃথিবীতেই তার বিচার চলতে থাকে। যে রক্তাক্ত অধ্যায়ের জন্য দায়ী আমাদের প্রধানমন্ত্রী, সেই মৃত্যু, সেই ধর্ষণ তাঁকে তাড়া করে বেড়াবেই, পিছু ছাড়বে না। মিথ্যে বলেছিলেন, নিজের বিবাহিত স্ত্রীর নাম লুকিয়ে রেখেছিলেন, সে সত্যি সামনে এবং সেই লজ্জা তাঁকে বিদ্ধ করে প্রতিদিন, প্রতিবার নমিনেশন ফাইলের আগে সেই লুকিয়ে রাখা নাম তাঁকে লিখতে হয়। আজও সেই রক্তমাখা হাতের দিকে তাকান না মোদিজি? সেই রক্তাক্ত ইতিহাস মনে পড়েই না? মনে পড়ে বলেই তিনি এন বীরেন সিং সরকারকে ফেলে দিতে পারেন না, মণিপুর নিয়ে কথা বলতে পারেন না, বলতে চান না। সেই ম্যাকবেথ, ডানকানের রাজার রক্তমাখা হাতের দিকে তাকাচ্ছেন লেডি ম্যাকবেথ, শিউরে শিউরে উঠছেন, ঘুমের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে সেই হত্যার কথাই বলছেন। ম্যাকবেথও বুঝতে পারছেন, পাপ বাপকেও ছাড়ে না, তিনি বলছেন “I am in blood stepped in so far that, should I wade no more, Returning were as tedious as go over.” ফেরার পথ নেই, আমার হাত রক্তে মাখা, হ্যাঁ মোদিজি শেক্সপিয়ারের সেই ট্রাজেডির নায়ক, হাত রক্তে মাখা, এক দেশের প্রধানমন্ত্রী, সেই দেশের ১৫০ জনের মৃত্যু, অসংখ্য ধর্ষণ আর নারীদের নগ্ন করে প্যারেড করানোর পরেও কথা বলতে পারছেন না, কিন্তু জানেন ভালো করেই একরাশ রক্তের মধ্যে তিনি অসহায়, একা। তিনি বোবা। এক নদী রক্ত, উঁচু লাশের পাহাড় আর লক্ষ মানুষের কান্না আর ঘেন্নার মাঝখানে বসে আছেন মোদি–শাহ।