চুরি তো আমাদের শাস্ত্র পুরাণেই আছে। স্বয়ং কার্তিক নাকি চৌর্যশাস্ত্র রচনা করেছিলেন, এমনটা পুরাণে বলা আছে। যদি আরও অকাট্য প্রমাণ চান তাহলে পুনেতে যেতে হবে সেখানে ভান্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটে রাখা আছে চৌরচর্যা। বিস্তৃত বিবরণ, কীভাবে চুরি করা যায়, কীভাবে নিপুণ হাতে সিঁদ কাটা যায়, কোন প্রহরে চুরি করলে গেরস্ত টেরও পাবে না। রাজার শ্যালকের ঘরে চুরি করা কত সহজ তার কারণও বলা আছে, বলা আছে রাজার শ্যালকের আয় রোজগার তো সবই ঘুরপথে, কাজেই তার ঘর থেকে মোহর কেন, সাতনলি হারও তো নজরানা হিসেবে আদায় করা, অতএব চুরি গেলেও রাজার শ্যালক অভিযোগ জানাতে পারে না। এত বিস্তৃত বিবরণের পরে এই শাস্ত্রের মূল কথাটা বলে দেওয়া আছে, তার সারমর্ম হল, চুরি বিদ্যে মহাবিদ্যে যদি না পড়ো ধরা। বলাই আছে, সূক্ষ্মভাবে বহু সাধনার পরেই এই চৌর্যবৃত্তিতে নামা উচিত, নচেৎ নয়। তো সেই প্রাচীনকাল থেকেই মুলুক জুড়ে চুরি হয়েছে, চুরি গেছে, চুরি করেছে। আমরা সেসব চুরির কথা শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকে দেখেছি, দেখেছি ভাসের চারুদত্ত নাটকে। একটা পুঁতির হার চুরি করে দুর্গা রেখে দিয়েছিল সযত্নে লুকিয়ে কুলুঙ্গিতে, সেই হার অপু ছুড়ে ফেলে দিল পুকুরে, কেউ জানতেই পারল না। সেই চুরির কথা আবার বাইসাইকেল থিফ-এর চুরিও আমাদের দেখা। ইদানিং অবশ্য এসব শাস্ত্র উপন্যাস বা নাটক পড়ে বা সিনেমা দেখে জানতে হয় না, সক্কালে উঠে খবরের কাগজ খুলুন, সন্ধ্যেয় টিভিটা চালিয়ে দিন, গরু চুরি, কয়লা চুরি, চাকরি চুরি মায় পুকুর চুরির হাজারো গল্প রোজ পড়বেন, দেখবেন শুনবেন। আবার টাকার পাহাড় শুনতে শুনতে বিরক্ত এক ভদ্রলোক তো সেদিন বলেই ফেললেন, ফর আ চেঞ্জ, এবার টাকার সমুদ্র বললে কী হয়? একটু ভ্যারিয়েশন আনুন না।
তিনটে মোদ্দা চুরির কথা বিরাটভাবে শোনা যাচ্ছে, আগে সেগুলোর কথা বলে নিই, তারপর চুরির অন্য গল্প শোনাব। এ রাজ্য সরগরম চাকরি চুরি নিয়ে, গরু চুরি নিয়ে আর কয়লা চুরি নিয়ে। চাকরি চুরিতে খোদ শিক্ষামন্ত্রী থেকে ফ্লপ ছবির হিট নায়ক, সিকি নেতা থেকে ধামাধরা সাংবাদিক ক্যামেরাম্যানের নাম জড়িয়ে আছে, ও দয়াল বিচার করো। হোক বিচার কিন্তু একটা কথা বলুন তো, কত চাকরি? কতজনের চাকরি চুরি গেছে? হাইকোর্টের অর্ডার ইত্যাদি ঘেঁটে জানা যাচ্ছে হাজার তিন কি বড়জোর সাড়ে তিন হাজার চাকরি চুরি গেছে। মানে শেষ জমা পড়া হিসেবেও তা সাড়ে তিন ছাড়াচ্ছে না। তবুও চাকরি তো, মানে সরকারি চাকরির এই আকালের বাজারে সাড়ে তিন হাজার চাকরি খুব কম কথা নয়, কিন্তু রাজ্যের বেকারত্বের পরিসংখ্যানের পাশে, রাজ্যের কর্মপ্রার্থীদের পরিসংখ্যানের পাশে এই সংখ্যা এক শতাংশও নয়। এমনকী এই চাকরি চুরিতে যে টাকা হাতবদল হয়েছে বলা হচ্ছে তার রাফ এস্টিমেট হল ৭০-৮০ কোটি টাকা। পাশে কয়েকটা পরিসংখ্যান রাখি, কেবল বাংলাতে গত ১০ বছরে রিনিউয়েবল এনার্জি, গ্রিন এনার্জি, সোলার, উইন্ড মিল ইত্যাদি খাতে নাকি ব্যয় করা হয়েছে ৮৭০ কোটি টাকা? কই গেল সে টাকা? কারা খেয়েছে? যে প্রজেক্ট শুরু হয়েছিল তা ধুলোর আবরণে পড়ে আছে, বেকার যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। আসুন আরেকটা তথ্য দেওয়া যাক। আসানসোল বর্ধমানে কয়লাখনি এলাকা জুড়ে খনি ভরাট করা, পরিত্যক্ত খাদান বালু দিয়ে ভরাট করা, এলাকার ধস নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বেশ কিছু প্রজেক্টে গত পাঁচ বছরের ব্যয় বরাদ্দ ১৬০০ কোটি টাকা, কেউ কাজ হতে দেখেছেন কোথাও? দেখে থাকলে জানান। কেবল বাংলার ১০০ দিনের কাজের ব্যয়বরাদ্দ গত দু’ বছরে কমেছে ১৩০ কোটি টাকা, গান্ধীমূর্তির তলায় কেউ বসেছেন? না, বসেননি। কারণ? কারণ ওসব চাষাভুষোর স্টোরিতে খবরওলাদের পেট ভরে না, রাজনীতিওলাদের মন ভরে না।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | বাংলাদেশ জ্বলছে, জ্বলছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
পাঁচজন মুখ্যসচিব বদল হয়ে গেল, বিধানসভা নির্বাচনের শেষে সরকারও হয়েছে। কিন্তু পোস্তার ব্রিজ কেন ভাঙল? জানা গেছে? জানা যায়নি। আপনি জানতে পারেননি, গত ১০ বছরে কৃষকের ব্যবহার করা সারের দাম বেড়েছে ৬৫ শতাংশ, হ্যাঁ ৬৫ শতাংশ, সাবসিডি তুলে নেওয়া হয়েছে। জেনেছেন ৩০০০ চাকরি চুরি গেছে। জানেননি ৩ কোটি চাষাভুষোর কথা, যাদের রোজগার কমেছে, খরচ বেড়েছে। চলুন দ্বিতীয় চুরিটার কথায় আসা যাক, কয়লা চুরি। কয়লা সিন্দুকে তো থাকে না, কয়লা থাকে খনিতে, সেই কবেই কয়লাখনি সরকারের হাতে এসেছে, যদিও পরে সরকার সেই কয়লা উত্তোলনের বরাত দিয়েছে বিভিন্ন শিল্পমালিকদের হাতে, সে প্রশ্ন পরে। যেটা তথ্য তা হল কয়লাখনির মালিক সরকার। বিসিসিএল, সিসিএল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের হাতে। তার মাথা থেকে ল্যাজে বসে থাকা কর্মচারীদের জন্য বিপুল ব্যয় হয়। পাহারাদারির জন্য আছে চৌকিদার থেকে সিআইএসএফ, প্যারা মিলিটারির দল। তাদের জন্যও বিপুল খরচ, ১৩২১৪ কোটি টাকা খরচ বরাদ্দ করা হয়েছে ২০২৩ এর বাজেটে, সিআইএসএফ-এর জন্য। ২০২৪-এর বাজেটে তারচেয়ে সামান্য বেশি ১৩৬৬৫.৮৪ কোটি। এবং জানা গেল কয়লা চুরির জন্য নাকি অনুব্রত মোড়ল দায়ী, হতে পারেন, আবার নাও হতে পারেন। কিন্তু তার আগেই তো প্রশ্ন তোলা উচিত যে কোটি কোটি টাকা খরচ করে এই পাহারাদারদের তাহলে রাখা হয়েছে কেন? নাকি এরাও ওই চুরির অংশীদার? যদি তাই হয় তাহলে এদের ক’জনকে ধরা হয়েছে? ক’জনকে জেরা করা হয়েছে? ক’জনের বাড়িতে সার্চ হয়েছে? কতজন জেলে আছে? আমাদের তথ্য বলছে একজনও নেই। তাহলে? তাহলে এটা কি নৌটঙ্কি? আসল চুরিকে গুলিয়ে দিয়ে চুরি চলতে দেওয়ার নাটক? আচ্ছা এই ইন্টারনেট, ভিডিও কল, ইত্যাদির জমানায় একজন অভিযুক্তকে দিল্লিতে না নিয়ে গেলে জেরা করা যাবে না? নাকি দিল্লি যাওয়ার নাটকটা জমছে ভালো? ওই দেখো চোর চোর, জমে ক্ষীর, তাই না? তদন্ত তো জানতাম সন্তর্পণে হয়, এ তো ঢাক ঢোল পিটে জানান দিয়ে তদন্ত হচ্ছে। কথায় কথায় শ’ খানেক সিকিউরিটি, অফিসার, আমলা নিয়ে রাজ্যে এসে রেড চালানো হচ্ছে, আর দু’ তিন জন অফিসার কলকাতায় উড়ে এসে জেরা চালাতে পারল না।
নাটক জমিয়ে দেওয়ার জন্য অভিযুক্তকে টেনে আনা হল আসানসোল থেকে, তিনি মাঝপথে ল্যাংচা খেলেন, নাকি আলোচনা করলেন, মিডিয়া জানল, সবাই জানল, ইডি জানল না, সিবিআই জানল না, কী কিউট তাই না? সেসব নৌটঙ্কি আমরা তো দেখে ফেলেছি। চলুন তৃতীয় চুরিতে যাওয়া যাক। গরু চুরি। তো এই চুরি করা গরু যাবে কোথায়? বাংলাদেশে। বর্ডারে কে দাঁড়িয়ে আছে? বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স, ২০২৩-এর বাজেট বরাদ্দ কত? ২৪৭৭১ কোটি টাকা, গতবার ছিল ২৩৫৫৭ কোটি টাকা আর এবারে ২৫০২৭.৫২ কোটি টাকা। তো এই মাইনে নিয়ে হাতে একে ফর্টি সেভেন নিয়ে, তারকাঁটা বসিয়ে, সার্ভেলান্স-এর জন্য কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি বসিয়ে ওঁরা ঘুমোচ্ছিলেন না সিনেমা দেখছিলেন। দেশের ভিতরে গরু চুরি হলে গরুর মালিক থানায় মামলা করবে, ক’টা মামলা এমন হয়েছে? সেই মামলা ছাড়া গরু পাচারের মামলা টিকবে তো? তারপর আসবে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের কাহিনি, তাঁরা পাচারের সময় কী করছিলেন? কিন্তু এসব তথ্য কি মানুষকে জানানো হচ্ছে? বা আদৌ এসব তথ্য আছে? তাহলে? ওই নৌটঙ্কি? গ্যালারি গরম করা হচ্ছে? প্রতিদিন নতুন নাম, প্রতিদিন নতুন তথ্য, পার্থ চ্যাটার্জি রাতে রুটি খাচ্ছেন, অনুব্রতর ফিশচুলা ফেটে গেছে, মানিকের লন্ডনে বাড়ি, রোজ সেনসেশন্যাল নিউজ, হাড়হিম করা চিত্রনাট্য, শেষে বেকসুর খালাস? আদৌ অপরাধীদের ধরার কোনও চেষ্টাই কি হচ্ছে? নাকি সবটাই ধামাচাপা দেওয়ার জন্য নাটক হচ্ছে? অন্যদিকে তাকিয়ে দেখুন, দেশের খনির ইজারাদারি পেয়ে গেছেন আদানি, আইন ছিল না, কোই বাত নহি। নয়া আইন তৈরি হয়ে গেল। দেশের এয়ারপোর্টের মালিকানা আদানির হাতে, কোনও এক্সপিরিয়েন্স ছাড়াই তারাই পেয়ে যাচ্ছে বরাত।
আমার আপনার ব্যাঙের আধুলি রাখা আছে ইনসিওর্যান্স কিংবা ব্যাঙ্কে, সেখানকার টাকা চলে যাচ্ছে আদানিদের হাতে, আদানি ডুবলে আমরাও ডুবব, ডুবছি। কত টাকার? লক্ষ কোটি টাকার। কিন্তু না এসব ওই চৌর্যবিদ্যা মেনে বহু সাধনার ফল, কাজে ধরাও যাবে না, জেলও হবে না জেরার প্রশ্নই নেই। আবার চৌর্যশাস্ত্রে ফেরা যাক, সেখানে সাফ বলা আছে, রাজা, অমাত্য, রাজার আত্মীয় স্বজন, শ্যালক ইত্যাদিদের সঙ্গে সদ্ভাব রাখিবে, তাহাদিগকে চুরির এক অংশ প্রদান করিবে, ইহাতে চুরি ধরা পড়িলেও দণ্ডের হাত থেকে বাঁচা যায়। বাৎস্যায়ন চৌষট্টি কলার মধ্যেই রেখেছিলেন চৌর্যবিদ্যাকে। মৃচ্ছকটিকের চোর শর্বিলক সেটাই বলেছে, এই চুরি যে হেতু এক প্রকারের কলা, আর্ট, সেজন্য চোরেরা গৃহস্থের বাড়িতে এমনভাবে সিঁধ কাটবে যা একপ্রকার দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যরূপে বিবেচিত হবে, এবং নগরবাসীরা সকালে ঘুম থেকে উঠে সেই চৌর্যকর্ম দেখে চোরের নিন্দা করলেও তার শৈল্পিকগুণের প্রশংসা না করে পারবে না, তাই শর্বিলক চারুদত্তের ইটের বাড়িতে যেখানে সিঁধ কেটেছিল সেখানে এক পূর্ণকুম্ভের ছবি এঁকে আসে, যা দেখে নগরবাসীরা প্রশংসাই করেছিল। ঠিক তাই মোদি-সখা আদানির চুরি আজ দেশে এক শিল্পকর্ম, গোদি মিডিয়ার কাছে তা ব্যবসা, আম্বানির ব্যবসা হল অধ্যাবসায় আর যত নষ্টের গোড়া হল কেষ্ট মোড়ল, মানিক মোড়ল, পার্থ মোড়ল। স্বাভাবিক যে তাদের কষ্ট বাড়বে বই কমবে না কারণ শাক দিয়েই তো মাছ ঢাকা হয়ে থাকে। কিন্তু সমস্যা হল এই এঁরা তো গত এক দু’ তিন বছর জেলে, তাহলে কি আপাতত গরুরা দুধ দেয় আর হাম্বা বলে ডাকে? ডাকতেই থাকে? কেউ তাদের পাচার করে না?