পাঁচ রাজের নির্বাচন শুরু হয়ে গিয়েছে। লাভ নেই জেনেই মিজোরামের পথে পা বাড়াননি দেশের প্রধান সেবক। কিন্তু বাকি চার রাজ্যে চরকিবাজির মতো পাক দিচ্ছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। হাওয়া যে খারাপ তা দলের সমীক্ষা, সঙ্ঘ পরিবারের সমীক্ষা এমনকী বাজার চলতি সমীক্ষকদের হিসেবেও ধরা পড়ছে। যতটা ধরা পড়ছে ততটা লিখছেন না, বলছেন না কিন্তু সত্যকে কতদিন আর চাপা দিয়ে রাখা যায়। কিন্তু বিজেপি হারব জেনে পিছিয়ে আসবে সে পাত্র নয়। বিজেপি লোকাল মিউনিসিপালিটির নির্বাচনকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখত, এখনও দেখে। তাই প্রধানমন্ত্রী ঘুরছেন সর্বত্র। কেন? কারণ চার রাজ্যেই বিজেপির কোনও ঘোষিত মুখ্যমন্ত্রী মুখ নেই। এতদিন এই প্রশ্ন কংগ্রেসকে করা হত, জিতলে মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী কে হবে? এবার সেই এক প্রশ্ন বিজেপির কাছে ছুড়ে দিচ্ছে কংগ্রেস। বিজেপির কাছে উত্তর নেই কারণ একজনের নাম করলে অন্যজন ছেড়ে কথা বলবে না। অবশ্য তাতেও কি সমস্যা মিটেছে? ধরুন মধ্যপ্রদেশে, শিবরাজ সিং চৌহানের পাল্টা কতগুলো মুখ, কৈলাস বিজয়বর্গী, নরেন্দ্র সিং তোমর, প্রহ্লাদ প্যাটেল এমনকী সেই লাইনেই আছেন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া। কিন্তু এঁরা কেউ কি শিবরাজ সিং চৌহানের সমকক্ষ? একজনও নয়। নরেন্দ্র সিং তোমর তো নিজের আসন বাঁচাতেই ব্যস্ত। একমাত্র কৈলাস বিজয়বর্গী ছাড়া দিল্লি থেকে আনা সাংসদ বা মন্ত্রীদের একজনও স্বস্তিতে নেই। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার কাছে এই নির্বাচন প্রায় অগ্নিপরীক্ষা। চম্বল গোয়ালিয়র এলাকা ওনার নিজের বলেই উনি মনে করেন, সেখানে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যাঁরা বছরের পর বছর লড়েছেন, সেই সব আরএসএস প্রচারক, জনসঙ্ঘ এবং পরে বিজেপির কর্মী, তাঁরা হঠাৎই দেখলেন সিন্ধিয়া চলে এসেছেন বিজেপিতে। কেবল তিনিই নয়, সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তাঁর অনুগামীদের, কাজেই ওই অঞ্চলে নব্য বিজেপি আর আদি বিজেপির মধ্যে বিরাট লড়াই চলছে, কিন্তু তার মধ্যেও বিজেপির জন্য এই গোয়ালিয়র চম্বল এলাকার ৬০-৭০ শতাংশ আসন না নিয়ে আসতে পারলে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বিপদে পড়বে, সেটা উনিও জানেন।
ওদিকে শিবরাজ সিং চৌহানের বয়স ৬৩, ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের তুলনায় কিছুই না, এবং তিনিই একমাত্র রাজ্যজোড়া মুখ, তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য যে রাখা হয়নি তা পরিষ্কার বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরেও তিনি জনসভায় জনসভায় প্রশ্ন করছেন, আমার শাসনকাল ভালো ছিল কি ছিল না? সরকারের কাজে আপনারা খুশি তো? ওনার শাসনকালের এক্কেবারে শেষে আনা লাডলি বহনা স্কিম, মহিলাদের ডাইরেক্ট ক্যাশ বেনিফিট, খানিকটা আমাদের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো, বিরাট জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু তিনি বিজেপির দিল্লি নেতাদের কাছে কল্কে পাচ্ছেন না, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে সভাতে বসিয়ে রেখেই মানুষকে প্রশ্ন করছেন কি আগের মতো? নল মে জল হ্যায়? ঘর বন গয়া? পিএম কিসান মিল রহা হ্যায়? মোদি কা কাম সে খুশ হো? না করছেন না। এর আগে তবু কিছু বিধানসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি কিছু স্থানীয় বিষয় নিয়ে, রাজ্য সরকার নিয়ে কথা বলেছেন, এবারে সেটা এক্কেবারেই নেই। এমনকী অমন যে সাধের ডাবল ইঞ্জিনের সরকারে এক গাল স্লোগান, সেটাও মোদিজি আর উল্লেখই করছেন না। এক টিপিক্যাল মেগালোম্যানিয়াকের মতোই তাঁর বক্তৃতা কেবল তাঁর সরকারের কথাই বলে চলেছে। সবথেকে বড় কথা হল সেই বক্তৃতার সিংহভাগ জুড়ে আছে বিরোধীরা দুর্নীতিগ্রস্ত, কংগ্রেসের বংশানুক্রমিক শাসন, চন্দ্র অভিযানের সাফল্য আর জি টোয়েন্টির বিরাট সাফল্য। ১০ বছর আগে যখন ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করছিলেন, তখন কংগ্রেসের বংশানুক্রমিক শাসনের কথা বলেছেন, দুর্নীতির কথা বলেছেন, আজও সেটাই তাঁর নির্বাচনী বক্তৃতার সিংহভাগ জুড়ে রয়ে গিয়েছে। যোগ হয়েছে চন্দ্রযানের সাফল্য, যা তিনি তাঁর সরকারের সাফল্য বলে চালানোর চেষ্টা করছেন, এবং জি টোয়েন্টিতে দেশ এখন বিশ্বগুরু। না, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ওনার কিচ্ছুটি বলার নেই, রেকর্ড বেকারত্ব নিয়েও কিছুই বলার নেই। উনি এখন রাজ্য সরকার বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করছেন? তাও না। ওনার পাখির চোখ ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন। প্রত্যেক জনসভায় বলছেন, আমি ২০২৪-এও জিতব এবং ফিরিস্তি দিচ্ছেন জিতে এসে কী কী কাজ করব। কেন? তিনি জানেন, ওনার কাছে রাজ্যগুলো থেকে ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট এসেছে, সংগঠনের হিসেব বলছে, একমাত্র রাজস্থান কোনওভাবে মুখরক্ষা করতে পারে, কিন্তু সেখানেও মহারানি কী করবেন তার তল পাওয়া যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | গণ্ডমূর্খের সর্দার দেশের প্রধানমন্ত্রী
আগেও একবার বলেছি, আবারও বলি, এবারের রাজস্থানের নির্বাচন দুই দলের জেতা বা হারা নির্ভর করছে অন্য দলের বিক্ষুব্ধ নেতা সেই দলের কতটা ক্ষতি করবেন, তার উপর। অশোক গেহলত অ্যান্টি ইনকমব্যান্সি খানিক সামলেছেন, কিন্তু তাঁর চিন্তা শচীন পাইলট কোন কোন আসনে কতটা ক্ষতি করতে পারবেন। এই দ্বন্দ্বের ফলে কংগ্রেসের ফলাফল খারাপ হবে তা তো জানা কথা। রাহুল গান্ধীকেই দেখুন না, এতটাই বিরক্ত যে রাজস্থানে যাচ্ছেন না। মল্লিকার্জুন খাড়গে যাচ্ছেন, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী যাচ্ছেন, রাহুল যাচ্ছেন না। অন্যদিকে এরপরেও কংগ্রেস জিতলে জিতবে রানি বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়ার জন্য। তিনি বিজেপির বিভিন্ন আসনে কতটা ভোট উল্টে দেবেন, পাল্টে দেবেন তার উপর নির্ভর করছে আবার কংগ্রেসের সরকারের ক্ষমতায় আসার। কাজেই কেউ জানে না রাজস্থানে কী হবে। মোদি–শাহ ইডি-সিবিআই ইত্যাদি যা যা করার করে ফেলেছেন, কিন্তু ছত্তিশগড় হাতের বাইরে, সেখানে অনায়াসে কংগ্রেস জিতবে। বাকি রইল তেলঙ্গানা, প্রথম দিকে বিজেপি জেতার জন্যই ঘুঁটি সাজাচ্ছিল, এখন বুঝে গিয়েছে তা অসম্ভব। কাজেই তাদের একমাত্র চাষার আশা হল কে চন্দ্রশেখর রাও সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে ৫-৬টা আসন দূরে থাকুক, বিজেপির সমর্থনে সরকার হোক। কিন্তু সেখানেও এখনও পর্যন্ত কংগ্রেসের পক্ষেই হাওয়া বইছে। কাজেই প্রধানমন্ত্রী রাজ্যের নির্বাচনকে ক্রমশ লোকসভার নির্বাচন করে তোলার চেষ্টা করছেন। আসলে মোদি–শাহ ভেবেই নিয়েছিলেন, তেলঙ্গানাতে দারুণ ফল হবে, অন্তত ভেঙেচুরে একটা সরকার তো হবেই, কিন্তু এখন পরিষ্কার যে হচ্ছে না, কোথাও হচ্ছে না, সেক্ষেত্রে একমাত্র ভরসা রাজস্থান, সেটাও হাওয়ায় দুলছে।
অথচ এই ভরসা, মধ্যপ্রদেশ থাকবেই, রাজস্থান ফিরে পাচ্ছি আর তেলঙ্গানা যা হোক করে এসে যাবে, এই অঙ্ক মাথায় রেখেই লোকসভার ঘুঁটিও সাজানো হয়েছিল, এখন সেই সব অংক ঘেঁটে গেছে। বাজেটে সারা বছরের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়, নির্বাচনী বছরে সেই বাজেট রিলিজ করা হয় নির্বাচনের মাস পাঁচেক আগে। দেশজুড়ে এক কর্মযজ্ঞের ছবি ফুটে উঠতে থাকে, সরকার কো কাম করনা উতনা জরুরি নহি হ্যায়, মগর সরকার কাম কর রহি হ্যায়, ইয়ে দিখনা জরুরি হ্যায়। বাংলা মানেটা হল সরকারের কাজ করাটা খুব জরুরি নয়, কিন্তু সরকার কাজ করছে এইটা যেন সবার মাথায় ঢোকে, কিছু একটা চলছে তা যেন সবাই বুঝতে পারে। সেই ইকুয়েশন মেনেই বিভিন্ন দফতরে নির্বাচনের বছরে মাস পাঁচ-ছয়েক আগে ফ্লাড গেট খুলে দেওয়া হয়। কাজ হোক না হোক, কাজ যে হচ্ছে তা মানুষের চোখে পড়ে। কিন্তু এখানেই হিসেবে গন্ডগোল করেছেন মোদি–শাহ। নির্বাচন সেই এপ্রিল শেষ, মে-তে, মানে এখনও ৫-৬ মাস দেরি, কিন্তু ভাঁড়ারে মা ভবানী। রেলের ২ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকার বাজেটের ৮৫ শতাংশ শেষ হয়ে গিয়েছে। কৃষির ১ লক্ষ ১ হাজার কোটি টাকার বাজেট শেষ, এবার বাজেট বহির্ভূত খরচা করতে হবে। সার মানে ফার্টিলাইজার মিনিস্ট্রিতে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১ লক্ষ ৮ হাজার কোটি টাকা শেষ। খাদ্য এবং গণবণ্টনের ১ লক্ষ ৯৭ হাজার কোটি টাকা শেষ, হাউজিং-এর ২৬ হাজার কোটি শেষ, রোড ট্রান্সপোর্ট-এর বাজেট শেষ। স্পনসর্ড স্কিম-এর স্বচ্ছ ভারতের ১২১৯২ কোটি খরচ হয়ে গেছে, মনরেগার ৮৫ শতাংশ ৬০০০০ কোটি টাকা শেষ। গ্রাম সড়ক যোজনার ১৯ হাজার কোটির কিছুই পড়ে নেই, আবাস যোজনার ৮০ হাজার কোটি শেষ, এমনকী একটাও স্মার্ট সিটি তৈরি না হলেও বরাদ্দ ১৬ হাজার কোটি কিন্তু শেষ। ন্যাশনাল রুরাল ড্রিঙ্কিং ওয়াটার মিশনের ৭০ হাজার কোটি শেষ, হেলথ মিশন, এডুকেশন মিশনের টাকাও তলানিতে। ভাবা হয়েছিল এই বিরাট টাকা খরচ হবে পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনের আগে, তার প্রচারের জন্য ৪০ জন মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী নিজে এক আলোড়ন তৈরি করবেন, সেই ঢেউয়ে ২০২৪ অনায়াসে পার করা যাবে। কিন্তু আলোড়ন তো দূরের ব্যাপার, প্রশ্ন উঠছে টাকা গেল কই? এবং তার থেকেও বড় প্রশ্ন এখন নরেন্দ্র মোদির সামনে, চার রাজ্যে নিশ্চিত হারের পরে তিনি কোন পুঁজি নিয়ে মাঠে নামবেন? কেবল রামমন্দির? কেবল হিন্দুত্ব? কেবল অযোধ্যা? সেখানেও সমস্যা, স্ট্যাটিস্টিক্স বলছে এতদিনের চেষ্টার পরেও হিন্দু জনসংখ্যার মাত্র ৫০ শতাংশই বিজেপির দিকে গেছে, সেই সত্যই উঠে আসছে মধ্যপ্রদেশের নির্বাচন থেকে। যেখানে ৯০.৮৯ শতাংশ হিন্দু, যা ছিল জনসঙ্ঘীদের সবচেয়ে পুরনো গড়, সেখানে বিজেপি কোনওভাবেই ৪১-৪২-৪৩ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি, পাবেও না। কাজেই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন নিয়ে নয়, আপাতত মোদি শাহ, সঙ্ঘ পরিবার বেশি চিন্তিত আগামী লোকসভা নির্বাচন নিয়ে।