উনিজি চুপ করে বসে থাকতে পারেন না, বিদেশ ভ্রমণ না থাকলে বাধ্য হয়েই তাঁকে এ পোড়ার দেশে থাকতে হয়। এদেশে থাকার অন্যতম একটা ঝামেলা হল লোকে জানতে চায়, মণিপুরে কী হচ্ছে? এখনও সেখানে দাঙ্গার আগুন থামল না কেন? বীরেন্দ্র সিং পদত্যাগ করছেন না কেন? বাংলাদেশের একদা প্রধানমন্ত্রী কি রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন? বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের ব্যাপারে আপনি কী ভাবছেন? এদেশের সংখ্যালঘু মুসলমান মানুষজনের উপরে অত্যাচার হচ্ছে কেন? এই সমস্ত বাজে এবং উটকো প্রশ্নের মুখে তাঁকে চুপ করে থাকতেই হয়। কিন্তু সেভাবে তো থাকা যায় না, কাজেই তাঁকে মাঝেমধ্যেই কিছু করতে হয়, যা হঠাৎই মানুষজনকে চমকে দেবে বা মানুষের জন্য কিছু কাজ বরাদ্দ করে দিতে হয়, যাতে মানুষ তা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ধরুন আজ সে ৫০০ আউর হাজার কা নোট কাগজ কা টুকরা হো গয়া। কী হাসি ওনার মুখে। আপনি আমি লাইনে। ওনাকে আমাদের কাজ করার জন্য ভোট দিয়ে গদিতে বসানো হল আর বসে ইস্তক তিনি আমাদেরকে নানান টাস্ক দিয়ে যাচ্ছেন আর না করলেই হুমকি। অমুক তারিখের মধ্যে আপনার ঘরে থাকা সমস্ত ক্যাশ যদি না ব্যাঙ্কে পৌঁছে দিতে পার, তাহলে ওই টাকার আর কোনও ভ্যালুই থাকবে না। কাজেই দৌড়ও। ঘরের টাকা বাঁচানো তো পরে, পেট চালানোর জন্য টাকা জোগাড় করাও ছিল আসলি কাজ। তো সে পর্ব চুকল। তিনি ২০০০ টাকার নোট জারি করলেন, কালা ধন ফেরত এল না, উল্টে ক’ বছরের মধ্যে সেই ২০০০ টাকার নোটও তুলে নেওয়া হল।
এবারে নতুন ফতোয়া। আধার কার্ডের সঙ্গে মোবাইল নম্বর যোগ করুন না হলে মোবাইল বন্ধ। ছোট ছোট ছোট। এসব করে কী হবে? কী হবে পরে জানা যাবে, মোবাইল বন্ধ হলে চাকরি যাবে। করলাম। বাড়ি ফিরে ঘাম শুকনোর আগে, আধার কার্ডের সঙ্গে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট জুড়ে দিতে হবে না হলে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী দেশের জন্য কী করছেন, সে প্রশ্ন করার আগেই আবার একটা নতুন কাজ। ঝাড়ু নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন, স্বচ্ছ ভারত অভিযান। তিনি একদিন বের হলেন, ভক্তরা দশ দিন, ভক্তদের চাপে আমরাও পাঁচ দিন। কিন্তু ততদিনে ঘরে ফিরেই স্বামী শুনেছেন প্রশংসা, আরিব্বাস কী ভালো ঝাঁট দাও তুমি, আজ থেকে বিশুর মা নয়, ঘরটা তুমিই ঝাড়ু দিও, আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশের পুরুষ সমাজকে ঝাড়ুদার করে তুলল। এইরকম নানান কাজ। মধ্যে মধ্যে মন্দির আর স্ট্যাচু উদ্বোধন আর ওই যে আসছে, মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেবে। সব মিলিয়ে একজন করিৎকর্মা প্রধানমন্ত্রী যিনি বছরে যে ক’টা দিন দেশে থাকেন, কার সাধ্যি ওনাকে একটাও প্রশ্ন করে? তিনি হেড স্যারের মতো রোজ হোম টাস্ক দিয়েই চলেছেন, আবার আসছে নতুন আধার কার্ড পয়েন্ট টু ভার্সন। সেটা করাতে হবে, মানে নতুন আধার কার্ড হবে, আবার মোবাইলের সঙ্গে, গ্যাসের সঙ্গে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে, ফিক্সড ডিপোজিটের সঙ্গে, এসআইপি-র সঙ্গে জুড়ে দিতে হবে। হোমওয়ার্ক শেষ না হলে হয় মোবাইল বন্ধ হবে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ হবে না হলে স্যালারিই জমা পড়বে না। ২০১৪ থেকে এই চলছে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | বিজেপির আইটি সেল নেমেছে বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যে প্রচারে
বলতে ভুলেছি, এর মধ্যেই সিএএ এসেছে, নতুন নাগরিকত্ব বিল, আপনি যে দেশের নাগরিক, সেটার প্রমাণ দিতে হবে, মোদিজি তো স্বয়ম্ভু। সেই সিরিজে দুটো কাজ আর কিছুদিনের মধ্যেই হবে, এক হচ্ছে ইউনিফর্ম সিভিল কোড। শুনতে ভালো, সব্বার জন্য এক আইন। কিন্তু সংরক্ষণের কী হবে? মহিলাদের ম্যাটারনিটি লিভ-এর কী হবে এরকম অনেক প্রশ্নের সঙ্গে সর্দারজিরা প্রশ্ন করতেই পারেন যে আমাদের কি পাগড়ি খুলে হেলমেট পরতে হবে, দেবোত্তর সম্পত্তি কোন ধারায় কী ভাবে থাকবে? সেখানে দেব তো হিন্দু, ওদিকে ওয়াকফ? হজ? হাজারো মন্দিরের ট্রাস্ট? তার আইন কীভাবে হবে? সে সব পরে হবে, আপাতত ইউনিফর্ম সিভিল কোডের কথা বলে মুসলমান চমকানো চলছে, দাঁড়া ব্যাটা চারটে বিয়ে ঘোচাচ্ছি। এমনিতেই মুসলমানের মধ্যে পলিগ্যামি কমে ১৮ শতাংশে এসে ঠেকেছে, তাও আবার তারা সব প্রবীণ লোকজন, কিন্তু সেটা তো কথা নয়, আসলে তো ভয় দেখানো। এবং আর এক নয় খিলৌনা নিয়ে মোদিজি এখন ভীষণ অ্যাকটিভ— এক দেশ এক ভোট। মানে একবারই ভোট হবে, রাজ্য আর দেশের সরকার একই সঙ্গে নির্বাচন হবে। যদি ভাবেন এর সঙ্গে পঞ্চায়েত বা পুরসভা বা কর্পোরেশনের ভোটও হবে, তাহলে ভুল ভাবছেন, ওনার লক্ষ্য লোকসভা বিধানসভার ভোট একসঙ্গে করানোর। যুক্তি অকাট্য। খরচ কমে যাবে। এক ভোটের খরচে আপনি আপনার এলাকার এমপি-এমএলএ একসঙ্গে নির্বাচন করে ফেলবেন। প্রচারও একটাই হবে, সেখানেও খরচ কমবে। মোদিজিকে কম ঘুরতে হবে, সব মিলিয়ে এক দেশ এক ভোট হল আরএসএস-বিজেপি এবং মোদি-শাহের নেক্সট প্রজেক্ট। আসলে ওনাদের ওই এক দেশ এক নেতা, এক দল এক ভাষা, এক পোশাক, এক খাবার এই যে ন্যারেটিভটা এটা বেশ খাপ খেয়ে যায় এই এক দেশ এক ভোটের সঙ্গে।
মনে করিয়ে দিই হিটলারের সময়ের স্লোগান আইন ভোক, আইন রাখ, আইন ফুয়েরার, এক দেশ, এক জাতি, এক নেতা। ঠিক সেরকম এই খুদে হিটলাররাও চায় ওই মডেলকে ফলো করতে। কিছুতেই তা হয়ে উঠছে না কারণ আমাদের দেশের ডিএনএ-তে যে বৈচিত্র্য ভরা আছে তা কোনও না কোনও ভাবে বেরিয়ে আসছে। সেটাকে কমব্যাট করার জন্যই এই এক দেশ এক ভোটের অবতারণা। প্রথম যুক্তি প্রচুর খরচ হয়, আলাদা আলাদা ভোট করার প্রচুর খরচ। আচ্ছা একটু খরচের হিসেবটাও দেখে নিন কারণ আমাদের গণতন্ত্রকে বাঁচাতে কত খরচ হয় সেটাও তো জানা দরকার। গণতন্ত্র বজায় রাখতে প্রথম খরচ নির্বাচনের, তার হিসেবটা দেখুন। ১৯৫২-তে আমাদের দেশের প্রথম নির্বাচনের জন্য খরচ হয়েছিল ১০.৪৫ কোটি টাকা, তখনকার জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে মাথা পিছু ৬০ পয়সা, ৫৭-তে খরচ কমে দাঁড়ায় ৫.৯ কোটিতে, মাথা পিছু ৩০ পয়সা। ৬২-তে ৭.৩২ কোটি টাকা, মাথাপিছু আবার সেই ৩০ পয়সা। নেহরু মারা গেছেন ৬৭-তে ভোট, ১০.৮ কোটি টাকা খরচ হল, মাথা পিছু ৪ পয়সা। এরপর ৭১, ইন্দিরা গান্ধী, নব কংগ্রেস, মোট খরচ ১১.৬১ কোটি, মাথা পিছু ৪ পয়সা। ৭৭-এ জনতা সরকার এল, নির্বাচনে মোট খরচ ২৩.৪ কোটি টাকা, মাথা পিছু ৭ পয়সা। সরকার টিকলো না, ৮০-তে আবার নির্বাচন। খরচ ৫৪.৭৭ কোটি টাকা, মাথাপিছু ১.৫ টাকা। ৮৪-৮৫ র নির্বাচন ৮১.৫১ কোটি টাকা, মাথাপিছু ২ টাকা। ৮৯-এর নির্বাচন, মোট খরচ ১৫৪.২২ কোটি টাকা, মাথাপিছু খরচ ৩.১ টাকা। ৯১-৯২-এর নির্বাচন, মোট খরচ হল ৩৫৯.১ টাকা, মাথাপিছু ৭ টাকা। ৯৬ সালের নির্বাচনে খরচ হল ৫৯৭.৩৪ কোটি টাকা, মাথাপিছু খরচ দাঁড়াল ১০ টাকা। দু’ বছর পরেই আবার ভোট, ৯৮ সালের নির্বাচনে খরচ হল ৬৬৬.২২ কোটি টাকা, মাথাপিছু খরচ দাঁড়াল ১১ টাকা। এক বছর পরে আবার ভোট, ১৯৯৯-তে নির্বাচনের খরচ ৯৪৭.৬৮ কোটি টাকা, ভোটার সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে মাথাপিছু ১৫ টাকা। ২০০৪-এর নির্বাচনে ১১১৩.৮৮ কোটি টাকা, মাথাপিছু খরচ ১৭ টাকা, ২০০৯-এর নির্বাচনে মোট খরচ হল ৮৪৬.৬৭ কোটি টাকা, মাথাপিছু ১২ টাকা। আগের নির্বাচনে একটু কম খরচ হয়েছিল, ২০১৪-তে তা এক লাফে বেড়ে দাঁড়াল ৩৮৭০ কোটি টাকায়, ৪ গুণ খরচ বাড়ল, ৪৬ টাকা মাথাপিছু খরচ হল। ২০১৯-এ ৬৫০০ কোটি টাকা মোট খরচ, মাথাপিছু খরচ ৭২ টাকা। মানে ৫২-র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার খরচ মাথা পিছু ৬০ পয়সা, ২০১৯ সালে সেই গণতন্ত্রকে বজায় রাখার খরচ মাথাপিছু বেড়ে দাঁড়াল ৭২ টাকায়, মানে ১২০ গুণ। ২০২৪-এ নির্বাচন কমিশনের হিসেব এক লক্ষ কোটি টাকা। মানে মাথা পিছু খরচ কমবেশি ১৭০ টাকা। এর পরে আছে রাজ্যে রাজ্যে নির্বাচন, উপনির্বাচন ইত্যাদি। তার মানে খরচ আছে।
তাহলে এমনিতে মনে হতেই পারে এটাই তো সবথেকে সোজা উপায়, দুটো ভোট একসঙ্গে হোক। এটা মোদিজির মাথা থেকে বেরিয়েছে, দারুণ ব্যাপার, উনিজির বুদ্ধি আছে বলতে হবে। ভক্তরা এর মধ্যে বলতে শুরু করেই দিয়েছেন, দেখেছ আমাদের নেতার মাথায় কত বুদ্ধি, এর আগে এই খরচা বাঁচানোর কথা তো কেউ ভাবেনি। যাঁরা বলেন তাঁদের তো ধারণাই এটা যে নেহরু প্যাটেল, লালবাহাদুর শাস্ত্রী বা সেই সময়কার নেতাদের তো কোনও জ্ঞানগম্যি ছিলই না, তাঁরা সব্বাই মিলে তো দেশটাকে ডুবিয়েছেন, এই তো প্রথম নরেন্দ্র মোদি এলেন দেশকে রক্ষা করতে। সেই তাঁদেরকে জানাই আমাদের দেশে ১৯৫২ থেকে সাধারণ নির্বাচন শুরু হয়েছে আর সেই সময় থেকেই দেশের সাধারণ নির্বাচন আর রাজ্যের নির্বাচন একসঙ্গেই হত। হ্যাঁ, প্রত্যেক রাজ্যের ভোট এক সঙ্গেই হয়েছিল। তাহলে আলাদা আলাদা হল কী করে? কে করল? কেউ করেনি, বিভিন্ন কারণে রাজ্য সরকার ভেঙে গেছে, আবার নির্বাচন হয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে, সরকার ভেঙে গেছে, দল ভাগ হয়েছে সরকার ভেঙে গেছে। এমনকী ইউনিয়ন সরকারও ভেঙেছে ওই একই কারণে, আবার নির্বাচন হয়েছে, আমাদের দেশে এক বছরের মধ্যে দিল্লির সরকার ভাঙতে দেখেছি, আবার নির্বাচন হয়েছে, অটল বিহারীর সরকার, ভাঙতে দেখেছি দেবেগৌড়ার সরকার, আবার নির্বাচন হয়েছে। না হয়ে উপায় কী? সংখ্যা নেই তারপরেও গণতান্ত্রিক রীতি নীতি মেনে সরকার চালানো সম্ভব নয়। রাজ্য সরকার তো মুড়ি মিছরির মতো ভেঙেছে, বিজেপিই ভেঙেছে কতবার। কাজেই যে রাজ্য আর ইউনিয়ন সরকারের নির্বাচন এক সঙ্গেই শুরু হয়েছিল, তারা আলাদা আলাদা হয়েছে সেই ভাঙনের নিয়ম মেনেই। এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, কাজেই আবার যদি একসঙ্গে ভোট হয়ও, সেগুলো একসঙ্গেই হতে থাকবে এমন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ওই যে মোদিজির বসে থাকলে আঙুল চুলকায়, আর আঙুল চুলকোলে তিনি দেশের অনেক অনেক কোটি টাকা নষ্ট না করে থামবেন না, এই এক দেশ এক ভোটও হল সেরকম একটা প্রজেক্ট, যা আসলে তিনি ওই একটা কিছু করার তাগিদেই করবেন, এবং দেশ আবার পথে বসবে।