প্রথমে রামমন্দিরে ঝরঝর করে জল পড়ছিল, জল জমেছিল চত্বরে। এবার নয়া সংসদ ভবনের ছাদ দিয়ে ঝরঝর করেই জল পড়ল, জল থই থই সংসদ চত্বর। ৮৬২ কোটি টাকা খরচ করে দেশের নতুন সংসদ ভবন তৈরি হয়েছিল, আর তার আশপাশের কিছু কনস্ট্রাকশন ইত্যাদি মিলে মোট খরচ ১২০০ কোটি টাকা। এবং তথ্য বলছে দেশের প্রতি সাতটা স্কুলের মধ্যে একটাতে শিক্ষক আছেন মাত্র এক জন। তাতে কী? এন্টায়ার পলিটিক্যাল সায়েন্স-এ মাস্টার্স করা এক উদ্ধত প্রধানমন্ত্রীর মনে হয়েছিল স্কুল তৈরি করলে তো ইতিহাসে জায়গা হবে না, বরং তার চেয়ে সংসদ ভবন নতুন করে তৈরি হোক। পড়াশুনো না করেই যখন প্রধানমন্ত্রী হওয়া যায়, তখন মিছিমিছি স্কুল তৈরি করে কী হবে? তো সংসদ ভবন তৈরি হয়ে গেল। কোন সময় শুরু হল? যখন গোটা দেশ করোনা আক্রান্ত, মানুষ মরছে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে না, পোড়ানোর ব্যবস্থা হচ্ছে না, সেই সময় দেশের সংসদ ভবন নতুন করে তৈরি করা শুরু হয়েছিল, তারপরে উদ্বোধন। সংসদ ভবন হল গণতন্ত্রের পীঠস্থান, সর্বোচ্চ জায়গা, যেখানে বসে আমাদের প্রতিনিধিরা আমাদের হয়ে আমাদের জন্য সরকার চালাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেই সংসদের অধিবেশন শুরু কে করেন? যৌথ অধিবেশনে ভাষণ কে দেন? আমাদের গণতন্ত্র দিবসে জাতীর প্রতি ভাষণ কে দেন? রাষ্ট্রপতি। উদ্বোধনের প্রস্তুতিপর্বে সংসদ ভবন উদ্বোধন তো দূরের কথা, উদ্বোধন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি আমন্ত্রিতই ছিলেন না। কেন? কারণ সংসদ ভবন উদ্বোধন করবেন চৌকিদার নিজেই।
আচ্ছা এতবড় এক অনুষ্ঠান, রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি কেন? কারণ খুব সোজা, রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদির পক্ষে সংসদ ভবনের উদ্বোধন করা সম্ভব নয়, তাই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতিকেই ছেঁটে দেওয়া হয়েছিল। কোন রাষ্ট্রপতি? যিনি নাকি দেশের প্রথম আদিবাসী, দেশের দ্বিতীয় মহিলা যিনি এই পদে বসলেন। দেশের চায়ওয়ালা কাম চৌকিদার নিজের হাতে চাকরি বিতরণ করছেন, শ্রমমন্ত্রীর নামই কেউ জানে না। প্রতিটি বন্দে ভারত ট্রেনের উদ্বোধন করছেন, দেশের মানুষ রেলমন্ত্রীর নাম জানে না। জাহাজ থেকে উড়োজাহাজ, বন্দর থেকে এয়ারপোর্ট, মেট্রো থেকে জল পরিবহণ, উদ্বোধনে এক হি নাম, নরেন্দ্র মোদি। তো সেই নরেন্দ্র মোদিই নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন করলেন। এবার তার পরের তথ্যে আসা যাক। মানুষের প্রশ্ন ছিল উদ্বোধন কবে হবে? হতেই পারত আম্বেদকরের জন্মদিনে, উনিই আমাদের সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন, জন্মদিন ১৪ এপ্রিল। দিনটা ঠিক করে কাজ করলে নিশ্চয়ই ১৪ এপ্রিলে উদ্বোধন করা যেত। হয়নি। কারণ আরএসএস–বিজেপি সংবিধান বা জাতীয় পতাকা কোনওটাই মেনে নেয়নি। বরং বিরোধিতা করেছিল। এখনও জাতীয় সঙ্গীত আর জাতীয় গীতের মধ্যে গুলিয়ে ফেলে। ক’মাস পরে ২ অক্টোবর এই উদ্বোধন করা যেত। একই সঙ্গে গান্ধীজি এবং লালবাহাদুর শাস্ত্রীর জন্মদিন। ২৭ সেপ্টেম্বর ভগৎ সিংয়ের জন্মদিন, ওঁর জন্মদিনেও হতেই পারত সংসদ ভবনের উদ্বোধন। ১১ নভেম্বর মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জন্মদিন, আমাদের দেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু আরএসএস–বিজেপি, তীব্র মুসলমান বিরোধিতাই যাদের আদর্শ, তাদের কাছ থেকে এই আশা করাও যায় না।
পড়ে থাকল ১৪ নভেম্বর জওহরলাল নেহরুর জন্মদিন, কিন্তু চায়ওয়ালার যত প্রতিযোগিতা তো সব নেহরুর সঙ্গে, কিসের প্রতিযোগিতা জানা নেই, তাহলেও নেহরু যে কিছুই করেননি, করছেন যে নরেন্দ্র মোদি এই ন্যারেটিভ তো আমরা জানি। কাজেই ১৪ নভেম্বর বাদ। ৮ নভেম্বর লালকৃষ্ণ আদবানির জন্মদিন, যাঁকে উনি বিস্মৃতি রেখারও ওপারে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ৩ ডিসেম্বর আমাদের প্রথম রাষ্ট্রপতি, ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের জন্মদিন, সেটাও হতে পারত। ২৫ ডিসেম্বর অটল বিহারী বাজপেয়ীর জন্মদিন, বিজেপির প্রথম প্রধানমন্ত্রী। এবং শেষমেশ ২৩ জানুয়ারি, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের জন্মদিনেও এই ভবনের উদ্বোধন করা যেত। কিন্তু না, এতগুলো বিকল্প থাকা সত্ত্বেও উদ্বোধন হয়েছে ২৮ মে। কারণ ২৮ মে হল গান্ধী-হত্যায় অভিযুক্ত সাভারকরের জন্মদিন। রাজ্যাভিষেক হল মোদিজির, হাতে রাজদণ্ড নিয়ে তিনি জনা কুড়ি হিন্দু সাধুদের নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের পীঠস্থানে ঢুকলেন, বেদ মন্ত্রোচারণ হচ্ছিল, সাধুরা বলছিলেন নমঃ শিবায় নম, ওম নম শিবায়ঃ। এরমধ্যেই নরেন্দ্রভাই দামোদর দাস মোদিকে দেখা গেল সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করতে, মানে হাঁটু, পা, হাত, বুক, মাথা, ওষ্ঠ, চক্ষু আর হৃদয় এই সব দিয়ে তিনি প্রণাম করলেন রাজদণ্ডকে, তামিল ভাষায় সেঙ্গোলকে, যা চালুক্য রাজাদের রাজ্যাভিষেকের সময় রাজার হাতে তুলে দেওয়া হত। চালুক্য রাজারা প্রথমে তাঁদের লোকায়ত ধর্ম, পরে বৌদ্ধ ধর্ম ছেড়ে যখন পুরোপুরি শৈব ধর্মের আশ্রয় নিয়েছেন, সেই সময় থেকেই বংশানুক্রমে এক রাজার হাত থেকে রাজদণ্ড গেছে অন্য রাজার হাতে, সে এক বিরাট অনুষ্ঠান হত, সে কথায় পরে আসছি। আপাতত ২৮ মে বিশ্বাসঘাতক, গান্ধী-হত্যা ষড়যন্ত্রে শামিল সাভারকরের জন্মদিনে নয়া সংসদ ভবন উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে মোদিজি কী করলেন সেটা আলোচনা করা যাক।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | চাকরি কই? চাকরি কোথায়? মোদিজি ধোঁকা দিচ্ছেন
এরপর তাঁর এই অনুষ্ঠানে আর কী কী করা উচিত ছিল তা নিয়ে আলোচনা করব। ২৭ তারিখেই মোদিজির হাতে দক্ষিণ থেকে আসা সন্ন্যাসীরা তুলে দেন এই রাজদণ্ড, ঠিক যেমন দক্ষিণের এক মঠাধীশের নেতৃত্বে কিছু সাধু এসে স্বাধীনতার আগের দিন, মানে ১৪ অগাস্ট জওহরলাল নেহরুর বাড়িতে আসেন, তাঁর মাথায় ছাই, থুড়ি ভস্ম মাখিয়ে দেন, হাতে তুলে দেন এই রাজদণ্ড, মন্ত্রোচ্চারণও হয়েছিল। প্রথমত জওহরলাল নেহরু অজ্ঞেয়বাদী ছিলেন, ইংরিজিতে যাকে বলে অ্যাগনস্টিক। যাঁরা ইশ্বর নেই এমন কথাও বলেন না আবার ইশ্বর যে আছেন তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন, তাঁদেরকে অজ্ঞেয়বাদী বলা হয়। তো তিনি এই উপহারকে উপহার হিসেবেই নিয়েছিলেন, রাজদণ্ড হিসেবে নয়। দেশ স্বাধীন হচ্ছে, দেশে আগামী দিনে এক গণতান্ত্রিক সরকার তৈরি হবে, সেখানে রাজদণ্ডের কোনও প্রশ্নই নেই, এটা ভেবেই তিনি ওই সেঙ্গোলকে বাড়িতে রেখেছিলেন, তারপর সেই বাড়ি যখন দেশের মানুষদের জন্য দিয়ে দেন, সেখানে এক সংগ্রহশালা হয়, সেখানেই রাখা ছিল এই রাজদণ্ড বা সেঙ্গল। না নেহরু বুঝেছিলেন এটা সেঙ্গোল, এ এক রাজদণ্ড না তাঁর সেটা বোঝার দরকার ছিল, কাজেই সংগ্রহালয়ে পরে যখন বিভিন্ন জিনিসের সঙ্গে সেগুলোর পরিচয় লেখা হয়, তখন কেউ একজন লেখেন স্বাধীনতা দিবসের আগে উপহারে পাওয়া ছড়ি, গোল্ডেন স্টিক। নেহরুর গণতান্ত্রিক ধারণা নিয়ে বা তাঁর গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা নিয়ে কোনও প্রশ্ন কেউ কখনও তোলেননি। দেশের প্রথম মন্ত্রিসভা তৈরি হচ্ছে, তাঁর ঘোর বিরোধী হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে তিনি মন্ত্রিসভায় রেখেছিলেন। কারণ জানতে চাইলে বলেছিলেন, নির্বাচন হোক, তারপরে দলের সরকার হবে, আপাতত এই সরকারে সবাই থাকবেন। তো তিনি যদি মনে করতেন ওই সেঙ্গোল বা রাজদণ্ডকে গণতন্ত্রের পীঠস্থানে নিয়ে যেতে হবে, তিনি তা করতেন। তিনি করেননি।
নরেন্দ্র মোদি সেটাই করলেন, কারণ আরএসএস–বিজেপি এক মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক শাসনেরই কল্পনা করে, যেখানে মোদিজি নিজেকে হিন্দু হৃদয় সম্রাট বলেই শুনতে পছন্দ করেন। ওঁরা রাজধর্ম, হিন্দু হৃদয় সম্রাট ইত্যাদি শব্দবন্ধ অনায়াসে ব্যবহার করেন। অটল বিহারী বাজপেয়ীর সময়ে স্লোগান দেওয়া হয়েছিল রাজতিলক কি করো তৈয়ারি, অ্যা রহে হ্যায় অটলবিহারী। তো আরএসএস–বিজেপির হিন্দু হৃদয় সম্রাট সেঙ্গোল নিয়ে সাধু পরিবৃত হয়ে সংসদ ভবনে ঢুকলেন, স্পিকারের আসনের পাশে সেঙ্গোল রাখলেন, এবং তারপরে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম। এরকম সাষ্টাঙ্গ প্রণাম আমরা মোদিজির ক্ষেত্রে দু’বার মাত্র দেখেছি। সংসদ ভবনে যেদিন তিনি ঢুকলেন, সেদিন তিনি পঞ্চাঙ্গ প্রণাম করেছিলেন, পাঁচটা অঙ্গ, বাহু, জানু মানে হাঁটু, মাথা, বক্ষ, আর চক্ষু দিয়ে প্রণাম। খেয়াল করুন এখানে পদ বা পা, ওষ্ঠ বা বাক্য নেই, আর হৃদয় নেই। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম তিনি এর আগে অযোধ্যাতে রামমন্দির উদ্বোধনের দিনে করেছিলেন, আর এইবার সেঙ্গোল বা রাজদণ্ডকে করেছেন। মোদিজি যখন সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছেন তখন তাঁর দিকে সেই সাধুসন্তরা ছুড়ে দিচ্ছিলেন ফুল, এবং মন্ত্রোচ্চারণ হচ্ছিল। জানি আপনারা বলবেন, এই ঘটনা এত বড় করে বলছি কেন? বলছি কারণ এটাই ছিল বড় অনুষ্ঠান, ফোটো অপরচুনিটি, সেদিনের খবরের কাগজ খুলে দেখুন এটাই সব কাগজের ছবি। তারপর দেওয়ালে অজস্র ম্যুরাল দেখা গেল, এক অখণ্ড ভারতের ছবি। অখণ্ড ভারত হম বনায়েঙ্গে, আরএসএস–বিজেপির এই প্রতিজ্ঞা শোনা গেল, বোঝা গেল কেন এই আরএসএস–বিজেপির সরকারের সঙ্গে আমাদের পড়শি দেশগুলোর সুসম্পর্ক নেই কেন! স্পিকারের পাশে রাজদণ্ড রেখে নেমে আসছেন মোদিজি, মাথা নুইয়ে প্রণাম করছেন সাধুদের সাধুরা আশীর্বাদ দিচ্ছেন। এরপর তিনি গান্ধীজির মূর্তিতে ফুল দিলেন এবং কী আশ্চর্য, তারপরেই গান্ধী-হত্যার ষড়যন্ত্রের মাথা বিনায়ক দামোদর সাভারকরের ছবিতেও মালা দিলেন, কারণ ২৮ মে তেনার জন্মদিন। সাভারকরের জন্মদিনেই দেশের গণতন্ত্রের নতুন পীঠস্থান উদ্বোধন হল। নতুন সংসদ ভবনে মোদিজি ভাষণ দিলেন। একটা নতুন শব্দ নেই, না এমন কোনও বাক্যবন্ধ, যা মানুষ ওই জওহরলাল নেহরুর ট্রিস্ট উইথ ডেসটিনির মতো মনে রাখবেন, থাকার কথাও নয়। সেই মেধা ওঁর কাছ থেকে কেউ আশাও করে না। মামুলি কিছু কথা বলার পরে ৭৫ টাকা মূল্যের এক মুদ্রা প্রকাশ, আবার গিমিক, জনা দশেক শ্রমিকের হাতে সেই মুদ্রা তুলে দিলেন মোদিজি।
এবং এসবের শেষে, মঞ্চের নীচে বসলেন মোদিজি, স্পিকার ওম বিড়লা, সেখানেই বসে আছেন সাধুসন্তরা, আলাদা ডায়াসে শুরু হল সর্ব ধর্ম প্রার্থনা, সর্ব ধর্ম বললে ভুল হবে, সেখানে বসে আছেন অন্য ধর্মের মানুষজন। মানে হিন্দু রাষ্ট্রে রাষ্ট্রনেতার ইচ্ছে হলে তাঁদেরও মাঝেমধ্যে ডাকা হবে। কিন্তু একজন সংখ্যালঘুকেও জিতিয়ে লোকসভা বা রাজ্যসভায় আনা হবে না। এটা সম্ভবত খানিক চক্ষুলজ্জা আর খানিকটা এই অসম্ভব হিন্দু পরিবেশকে ম্যানেজ দেওয়ার জন্য। না, যখন মোদিজি রাজদণ্ড নিয়ে ঢুকছেন, তখন কোনও মুসলমান, ক্রিস্টান, ইহুদি ধর্মযাজক, পাদ্রি বা ইমামকে দেখা যায়নি। যখন সেঙ্গোল রাখা হচ্ছে তখন সর্ব ধর্ম পাঠ হয়নি, যখন মোদিজি নেমে আসছেন তখন তিনি আশীর্বাদ নিয়েছেন কেবল হিন্দু সাধুদের কাছে। এখন দূরে বসে খানিক ম্যানেজ দেওয়ার চেষ্টা, যা দেখে এই বাংলার এক কুনকি হাতি সোচ্চারে জানিয়েছিলেন সংসদ ভবনে কোরান পড়া হচ্ছে। সত্যিই তো এর আগে সংসদ ভবনে কোরান পড়া হয়নি, যেমন কোনও দিনও সাধুসন্তদের নিয়ে বৈদিক মন্ত্রপাঠ করতে করতে কোনও প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভবনে ঢোকেননি। পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে ছিল হিন্দু ধর্মের অনুষঙ্গ, রাজ্যাভিষেকের ছবি। হ্যাঁ, ঠিক যেমন চোল রাজারা প্রতিবার তাঁদের রাজ্যাভিষেকের জন্য তৈরি নতুন ভবন বা প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠানে নামতেন সেই রকম সাধুসন্তদের মন্ত্রোচ্চারণ, হাতে রাজদণ্ড নিয়ে রাজার সিংহাসনে বসা ইত্যাদি গতকাল আমরা দেখেছি। কেন এগুলো করা হল? কারণ খুব সোজা, এটাই নাকি ভারতীয় ঐতিহ্য, ভারতীয় পরম্পরা। তাই নাকি, তাহলে পরম্পরা আর কী কী আছে সেটাও দেখা যাক। আলোচনা হোক আমরা কী কী দেখিনি? প্রথম হল এই ধরনের রাজ্যাভিষেকে, এই ধরনের যাগযজ্ঞের প্রথম শর্ত ছিল বামাকে সঙ্গে রাখা। বামা কে? তিনি হলেন বিবাহিত স্ত্রী? কোন স্ত্রী? কারণ সেই সময় তো হিন্দু রাজা, সেনাপতি, নায়েব, মন্ত্রী, সভাসদেরা একটা নয়, বহু বহু বিবাহ করতেন, তার উদাহরণ দিয়ে সময় নষ্ট করব না। কিন্তু নিয়ম হচ্ছে রাজ্যাভিষেকের সময়ে তাঁর পাটরানি, রানিদের মধ্যে বড় রানিকে বাম দিকে রাখতে হবে, না হলে ধর্ম এবং পরম্পরার দিক দিয়ে এই অনুষ্ঠান, এই রাজ্যাভিষেক, এই যজ্ঞ অসম্পূর্ণ। মোদিজি বিবাহিত, তাঁর স্ত্রী যশোদাবেন মোদি বেঁচে আছেন, সুস্থ আছেন, তাহলে তিনি এই অনুষ্ঠানে নেই কেন? যদি সেঙ্গোল এক ঐতিহ্য হয়, পরম্পরা হয়, তাহলে সঙ্গে স্ত্রী থাকাটাও এক ঐতিহ্য, এক পরম্পরা। কেন এই পরম্পরা রক্ষিত হল না, তার জবাব তো আরএসএস, বিজেপি বা মোদিজিই দিতে পারবেন। দ্বিতীয় হল বলিদান। চোল রাজাদের রাজ্যাভিষেকে অসংখ্য পশুবলি হত। এক পুঁথিতে পাওয়া যাচ্ছে এমনকী কুকুর, ভেড়া, মোষ সমেত ৬০৯টা পশু বলি হত। তাদের ভালো মাংস খেতেন রাজবংশের মানুষজন, আর খানিক পড়ে থাকত সাধারণ মানুষের জন্য আর কিছু কাক চিল শেয়াল ইত্যাদিদের জন্য। না, এগুলো আমরা সেই উদ্বোধনের দিন দেখিনি, কিন্তু যদি প্রথা বা ঐতিহ্য বা পরম্পরা বলেন, তাহলে সেঙ্গোলের সঙ্গে এইগুলোই ছিল চালুক্য বংশের রাজ্যাভিষেকের প্রথা। তো এসব মনে পড়তেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এক শীর্ষ নেতা জানালেন সংসদ ভবন বা রামমন্দির কোনওটাতেই নাকি প্রথা মেনে উদ্বোধন করা হয়নি, তাই নাকি দুর্যোগ ভেঙে পড়ছে দেশের উপর, রামমন্দিরের ওপর, সংসদ ভবনের ওপর। হেসে নাও, দু’দিন বই তো নয়।