২০২৪-এর নির্বাচনে শুভেন্দু অধিকারী তিনটে নিজস্ব ঘুঁটির চাল দিয়েছিলেন, তমলুকে অভিজিৎ গাঙ্গুলি, কৃষ্ণনগরে অমৃতা রায় আর সন্দেশখালিতে রেখা পাত্র। এটা নাকি তাঁর মাস্টারস্ট্রোক ছিল। তো অভিজিৎ গাঙ্গুলি জিতেছেন, বাকি দুজন হেরেছেন বললে ভুল হবে, গো-হারান হেরেছেন। সেই তিনজন এখন কোথায়? কী করছেন? হঠাৎ সংবাদমাধ্যমের আলোর তলায় এসে পড়া এই মানুষগুলোর হাল-হকিকত নিয়ে আলোচনা করা যাক। নির্বাচন শুরু হবে হবে, এমন সময় আমরা জানলাম শেখ শাহজাহান বলে একজন কেউ আছে যার কাছে রাতের বেলায় সন্দেশখালির যুবতী মহিলাদের পিঠে বানাতে যেতে হয়, এবং এক যুবতী নাম রেখা পাত্র, তিনি পিঠে বানাতে অস্বীকার করায় তাঁর গালে ক্ষুর চালিয়েছে ওই শেখ শাহাজাহানের দল। একটা দেড় ইঞ্চির মতো কাট মার্ক। ঘটনার ঘনঘটা, তার আগেই ইডি শেখ শাহজাহানকে ধরতে গেছে, গ্রামবাসী, নাকি ওনার সাঙ্গোপাঙ্গদের হাতে মার খেয়েছে, তারপর থেকে এলাকা উত্তাল। শেখ শাহজাহান যেন নেতাজি আত্মগোপনে, এমন এক কায়দাবাজি শুরু হল, ঠিক এই সময়ে যখন তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরাও ব্যাকফুটে, তখন আসরে নামলেন রেখা পাত্র। জানা গেল সন্দেশখালির মহিলারা ধর্ষিতা হতেন, তাঁদের জমি কেড়ে নিয়েছে ওই শাহজাহান, বেআইনি ভেড়ি তৈরি করা হয়েছে এলাকায়, হুদো হুদো অভিযোগ, এবং সাদা চোখেই চাষের ধানি জমিকে ভেড়ি বানিয়ে দেওয়া ইত্যাদির অভিযোগ যে বেশিরভাগটাই সত্যি তা বুঝতে পারছিলাম কিন্তু এক বিশাল এলাকার মহিলাদের এক নেতা আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা রোজ ধর্ষণ করতেন, এ নিয়ে ধন্দ ছিল।
কিন্তু সেই সন্দেশখালির আন্দোলনে হাজির শুভেন্দু অধিকারী, এবং তখন মাঝমাঠে কেবল রেখা পাত্র নয়, কারণ রেখা পাত্র ঠিক ঘটনার অকুস্থলের বাসিন্দাই নয়। কিন্তু তিনি ভাঙা হলেও হিন্দি বলতে পারেন এবং তাঁর মধ্যে স্ফুলিঙ্গ দেখতে পেলেন বিরোধী দলনেতা। ইতিমধ্যে সন্দেশখালির ধর্ষিতাদের নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়েছেন বিজেপি নেতারা, দিল্লিযাত্রা, নিয়ে যাওয়া হয়নি রেখা পাত্রকে, তিনি মিডিয়ার সামনেই সটান বলে দিলেন ওসব তো সাজানো নির্যাতিতা। নিমতিতা কাসুন্দা তিতার মতো সাজানো নির্যাতিতাও হয় আমরা জানলাম। জানলাম যে রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব নির্যাতিতা সাজিয়ে দিল্লি নিয়ে গেছেন শুধু নয়, তাঁদেরকে রাষ্ট্রপতির কাছেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে, বলেছেন নন আদার দ্যান রেখা পাত্র। তারপর থেকে গোটা আন্দোলন ওই রেখা পাত্র এবং পুরোটাই ওই মহিলাদের উপর অত্যাচার, মূলত এই ন্যারেটিভকে নিয়েই ঘটনা গড়াতে থাকল। যাঁরা বছরখানেক চলতে থাকা মণিপুর রমণীর সেই নগ্ন প্যারেডের পরে সামান্য প্রতিবাদও জানাননি, সেই লকেট, অগ্নিমিত্রা পাল প্রায়, প্রায় নির্যাতিতার বয়ানেই প্রতিবাদ করতে শুরু করলেন এবং এই সময়েই সেই সুসমাচার এল, রেখা পাত্রকে প্রার্থী করা হয়েছে। কার মাথায় এল এই বুদ্ধি, ১০০ শতাংশ হলফ করে বলতে পারি এই বুদ্ধি এসেছে শুভেন্দু অধিকারীর মাথা থেকে। উনি মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে ঘর করেছেন, গিমিক আর চমক উনি শিখেছেন সেই আঁতুড়ঘরেই। তো হলেন, প্রার্থী হলেন, শাড়ি আরেকটু গোছালো হল এবং ভিডিও দেখলে বুঝতে পারবেন মুখের কাটা দাগ আরও স্পষ্ট এবং মুখ আরও ঝকঝকে। ঠিক তেমন এক সময়ে সেই ফোনটা এল। মোদিজি এক নির্যাতিতার দুঃখে নিজের আবেগ সামলে না রাখতে পেরে ফোন করলেন রেখা পাত্রকে, এবং কে না জানে মোদিজি মা-কে প্রণাম করার আগে ক্যামেরা ডেকে নেন, এক্ষেত্রে তো ডাকবেনই, কাজেই চোখে চোখ রেখে বিষ ছড়ানেওয়ালারা সেটা খবরও করলেন, বলা শুরু হল সন্দেশখালি তো কেকওয়াক।a
আরও পড়ুন: বিজেপি জোট বাঁধে নিজের স্বার্থে, জোটের শরিকরা দুর্বল হয়, বিজেপি বেড়ে ওঠে
ওদিকে মহুয়া মৈত্রকে সংসদ থেকে বের করা হয়েছিল, বাংলো কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, আর তিনি বলেছিলেন আবার আসিব ফিরে বাংলার তীর থেকে দিল্লির ভিড়ে, তার সঙ্গে আবার সুকান্ত, চিতা জ্বালার কথাও বলেছিলেন, তোদের চিতা আমি তুলবই। তাই তাঁকে আটকাতে কে হবেন প্রার্থী আবার সেই শুভেন্দু অধিকারী। আগের মতোই যা জানা গেছে, তিনিই হদিশ দিলেন এক রাজমাতার, রাজাগজা শুনলেই মোদিজির ভারি আহ্লাদ হয়, তিনি ওনাকেও ফোন করলেন এবং আবার খবর, রাজমাতার প্রচার। মোদিজি নিজে এলেন দু’ বার, অমিত শাহ একবার, অন্যান্যরা তো শতবার। কী দাঁড়াল? দুজনকে ফোন করেছিলেন মোদিজি, দুজনেই হেরেছেন, গো হারান হেরেছেন শুধু নয়, রাজমাতা অমৃতা রায় তো হেরেই বোমা ফাটাতে শুরু করেছেন, কেবল তাঁকে যে হারিয়েছে দলের লোকজন তাই নয়, তাঁর কাছে পাঠানো টাকাপয়সাও যে জেলার নেতারা মেরে দিয়েছেন তাও জানালেন। তিনি আর রাজনীতি করবেন? শুনেছি এ মুখোও হবেন না। ওদিকে রেখা পাত্র? বুঝতেই পারছেন না সামলাবেন কী করে? টাকা নিয়ে মিথ্যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, এসব তো স্টিং অপারেশনেই বেরিয়ে এসেছে, সে সব বলেছেন তো বিজেপির নেতারা, এদিকে রেখা পাত্র তো এখনও বিজেপিতেই আছেন। কিন্তু রোজ ওনার শিবির থেকে লোকজন দিদিমণির উন্নয়ন যজ্ঞে যোগদান করছেন, কিছুদিন পরে ক’জন থাকবেন তা জানা নেই, এবং তার সঙ্গে নাকি টাকাপয়সা নিয়ে বিস্তর গোলমাল শুরু হয়েছে। অন্তত তিনজন নাকি ওই টাকা নিয়ে এলাকাতেই আর আসছেন না। সব মিলিয়ে ৪ লক্ষের বেশি ভোটে হার শুধু নয়, পাশ থেকে লোকজন সরে গেলে কোথায় যাবেন রেখা পাত্র?
দুজনকে ফোন করেছিলেন দেশ কা চৌকিদার, দুজনই হেরেছেন, যেখানে মিটিং করেছেন, সেখানেই হেরেছেন বিজেপি প্রার্থী। শুনলাম তৃণমূলের দু’ একজন এখন থেকে কিছু বিজেপির শিওর আসনে ‘মোদিজি এখানে আসুন’ লিখে পোস্টকার্ড পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আর বিজেপি শিবিরের খবর, কেউ কেউ বলেছে অপয়ার চোখ পড়লে জেতা ঘুঁটিও কেঁচে যায়। আমি অবশ্য এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করি না। খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না, কানাকে কানা বলিও না বাবা শিখিয়েছিলেন, কাজেই কেউ কিছু বললেই দুম করে আমি কিছু বলে বসি না। কিন্তু অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় তৃণমূল দলটাকেই জানোয়ারের দল বলেছেন, আমি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে জানোয়ার বলছি না, উনি বলেছেন, সেটা নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করছি। এখন আপনি যদি কাউকে জানোয়ার বলেন, বা তার চেয়েও বাজে কিছু, তাহলে সেও পারলে অবরে সবরে সেসব কথা নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দেবে। খোঁজ নিয়ে দেখলাম কুণাল ঘোষ এখনও অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে জানোয়ার বলেননি, বলতেই পারেন, বললে জানাব। তো যে কথা বলছিলাম তাতেই ফিরি, আমাদের মাননীয় প্রাক্তন জজ সাহেব বলেছেন তৃণমূল হল জানোয়ারের দল। কেন? এবং পুরোটা ঠিক কী কী বলেছেন। বলেছেন তৃণমূল একটা জানোয়ারের দল যারা বলে তারা লক্ষ্মীর ভান্ডার দিচ্ছে, ওটা ওদের বাবার পয়সা নয়, ওটা কেন্দ্রীয় সরকার থেকে আসে।
ওঁর দোষ নয়, জজ সাহেব হলেই যে সাধারণ জ্ঞানগম্যি থাকতেই হবে এমনটা কোথাও লেখা নেই, বেশিরভাগেরই থাকে, তবে ব্যতিক্রম তো থাকবেই, উনি সেই ব্যতিক্রমের মধ্যেই পড়েন ধরে নিয়েই আলোচনাটা এগোনো যাক। প্রথম কথা হল এই লক্ষ্মীর ভান্ডার যে আসলে ভিক্ষে ইত্যাদি কথা তা বিজেপি নেতারা নির্বাচনের সময়ে শুরুর দিকে বলেছিলেন। তারপর ১৮০ ডিগ্রি পাল্টি, বলেছিলেন যে আপনারা এলে এই টাকা আরও বাড়িয়ে দু’ হাজার টাকা করে দেবেন। তো সেটা কার বাবার টাকায় করবেন, সেটা কি জানিয়েছিলেন? তারপরে হল টাকাটা কার? যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে রাজ্যগুলো থেকে যে টাকা যায়, সেই টাকাই যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার যাকে উনি ভুল করে কেন্দ্রীয় সরকার বলছেন তারা খরচ করে, মানুষের কাছ থেকে আদায় হওয়া বিভিন্ন ট্যাক্স যায় ওই যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের কাছে। সেই যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার সেই টাকার একটা অংশ রাজ্যকে পাঠায়, যা রাজ্য সরকার সরাসরি খরচ করে। তো মমতা ব্যানার্জি বা মোদিজি কেউ তাঁদের বাবার টাকা খরচ করছেন না, অ্যাট লিস্ট মমতা ব্যানার্জি তেমন দাবি করেছেন বলে আমি শুনিনি। তাহলে কী দাঁড়াল। মানুষের পয়সা মানুষের জন্য খরচ হচ্ছে আর সেটা শিল্পপতিদের দেড় লক্ষ কোটি লোন মাফ করে দিলেও হয়, গ্রাম শহরের মহিলাদের ১০০০-১৫০০-২০০০ টাকা দিলেও হয়। মমতা এটা করেছেন, তারপর থেকে মধ্যপ্রদেশে ঠিক নির্বাচনের আগেই লাডলি বহনা, মহারাষ্ট্র সমেত বহু সরকার তাঁদের রাজ্যেও করেছেন, বেশ করেছেন, এবং সেখানেও সেই সরকারে থাকা দল সেটাকে তাদের সাফল্য হিসেবেই দেখায়, তাহলে জানোয়ারটা আসলে কে? সব্বাই জানে কিন্তু তারপরেও যদি আপনাকে কেউ জানোয়ার বলে আমি তীব্র প্রতিবাদ করব, কারণ কোনও জানোয়ারকে আমি এত তাড়াতাড়ি, এত অবিবেচক হয়ে উঠতে দেখিনি। যে মানুষটা চে গ্যেভারার ছবি ধরে পোজ দেন, নিজেকে বামপন্থী বলেন সেই মানুষটা গডসের পূজারী হয়ে ওঠেন, এতটা জানোয়ার প্রবৃত্তি জানোয়ারদের মধ্যেও দেখা যায় না।