ঢুকিয়ে দিয়েছি, সাংবাদিকদের সামনে একদা সহকর্মীকে জেলে পোরার পরে দন্ত বিকশিত করেই তাঁর আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন অধুনা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি আবার নিজের অনুগামী কেবল নয় বিধানসভাতেও এই ঢুকিয়ে দেবো, পুরে দেব, রেড করাব ইত্যাদি বলে থাকেন। তো তাঁর কথা সেদিন অক্ষরে অক্ষরে পালন করে ইডি জেলে পাঠিয়েছিল অনুব্রত মণ্ডলকে। এরপর ক’দিন আগেই মেয়ে জামিন পেয়েছিল, এবার অনুব্রত মণ্ডল, বীরভূমের কেষ্ট মোড়লও জামিন পেলেন, জেলের বাইরে এলেন। ২০২২ এর ১১ অগাস্ট ওনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, মানে দু বছরেরও বেশি জেল খেটে তিনি বের হলেন, এখনও পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে একটা অভিযোগেরও প্রমাণ তথ্য ইত্যাদি আদালতে দিতে পারেনি বলেই বিচারক অনুব্রত মন্ডল বা তাঁর কন্যাকে জামিন দিয়েছেন। কিন্তু এরমধ্যে পত্রপত্রিকায় তাণ্ডব চলেছে বললেও কম বলা হবে। প্রথমে তাঁকে রাখা হয়েছিল আসানসোল সংশোধনাগারে, সেখানে নাকি কেষ্ট আছেন স্বমেজাজে, সেখানে কেষ্ট নাকি পোস্ত ভাত কলাইয়ের ডাল দিয়ে মেখে খাচ্ছেন, সেখানে নাকি কেষ্টদার দেখাশুনোর জন্য হাজির ছিল জনা দশ কয়েদি, বাঙালি পড়ছে আর হেঁচকি তুলছে, আমোদগেঁড়ে সেই সকল বাঙালির ফুর্তি ডট কম। আলোচনা শুরুই হচ্ছে, জানিস তো কেষ্টদা গতকাল ব্ল্যাক বেঙ্গলের মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছেন।
তো এসব ছাপাছাপি হতেই নড়েচড়ে বসলেন সিবিআই আধিকারিক, রাশি রাশি লক্ষ লক্ষ গরুপাচার, লক্ষ লক্ষ গাড়ি বালুপাচার, কয়লা পাথর ধান চাল আরও কত কী। নারী পাচারটা যে কেন বাদ রেখেছিল কে জানে। তো যাই হোক ওনাকে ৭ মার্চ নিয়ে যাওয়া হল দিল্লিতে, সিবিআই হেফাজতে, তারপরে তিহারে। কেন? উনি খাসির মাংস খাচ্ছিলেন বলে? নাকি বীরভূমের নির্বাচন সামলাতে? এবং সেই সময়ে খবরের কাগজ, বিশ্বস্ত সূত্রের খবরের নামে কী কী ছেপেছিল? ঘটনার সূচনা বলা হয়েছিল ২০১৫ সালে। মানে ২০১১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত কেষ্ট মোড়ল হাত গুটিয়ে বসে ছিল, তারপরে ২০১৫ থেকে গরু পাচারে নামল। এর আগে কারা বাংলাদেশে গরু পাচার করত? সেই দেবশিশুরা কারা? বৃহৎ সংবাদমাধ্যমের দালালেরা সে সব তথ্য ও খবর কিন্তু পাননি, ২৪ ঘণ্টা ধরে মহা আনন্দে যা বাজারে ছড়ানো হল, সেই সময় লালগোলা, ডোমকল, জাঙ্গিপুর, আওরঙ্গাবাদের শুল্ক দফতরে গরুর নিলামের দায়িত্বে ছিলেন এনামুল হক এবং তাঁর সহযোগী জেএইচএম ভাই বলে পরিচিত জাহাঙ্গির আলম, হুমায়ুন কবির এবং মেহদি হাসান। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন শেখ আব্দুল লতিফ এবং আরও কয়েকজন। সাধারণত সীমান্তে পাওয়া বেওয়ারিশ গরুরই নিলাম হয়। সেই টাকা যায় সরকারি তহবিলে। নিলামে কেনা গরু বিক্রি করে যেহেতু বিশেষ লাভ হত না দ্রুত এই দলটি গরু পাচারের কাজে জড়িয়ে পড়ে।
তখন শুল্ক ভবনে গরুর নিলাম হত নামমাত্র। এনামুল আর তাঁর সঙ্গীরা নিজেদের নামে বা চেনা-পরিচিতদের নামে ওই গরু কিনে নিতেন। নিলামের গরু ছাড়াও সীমান্তের কাছে থাকা বিভিন্ন জেলার হাট থেকে গরু সংগ্রহ করা হত। ইলমবাজার পশু হাট, বীরভূম পশুহাট, বীরভূমের পাকুর পশুহাট, মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি, ওমরপুর পশুহাট, উত্তর দিনাজপুরের ডালগোলা পশুহাট থেকে গরু আনাতেন এনামুলেরা। এর মধ্যে বীরভূমের হাট থেকে গরু কেনা এবং বীরভূমের উপর দিয়ে গরু নিয়ে যাওয়ার কাজের দায়িত্বে ছিলেন আব্দুল লতিফ ওরফে হিঙ্গল। গরু পাচারের পুরো কাজটিই নিয়ন্ত্রিত হত একটি হোটেল থেকে। হোটেলটির নাম সোনার বাংলা। এর মালিকানা ছিল এনামুলের সহযোগী ওই তিন ভাইয়ের। যাঁরা একসঙ্গে জেএইচএম ব্রাদার বলে পরিচিত। এই সোনার বাংলা হোটেলই পরে হয়ে ওঠে গরু পাচারের কেন্দ্র। হোটেল ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বদলে সোনার বাংলায় চালু হয় মার্বেলের ব্যবসা। কিন্তু সেটা ছিল লোক দেখানো। আসলে ভিতরে নিজের অফিস খুলেছিলেন এনামুল।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | চার রাজ্যে ভোট, তিন রাজ্যেই হারবে বিজেপি
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছেই ছিল সোনার বাংলা। সেখানেই তৈরি হয় গরু পাচারের সিন্ডিকেট। প্রথমে সোনার বাংলার কাজ সামলাতেন তিন ভাইয়ের একজন— হুমায়ুন ওরফে পিন্টু হাজি। পরে দায়িত্ব বদলায়। বিভিন্ন হাট থেকে গরু নিয়ে আসা ট্রাকের চালকদের আসতে হত এই সোনার বাংলার অফিসে। এখান থেকেই ঠিক হত কোন সীমান্তে কোন গাড়ি যাবে। যেমন, মুর্শিদাবাদের বিএসএফের ৩৬ নম্বর ব্যাটেলিয়নের অন্তর্ভুক্ত বিওপি নিমতিতা, বিওপি খান্ডুয়া, বিওপি গিরিয়া। যে ট্রাক ড্রাইভাররা গরু আনতেন তাঁদের একটি টোকেন দেওয়া হত। যাতে পুলিশ বা স্থানীয় প্রশাসন এই গরুর ট্রাকের যাতায়াতে কোনও বাধা না দেয়। এর পর সীমান্ত এলাকায় এই গরু তুলে দেওয়া হত স্থানীয় রাখালদের হাতে। যাঁদের কাছে এই সীমান্ত এলাকা হাতের তালুর মতো চেনা। রাত ১১টা থেকে ভোর ৩টে ছিল গরু পাচারের সময়। এ ব্যাপারে এনামুল এবং তাঁর সঙ্গীরা আগেভাগে বিএসএফের সঙ্গে ‘সেটিং’ বা বোঝাপড়া করে রাখতেন। বিএসএফের পরোক্ষ সাহায্যেই রাতের অন্ধকারে ভারতের সীমান্ত থেকে গরু নিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছে দিতেন ওই রাখালেরা। ইডি চার্জশিটে জানিয়েছে, বীরভূমের পশুহাট থেকে গরু কেনা এবং তা সুরক্ষিত ভাবে নজর বাঁচিয়ে মুর্শিদাবাদে পাঠানোর দায়িত্বে ছিল অনুব্রতের। নিরপত্তার এই দায়িত্বের বদলেই এনামুলদের কাছ থেকে টাকা আসত অনুব্রতের কাছে। এনামুল এবং লতিফ এ ব্যাপারে অনুব্রতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন তাঁর দেহরক্ষী সেহগল হোসেনের ফোনে। এনামুল এবং সেহগলের যোগাযোগের প্রমাণ হিসাবে কল ডিটেলস-এর বিস্তারিত তথ্যও রয়েছে চার্জশিটে। এরসঙ্গে ক’টা ধানকল, কত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, কত টাকা আছে? ক’বার লটারি পেয়েছে, মেয়ে স্কুলে না গিয়েই টিচার, মাইনে পায়, সেই নাকি সব হিসেব দেখরেখ করে। কিন্তু একটা সময় এই খবরগুলো সেই সব অ্যাঙ্কার-এর ছদ্মবেশে চিল্লানেসোরাসদের হাজার চেল্লামিল্লি সত্ত্বেও টিআরপি তুলছিল না। কাজেই এটা থাক অন্য কিছু আনো মাঠে, সেই হিসেবেই আপডেট কমে আসে মিডিয়ায়। কারণ অপরাধ মোটের উপর তো ‘প্রমাণিত’। আজ দু’ বছর পরে দেখা যাচ্ছে, প্রমাণ তো দূরস্থান, ইডি এইসব নিয়ে বিশেষ কোনও তথ্যই জমা দিতে পারেনি। এবং শুধু অনুব্রতর বিরুদ্ধেই না, কেজরি, মণীশ, মানিক, সুকন্যা, সবাই লাইন দিয়ে ছাড়া পাচ্ছেন। সর্বত্রই উৎসব, দিল্লি থেকে বীরভূমে। অনুব্রত মণ্ডল বস্তুত ক্লিনচিট পেলেন। জামিন হলেও, এক্ষেত্রে সেটাই প্রায় মুক্তির কাছাকাছি। কারণ, নতুন আইনের দৌলতে ইডি যাকে খুশি ধরে জেলে পুরে রাখতে পারে, প্রমাণ-টমান লাগে না। কাজেই এইসব জামিন দেখায়, দোষ প্রমাণের ধারে কাছেও এগোতে পারা যায়নি।
কেউ কি সেই সম্পাদক, অ্যাঙ্কারদের কলার ধরে আজ জিজ্ঞেস করতে পারবেন যে সেদিন এই মিথ্যেগুলো কার এবং কিসের বিনিময়ে ছড়িয়েছিলেন? কোনও প্রশ্নই থাকবে না? একে একে জেলে পোরা হচ্ছে, জেলে পোরার পরেই কত গল্প, কত কেচ্ছা কাহিনি, কত সনসনিখেজ স্কুপ রিপোর্টিং, কত ব্রেকিং নিউজ, আজ কেষ্ট মোড়ল খেলেন তাঁর প্রিয় মাছের টক, জানালেন ভালই করেছে। উফফফ, কী ব্রেকিং। অবশ্য সাংবাদিক বা অ্যাঙ্করদের আর দোষ কোথায়? পাপী পেট কা সওয়াল হ্যায়। আমরা কিন্তু সেই ২০২২ সালের ৩০ অগাস্ট আমরা এই চতুর্থ স্তম্ভ অনুষ্ঠানেই বলেছিলাম, “অনুব্রত মণ্ডল, কেষ্ট মণ্ডল নিয়ে অনেক খবর হয়েছে, ওগুলো ছিল গুড় বাতাসা, চড়াম চড়াম ঢাক বাজানো, ইত্যাদি। কিন্তু ওনার নেতৃত্বে বেআইনি টোল চলতো, ওনার ৫/৬/৮/১০টা চালকল ছিল, ওনার মেয়ে স্কুলে না গিয়েই মাইনে পেতেন, এসব খবর আগে হয়নি কেন? সাংবাদিকরা জানতেন? খবর করেননি কেন? একটা কাগজে দেখলাম গত তিন বছরে ৪৫০ কোটি টাকার গরুপাচারের টাকা ভাগ হয়েছে তিন চারজন নেতার মধ্যে, জেনে ফেলেছেন? কখন জানলেন? তখন যখন সিবিআই বা ইডি অনুব্রত মণ্ডলকে জেলে নিয়ে গেছে। তিন বছরে ৪৫০ টাকা লাভের বাঁটোয়ারা। আসুন একটু হিসেব করি। কেনার খরচ, নিয়ে যাওয়ার খরচ, বিএসএফ এবং ওপার বাংলার বর্ডার গার্ডদের ঘুষ, সব বাদ দিয়ে একটা গরুতে কত লাভ থাকতে পারে? গরু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম কম বেশি হাজার দুই টাকা। সেই হিসেব মেনে ৮০ লক্ষ গরু পাচার করলে এই লাভ হবে। এই বিশাল সংখ্যক গরু পাচার হল বাংলাদেশে? সাংবাদিকরা একবারও এই সীমানার বিএসএফ-এর দায়িত্বে থাকা আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা বলছেন না, কিন্তু পাকেচক্রে যদি তিনি জেলে যান, তাহলে শোনা যাবে, তিনিও লুঙ্গি পরে বর্ডারে থাকতেন। একটা করে সিবিআই রেড হচ্ছে, ইডি আসছে, ইনকাম ট্যাক্স আসছে, খবরের বন্যা বয়ে যাচ্ছে।” ইউটিউবে রয়েছে, চেক করে নিন। হ্যাঁ, সেদিনই আমরা বলেছিলাম, এক নেতার চড়াম চড়াম ঢাক বাজানো নিয়ে খবর হোক, রাস্তা জুড়ে উন্নয়ন নিয়ে খবর হোক, গাঁজা কেসে পুরে দেব নিয়ে খবর হোক, কিন্তু এই অভিযোগগুলোর একটার সপক্ষে কেন কোনও তথ্যপ্রমাণ হাজির করা হচ্ছে না? আজ সবটা সামনে। সিবিআই মোদি শাহ শুভেন্দুর ইশারাতে নাচছে আর বড় সংবাদমাধ্যম, তার আরও বড় সাংবাদিক আর অ্যাঙ্করেরা কিসের বিনিময়ে সেই নাচের তাল দেওয়ার জন্য তবলা বাজিয়েছিলেন বা বাজাচ্ছেন, তা আজ স্পষ্ট।