মানুষ চেপে রাখতে পারে না তার মনের গভীরে লালন পালন করা ইচ্ছেগুলো, সে ফাঁকফোকর পেলেই বেরিয়ে আসে। আর শুভেন্দু অধিকারী তো সেই কবে থেকেই এই ইচ্ছে পুষেছেন, বড় করেছেন, চোখের সামনে দেখেছেন মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার, তাঁর সম্মান, তাঁর রোয়াব, তাঁর ক্ষমতা এবং সেসব তাঁর ধমনী শিরার দখল নিয়েছে। কারও কাছে ইচ্ছে হল গঙ্গাফড়িং কারও কাছে ইচ্ছের প্রতিশব্দ মুখ্যমন্ত্রীর গদি, শুভেন্দু অধিকারী সেই গোত্রের মানুষ। মাথা হেলিয়ে দিদি দিদি করতেন, আর বাবাকে শিশিরবাবু বলতেন, আমরা হাসতাম, বাবার চেয়ে দিদি বড়। সেই তিনি ওভারনাইট যখন বলেন মমতাজ বেগম তখন বোঝা যায় পরিষ্কার যে এসবের তৈয়ারি বহত পুরানা, অনেক দিন ধরেই রক্তে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্ম। তো সেই তিনি ভেবেছিলেন আসবেন আর সুনামি হয়ে যাবে, শিকড় উপড়ে পড়ে যাবে এই সরকার, কারণ তার আগেই তো ২০১৯-এ নজরে আছে তাঁর ওই ১৮টা আসন, হিসেবে সেটুকু, মানে ৭ ইন্টু ১৮ ১২৬টা আসন পেলেই তো বাকিদের অপারেশন কমলের টোপ দেওয়াই ছিল, হুউউউস করে চলে আসতো সেই গদিটা। আর সেই সময়েই তো কত উচ্চাকাঙ্ক্ষী সাকরেদও জুটেছিল তাঁর, কিন্তু পোড়াকপাল, হয়নি তো বটেই, ধারকাছ দিয়েও যায়নি তাঁর স্বপ্নের অশ্বমেধের ঘোড়া। ৭৭-এই পপাত চ মমার চ। তারপরে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নাকি? লোকসভাতে ৩৫ চাই, তার আগে এর ঘরে সিবিআই, ওর ঘরে ইডি, তার ঘরে ইনকাম ট্যাক্স ঢুকিয়ে দেওয়ার ভয় দেখানোই নয়, কাজেও করে দেখিয়েছেন। সঙ্গে রাজ্যপাল দুর্দান্ত সঙ্গ দিয়েছেন আর সব মিলিয়ে এক দারুণ আবহও তৈরি, যা দেখেশুনে এগজিট পোলওলারাও শুইয়েই দিল তৃণমূলকে। কিন্তু আবার সেই রামধাক্কা, ৩৫-এর বদলে ১২। রিজেকশন, মুখের উপর সপাটে দরজা বন্ধ হওয়ার তো একটা দুঃখ আছে। সে দুঃখ আরও বাড়ে যখন সে বুঝতে পারে যে এই দরজা খোলার কোনও উপায় নেই, তখন ওই কানের পাশে দপদপ করে, লন্ডভন্ড করতে ইচ্ছে করে বিশ্ব সংসার।
ঠিক সেই সময়ে আমাদের কাঁথির খোকাবাবুর সামনে বিরাট সুযোগ এসে হাজির, এক নৃশংস ধর্ষণ আর খুন, তাকে ঘিরে মানুষের আবেগ, সরকারের বেশ কিছু অর্বাচীন পদক্ষেপ, আর বামপন্থী, লিবারাল ডেমোক্রাটদেরও রুখে দাঁড়ানো, সব মিলিয়ে এক বিরাট মমতা বিরোধী হাওয়া। খোকাবাবুর মনে হয়েছে ব্যস, হাসিনা উপাখ্যান, সব্বাই মিলে গণভবনের জায়গায় নবান্নের দিকে লং মার্চ করবেন আর মমতা হাসিনার মতো হেলিকপ্টারে চড়ে পালাবেন। ব্যস, উনি ওনার সেই বহু প্রতীক্ষিত গদির উপরে গিয়ে বসবেন। এসব উনি ভাবছেন, ভাবুন না, স্বপ্নের পোলাওয়ে ঘি কম দিতে নেই, আরও ঘি ঢালুন, আপনার সেই মন্ত্রিসভাও তৈরি করে ফেলুন যা ২০২১-এ তৈরি করা যায়নি। একজন রাজনীতিবিদ তো এই ক্ষমতার জন্যই লড়াই করেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তো সেই কবে থেকেই জ্যোতিবাবুর উৎখাত চেয়েছেন, জ্যোতিবাবুর পরে বুদ্ধবাবুর পদত্যাগ চেয়েছেন, ৩৫৬ ধারা জারি করার দাবিও করেছেন, এগুলো প্রত্যেক রাজ্যেই হয়। মহারাষ্ট্রের বহু শহর আজও উত্তাল সেখানের ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে, সেখানেও বিরোধীরা শাসকদলের পদত্যাগ চাইছেন। কিন্তু যেটা নতুন, সেটা হল শুভেন্দু অধিকারীর এই আকাঙ্ক্ষা এক মাত্রাছাড়া লেভেলে গিয়ে ঠেকেছে। তিনি খুব স্পষ্টই বললেন, সোমবারে পদত্যাগ করুন না হলে মঙ্গলবারে গুলি চালানোর দায় নিতে হবে। মানে? উনি জানেন মঙ্গলবারে এমন অবস্থা হবে, বা করা হবে যাতে গুলি চলে, যাতে মানুষ মরে, যাতে লাশ হয়ে পড়ে থাকে কিছু মানুষ। উনি সেই লাশের ওপর পা দিয়ে ক্ষমতায় আসবেন, মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসবেন? কী চাইছেন?
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | আরজি কর কাণ্ডে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই বিরাট বিপদে
আমাদের বিচারকরা, বিচার ব্যবস্থা পদে পদে কত কিছু নিজেরাই বুঝে ফেলেন, কতকিছু নিয়েই নিজেরাই আগ বাড়িয়ে যাকে ভালো ভাষায় বলা হয় সুয়ো মোটো মামলা হাতে নেন, নির্দেশ দেন, তাঁরা কিছু বলবেন না। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা প্রকাশ্যে ব্ল্যাক মেল করছে সরকারকে, বলছে মঙ্গলে লাশ পড়বে, দায় নিতে হবে আপনাদের। আদালত পাত্রাধারে তৈল না তৈলাধারে পাত্রের বিচার করছেন, টাইম ফ্রেম মেলাচ্ছেন, কোন ঘটনা কখন রেজিস্টার হয়েছে, ক্লারিকাল মিসটেক খুঁজে বার করা হচ্ছে। হোক না, কিন্তু এটা কি তারচেয়েও বেশি জরুরি নয় যে একজন কেবল রাজনৈতিক নেতা নন, বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা যিনি মর্যাদায় একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর সমকক্ষ তিনি বলছেন মঙ্গলবারে গুলি চলবে, লাশ পড়বে, তার দায় নেওয়ার আগেই সোমবারে জনগণের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করুন। এটা বলা যায় নাকি? এটা বলার পরেও তিনি স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াবেন, এটা কি কাশীর গলি? আচ্ছা এর জবাবে যদি মুখ্যমন্ত্রী বলেন বা কোনও মন্ত্রী বলেন যে বেশ তো আমাদের সমর্থক কর্মীরাও রাস্তায় থাকবেন ওই গুলি যাতে না চলে সেটা দেখার জন্য, তাহলে কেমন দাঁড়াবে? শাসকদলের কেউ যদি বলেন সেদিন আমরাও মাঠে থাকব, কিছু ঘটলে, মানে লাশ পড়লে দায় শুভেন্দুর, তাহলে কেমন হবে? এটা কি জঙ্গল নাকি? যে যার মতো লড়ে ঠিক করে নেবেন কে সঠিক, কে নেতা হবে? ন্যূনতম গণতান্ত্রিক বিচার বোধ থাকলে এমন কথা বলা যায়? এই কথা বলার জন্য এই ক্ষমতালোভী উন্মাদকে জেলে না পুরে অবাধে বিচরণ করতেই বা দেওয়া হচ্ছে কেন? কলকাতা পুলিশ কাজ করছিল, কিছু মানুষের মনে হয়েছে তারা আড়াল করতে চায় গোটা ঘটনা, তারা মামলা নিয়ে গেছে হাইকোর্টে, সেখানে তাদের এবং সরকার পক্ষের বক্তব্য শোনার পরে তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে সিবিআই-এর হাতে, যে সিবিআই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের অধীনে। সেই সিবিআই ৮ দিন হয়ে গেল, জেরা করে, তদন্ত চালিয়ে এক পিস নতুন তথ্য এনে হাজির করতে পারেনি, পারেনি বলে কি পারবে না? পারুক না। প্রমাণিত হোক যে রাজ্য সরকার এই জঘন্য অপরাধীকে আড়াল করার চেষ্টা চালাচ্ছিল।
এদিকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত মামলা হাতে নিয়েছে, সেখানে শুনানি চলছে, বিভিন্ন টেকনিক্যাল ইস্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা নিশ্চয়ই এই বিষয়গুলোও দেখবেন। তাঁদের মতে সরকার, তার মন্ত্রী পুলিশ দোষী হলে শাস্তি পাবে, তেমন হলে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হবে, এসব তো সংবিধানে আছে, হয়েছে অনেকবার, আবার হবে। কিন্তু তাই বলে মঙ্গলে গুলি চলবে মানুষ মরবে কাজেই সোমবারে পদত্যাগ করুন, এটা আবার কোন দেশের আইন মেনে কথাবার্তা? বিজেপি রাজ্য জুড়ে ধরনা চালাতেই পারে, যেমনটা তাঁরা করছেন শ্যামবাজারে, তা সারা রাজ্যে করতে পারেন, মিছিল মিটিং, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি এসব তো করাই যায়, সেগুলো স্বাভাবিক, কিন্তু ফাঁকতালে গদিতে বসে পড়ার যে ইচ্ছে তিনি সবার সামনে তুলে ধরছেন তা ভয়ঙ্কর। গণতান্ত্রিক কাঠামো সম্পর্কে সামান্যতম শ্রদ্ধা থাকলে কেউ এ ধরনের কমেন্ট করতে পারত না। আমাদের দেশটা বাংলাদেশ নয়, আমাদের দেশ কেবল গণতান্ত্রিকই নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনই নয়, আমাদের দেশে এক সংবিধান আছে, এমনকী সংখ্যাগরিষ্ঠদেরও ওই সংবিধান মেনেই চলতে হবে, এটাকেই প্রজাতন্ত্র, রিপাবলিক বলে। ওনাদের, মানে ওই শুভেন্দু অ্যান্ড কোম্পানির বহু ইচ্ছে থাকলেও মমতা সরকারকে বরখাস্ত করতে পারেননি, তার কারণ ওই সেই সংবিধান। সেটা আমাদের রাজ্যপাল, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী জানেন, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য সেটা জানেন না আমাদের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, জানেন না বলেই বেয়নেটের নাকের ডগায় ছিনতাই করতে চান এক নির্বাচিত সরকারকে। আমাদের তীব্র বিরোধিতা আমরা জানিয়ে রাখলাম। মমতার সরকার যদি ভুল করে থাকে, এই ধর্ষণ আর হত্যা যদি আরও বড় কোনও দুর্নীতির পরিকল্পনা হয়, যদি সেই দুর্নীতি ঢাকার চেষ্টা করে থাকেন বর্তমান রাজ্য সরকার, তাহলে সেই সরকার চলে যাক, কিন্তু লাশ পড়বে তাই নির্বাচিত সরকারের মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করবেন, এ তো হতে পারে না।