শুভেন্দু অধিকারী মুসলমান ঘৃণাকে অস্ত্র করে নিজের মাথা বাঁচাতে চাইছেন। প্রথমে একবার শুনে নিন উনি ঠিক কী বলেছিলেন গতকাল সায়েন্স সিটির অডিটোরিয়ামে, যেখানে মনোহরলাল খট্টর থেকে সুনীল বনসল, মঙ্গল পান্ডে, রাজ্য বিজেপির প্রায় প্রত্যেক নেতা হাজির ছিলেন। যে কথাগুলো বললে যে কোনও সভ্য দেশে, সেই কথা বলার জন্য বাকি জীবনটা জেলে কাটাতে হতে পারে সেই কথাগুলো আমাদের দেশে বলে বেবাক পার পাওয়া যায় কেবল নয়, সেসব কথা বলার জন্য তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন, তাঁর সেসব কথায় হাততালি পড়ে তিনি সেসব কথা বলে গর্বিত হন, তাঁর সেসব কথা বড় করে ছাপা হয়, তিনি সেসব কথা বলেও দেশের রাজনৈতিক সামাজিক পরিসরে দিব্যি টিকে থাকেন। ধরুন আমাদের রাজ্যের বিধানসভার দলনেতা যিনি আমাদের সাংবিধানিক কাঠামোতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পদমর্যাদা পান, সেই শুভেন্দু অধিকারী, তিনি কোনও গোপন সভায় নয়, প্রকাশ্য সভাতে বলেন হিন্দুদের বাঁচাব, সংবিধান বাঁচাব, রাষ্ট্রবাদী মুসলমান বলে কিছু হয় না, সবকা সাথ সবকা বিকাশ বন্ধ করুন, সংখ্যালঘু মোর্চা চলবে না। প্রকাশ্যেই রাজ্যের কমবেশি ৩০ শতাংশ মানুষের বিরুদ্ধে বিষ উগরে দিলেন। কেন? কারণ তিনি মনে করেন এই বাংলা, এই রাজ্য মুসলমানদের দখলে চলে যাচ্ছে, কেবল মুসলমানদের ভোটে জিতছে শাসকদল, হিন্দুদের ভোট দিতে দেওয়া হচ্ছে না, তাই এ রাজ্যে বিজেপি হারছে।
কী নিয়ে বলতে উঠেছিলেন তিনি? রাজ্যে নির্বাচনে তিনি দিল্লির নেতাদের বুঝিয়েছিলেন ইডি পাঠান, সিবিআই পাঠান, ব্যতিব্যস্ত করুন শাসকদলকে, পেটোয়া মাইনে করা মিডিয়া আর ইউটিউবারদের দিয়ে চোর চোর রব তুলে হারিয়ে দেব তৃণমূলকে। মানুষ ওঁর এই ইচ্ছের গোড়ায় টন টন গ্যামাক্সিন ঢেলে ১৮ থেকে ১২-তে নামিয়ে দিয়েছে, কেবল তাই নয় বুঝিয়ে দিয়েছে যে এ রাজ্যে কংগ্রেস তৃণমূল জোট হলে ওই সংখ্যাটা অনায়াসে ৭ কি ৮ হয়ে যেত। শর্টকাটে বঙ্গজয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন শুধু নয়, দেখিয়েছিলেন, কাজেই এবারে কিছুটা হলেও জবাবদিহির পালা, তার আসর বসেছিল আজ সায়েন্স সিটিতে। বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব হাজির ছিলেন, তিনি উঠেই প্রথমে নিজের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেললেন, সাফ বলে দিলেন আমি সংগঠনের দায়িত্বে ছিলাম না, আর তাই সংগঠন নিয়ে যা বলার তা দিল্লিতে গিয়ে অমিত শাহকে, সুনীল বনসলকে বলে এসেছি, এখানে বলব না। কিন্তু তা বললে তো হবে না, কিছু তো বলতেই হবে, তাই তিনি যা বললেন তার দুটো দিক হল এক) আমাদের রিগিং করে হারানো হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা ছিল না, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। ২) মুসলমানরা আমাদের বিরুদ্ধে, তারা দল বেঁধে রিগিং করেছে, লোকসভা, বিধানসভা উপনির্বাচনে, হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধ নয়, তাই বিজেপি এ রাজ্যে হেরেছে। একে তো অশিক্ষিত, তায় গোঁয়ার, কাজেই এরকম এক সিদ্ধান্তে পৌঁছনো খুব স্বাভাবিক। খেয়ালই করলেন না যে অযোধ্যা সংলগ্ন ফৈজাবাদ তো বটেই, তাছাড়াও প্রায় সবক’টা আসনে বিজেপি হেরেছে, রামেশ্বরম থেকে চিত্রকূট হেরেছে, সবকটা লোকসভা আসন জেতার পরেও উপনির্বাচনে উত্তরাখণ্ডে বিজেপি হেরেছে, হিমাচলপ্রদেশে হেরেছে।
এবং মজার কথা হল কীভাবে তাহলে তিনি এখানে জিতবেন? এখানে নাকি উপদ্রুত অঞ্চল আইন আফস্পা, আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট লাগু করে ভোট করতে হবে। যে আইন কাশ্মীরে প্রয়োগ করা আছে, মণিপুর বা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গাতে ব্যবহার করা হয়েছে সেই আইন তিনি এই বাংলাতে জারি করে নির্বাচন চাইছেন। মানে রাজ্য সরকার থাকবে আর পুরো এলাকার দায়িত্বে থাকবে সিআরপিএফ, মিলিটারি, চাবিকাঠি থাকবে শান্তিকুঞ্জে একমাত্র তবেই তিনি ৩৫টা আসনে জিততে পারবেন। আসলে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর ন্যূনতম ভরসা না থাকলে এরকম কথা বলাটাই স্বাভাবিক। একবার চেষ্টা করে দেখুন, তমলুক আসনটাও বাঁচাতে পারবেন না, যেটুকু বচাখুচা বাম লিবারাল ভোট বিরুদ্ধে পড়েছে বা নোটায় গেছে বা পড়েনি, সেটাও জমা হবে ওই তৃণমূলে। তিনি আরও বেশি হিন্দু হতে চাইছেন, বলেই দিলেন সংখ্যালঘু মোর্চা চাই না, রাষ্ট্রবাদী মুসলমান বলে কিছু হয় না, তাহলে পয়সা দিয়ে যে ইউটিবারকে পুষেছেন সেই ইউটিউবারের কী হবে? ওঁর দলের সর্বোচ্চ নেতা নরেন্দ্র মোদি এখনও, অন্তত মুখে বলে চলেছেন সবকা সাথ সবকা বিকাশ, শুভেন্দু বলছেন চাই না, সম্ভব নয়, ২০১৪ সালেই মোদী ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ স্লোগান দিয়েছিলেন। তিনি বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সব শ্রেণি, বর্ণ, সম্প্রদায়ের মানুষের বিকাশ বা উন্নতিই হবে তাঁর শাসনের মন্ত্র। পাঁচ বছর পরে ২০১৯ সালে মোদি এই স্লোগান নিয়ে ভোটের প্রচারে নেমেছিলেন যে, তিনি সকলের বিকাশ বা উন্নতি করতে পেরেছেন। সেই সময়ে সামগ্রিকভাবেই বিজেপির স্লোগান হয়ে ওঠে ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’। মানে যেটা ছিল সরকারের স্লোগান, সেটাই হয়ে উঠল দলের স্লোগান। কোনও দিন সংগঠনের কোনও স্তর থেকেই ওই স্লোগানের সমালোচনা হয়নি।
আরও পড়ুন: রেখা পাত্র, রাজমাতা অমৃতা রায় আর একদা বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলি
২০১৯ সালে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে মোদি স্লোগানটি আরও বড় করেন। জোড়া হয় সবকা প্রয়াস, সবকা বিশ্বাস। কাঁথির খোকাবাবু বললেন, নো নিড ফর সংখ্যালঘু মোর্চা, সংখ্যালঘু মোর্চার ইংরিজিটা ওনার মনে ছিল না, বা ওটা উনি জানেনই না। কিন্তু এখনও রাজ্যে কেবল নয় সারা দেশেও বিজেপিরও এক সংখ্যালঘু মোর্চা আছে, রাজ্যের সংখ্যালঘু মোর্চার সভাপতি চার্লস নন্দী, প্রত্যেক জেলার সংখ্যালঘু মোর্চার সভাপতি নিয়োগ করেছেন, ১৮ জন মুসলমান, এঁরা কি তাহলে বাদ পড়লেন? বিজেপি অন্তত মুখে মুসলমানদের এক অংশকে রাষ্ট্রবাদী বলে মনে করে, উনি সাফ জানিয়েই দিলেন ওসব হয় না, উনি বাঁচাবেন কেবল হিন্দুদের আর সেটাই নাকি সংবিধান বাঁচানোর উপায়। গোটা সংবিধান পড়া ওঁর পক্ষে সম্ভব নয়, যদিও বা পড়ে ফেলেন ওঁর মেধায় তা বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। কিন্তু কেবল সংবিধানের প্রিয়্যাম্বল তো কেউ ওঁকে পড়ে শোনাতে পারেন, তিনি নাকি বিধানসভাতে বিরোধী দলের নেতা। তিনি নিজের বংশপরিচয় দিচ্ছিলেন আজকের মিটিংয়ে, বিরাট বড় বংশে বেচারাম নাকি কেনারাম বংশে তাঁর জন্ম, সেটাও যদি ভালো করে জানতেন যে ওঁর ঠাকুরদা যদি সত্যিই ওঁর কথা অনুযায়ী কংগ্রেসের হয়ে জেল খেটেছেন, আন্দোলন করেছেন তাহলে সেই কংগ্রেসের ভারত ছাড়ো আন্দোলন যার এ বাংলায় কেন্দ্রবিন্দু ছিল ওই মেদিনীপুর সেই আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ইংরেজদের চিঠি লিখে সাহায্য করার কথা বলেছিলেন।
হয় তিনি তাঁর বংশের ইতিহাস ঠিক করে জানেন না, আর না হলে মেদিনীপুরের ইতিহাস তিনি পড়েননি। যে রামধাক্কা খেয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এখন সংবিধানকে মাথায় ঠেকাচ্ছেন, ওই মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেবে, গরু মোষ কেড়ে নেবে বলা বন্ধ করেছেন, যেখানে দল থেকে কেবল নয়, আরএসএস থেকেও কোর্স কারেকশনের চেষ্টা করা হচ্ছে সেখানে ইনি, মানে কাঁথির মেজবাবু বক্তৃতা শুরু করেছেন হিন্দু তুমি এক হও বলে। বিজেপির জন্মের সময় থেকেই দলের সাতটি মোর্চা রয়েছে। মহিলা, যুবর মতোই প্রতিটা রাজ্যেই গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন হিসেবেই ধরা হয় সংখ্যালঘু মোর্চাকে। যদিও গত কয়েক বছর ধরেই রাজ্য বিজেপি সংখ্যালঘু মোর্চাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না, কিন্তু তা আছে, জেলায় জেলায় সভাপতি আছে। এখন ওই মোর্চার রাজ্য সভাপতি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের চার্লস নন্দী। ২০১৯ সালেও রাজ্য থেকে দু’জন সংখ্যালঘু সাংসদ ছিলেন। তাঁদের মধ্যে এ বার জন বার্লাকে প্রার্থী করা হয়নি। হেরে গিয়েছেন এসএস অহলুওয়ালিয়া। তবে গোটা দেশে দল যে কাঠামো অনুযায়ী চলে, সেটা বন্ধ করার প্রস্তাব এমন খোলাখুলি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে রাজ্য বিজেপিতে। রাজ্যের এক প্রবীণ বিজেপি নেতার অবশ্য বক্তব্য, ‘‘অতীতে হয়নি এমন অনেক কিছুই তো আজকাল হচ্ছে! জানি না, দলের রীতি এমনভাবে ভাঙা যায় কি না।” দলের বিভিন্ন স্তরে এ নিয়ে তীব্র আলোচনা শুরু হয়েছে। শুভেন্দুর ঠিক আগেই সুকান্ত তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন মোদীর ‘নীতি ও নেতৃত্ব’ মেনে এগিয়ে চলতে হবে, আর তার ঠিক পরেই শুভেন্দুর এই ধরনের কথা সবাইকেই ব্যাকফুটে ফেলে দিয়েছে। শুভেন্দুর এসব ভাট কথাবার্তা শোনার পরে বক্তৃতা দিতে উঠে মোদি মন্ত্রিসভার সদস্য খট্টরও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই বিজেপি আগামী দিনে কাজ করবে বলে, দেশ যশস্বী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেই আছেন ইত্যাদিও বলেন। কিন্তু তিনি শুভেন্দুর মন্তব্যের পাল্টা একটি শব্দও খরচ করেননি। সেটা কেন? কারণ এই বক্তব্য নিয়ে দিল্লির নেতৃত্ব মোদি-শাহ সিদ্ধান্ত নেবেন, জবাবদিহি চাইবেন? জানা নেই, কিন্তু লোকসভায় হারের পর নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে শুভেন্দু যা করলেন তাতে দলের মধ্যে তাঁর উচ্চতা কমবে, আগামী দিনে তিনি আরও ল্যাজেগোবরে হবেন, কোণঠাসা হবেন।