এক কথায় যদি বলতে হয় দেশের আর পাঁচটা দলের সঙ্গে বিজেপির ফারাকটা ঠিক কোথায়? তাহলে তার উত্তর হল, বাকি পাঁচ কেন? সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করা বাকি সব দল, দেশের সংবিধান, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, দেশের ঐতিহ্য, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র নিয়ে যা ভাবে, বিজেপি তা ভাবে না। বিজেপির কাছে স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনও অর্থই নেই, কারণ তাদের পূর্বসূরিরা কেউ কেউ স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, বাকিরা স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেননি, আরএসএস-এর নির্দেশ মেনেই হাত মিলিয়েছিলেন ইংরেজদের সঙ্গে। তীব্র ঘৃণা গান্ধী, নেহরু, কংগ্রেসের জন্য, কমিউনিস্টদের সঙ্গে শত্রুতা, ধর্মনিরপেক্ষতা কোনওদিনই তাদের সিলেবাসে ছিল না। তারা সংবিধান সভায় যোগ দেয়নি, সংবিধান প্রণয়নে তাদের কোনও ভূমিকাই নেই, তীব্র মুসলমান বিরোধিতা ছিল তাদের দর্শনের ভিত্তি। স্বাভাবিকভাবেই সেই ঐতিহ্যকেই বিজেপি বহন করে চলেছে, সংঘ পরিবারের প্রত্যক্ষ নির্দেশে, সেই দর্শনকেই তারা আঁকড়ে ধরেছে।
সেই দর্শন মেনেই তারা গান্ধী-নেহরুকে বিশ্বাসঘাতক বলে, গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসের পুজো করে, সেই দর্শন মেনেই তারা ইংরেজদের কাছে মুচলেকা দিয়ে, জেল থেকে বের হওয়া সাভারকরকে তাদের গুরু হিসেবে মান্য করে। সেই দর্শন মেনেই তারা দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাকে অস্বীকার করে, সেই দর্শনকে সামনে রেখেই তারা হিন্দু রাষ্ট্রের ছক কষে, সেই একই দর্শনের ভিত্তিতেই মুসলমানদের এদেশের নাগরিক হিসেবে মানতে চায় না, তাদেরকে এদেশে থাকতে হলে, হিন্দু নিয়ম নীতি রীতি মেনে চলার ফতোয়া দেয়।
এবং খেয়াল করে দেখুন, কত সুন্দর এক মুখোশের আড়ালে তারা নিজেদের রেখেছিল, তাদের আসল পরিচয়, তাদের এই সংবিধানের প্রতি ঘৃণা, তাদের নাথুরাম গডসে প্রীতি, কত সুন্দরভাবে আড়ালে রেখেছিল। যত দিন যাচ্ছে, সংসদীয় গণতন্ত্রে সংখ্যার গরিষ্ঠতা পাচ্ছে, ততই আসল রূপ ফুটে বের হচ্ছে। শুনেছিলেন নাকি লাভ জেহাদের কথা ১৯৯০-এ? শুনেছিলেন নাথুরাম গডসে পুজো করার কথা? শুনেছিলেন কখনও সেকুলার শব্দ নিয়ে ব্যঙ্গ, ঠাট্টা? এসব এখন সামনে আসছে, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও তারা তাদের নিজেদের মতোই লিখতে চাইছে, বলছেও। তার জন্য ভাড়া করা ইতিহাসবিদ থেকে চলচ্চিত্র পরিচালক, লেখক থেকে সাংবাদিক জড়ো করা হচ্ছে। আরএসএস-বিজেপির এই বিরাট পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আর পাঁচটা দল তাহলে করছেটা কী? মানে সেদিক থেকে দেখতে হলে এক আগ্রাসী হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলের বিরুদ্ধে সাধারণভাবে সেকুলার, গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতাতে বিশ্বাসী মানুষজন তাহলে করছেটা কী?
কিছুদিন আগেই আমরা দেখলাম এক গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি সব্বাইকে নিয়ে এক গ্র্যান্ড ওল্ড অ্যালায়েন্স বানাল। প্রাথমিকভাবে সাড়া উঠল আর তারপরেই আবার যে কে সেই। জলসাঘরের বিশ্বম্ভর রায়ের কথা না পড়লে সত্যজিৎ রায়ের জলসাঘর আবার দেখে নিন। এক জমিদার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব খুইয়েছে, কিন্তু তাঁর মেজাজ এখনও সেই পুরনো দিনের মত রয়ে গেছে, যখন প্রজাদের কারও বিয়ে, উপনয়ন, অন্নপ্রাসনে সোনার গিনি উপহার দেওয়া হত, যখন জমিদারের সঙ্গে ঘুরত পাইক বরকন্দাজ, যখন জমিদারবাবুই ছিলেন এলাকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। কংগ্রেসকে দেখলে আমার সেই জলসাঘরের বিশ্বম্ভর রায়ের কথাই মনে হয়। কর্নাটকে জয়, তেলঙ্গানার জয়, আচ্ছা মেনেই নিলাম বিরাট জয়, কিন্তু তারপর, নিজের অন্তঃসারশূন্য কঙ্কালটা না দেখালেই নয়। রাজ্যের সেবা, দেশের সেবা, নফরত কা বাজার মে মহব্বত কা দুকান ইত্যাদি বাওয়ালের পর আপাতত ডি কে শিবকুমার আর সিদ্দারামাইয়ার মধ্যে যে আকচা আকচি চলছে তা তো নতুন কেনা ক্যাম্বিজ বল নিয়ে বাচ্চাদের লড়াইকেও হার মানাবে। এরই মধ্যে হালকা স্পিন দিলেন ডি কে শিবকুমার, কর্নাটকের জয়ের পরেই আবার জোটের কথা বললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং বললেন কংগ্রেসকে সমর্থন করব, কিন্তু বদলে কংগ্রেসকেও সমর্থন করতে হবে। কংগ্রেসের কেউ বলার আগেই ডি কে শিবকুমার এই বক্তব্যকে সমর্থন করলেন, অতএব তড়িঘড়ি সেই সমর্থন এল খাড়্গে সাহেবের কাছ থেকেও। জলসাঘরের আরেক জমিদার, অধীর চৌধুরী ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছেন, কর্নাটকে আমরা চোরেদের বিরুদ্ধে লড়ে জিতেছি। এ রাজ্যেও দুর্নীতিবাজ তৃণমূলের বিরুদ্ধে জিতব, বিধানসভায় সবেধন নীলমণি বায়রন বিশ্বাস ইতিমধ্যে খসে গেছে এবং হেরেছেন অধীর নিজেই, বাদাম না বেচে উনি রাজনীতিই করছেন। সব্বাই জানে কংগ্রেস দলে ওই খাড়্গে সাহেব দলের সভাপতি এসব ফাঁকা বুলি, আইওয়াশ, বকওয়াস। আদতে দল চলছে রাহুল-সোনিয়ার কথায়, তাঁদের নির্দেশে। অতএব রাহুলের সঙ্গে বৈঠক, সোনিয়ার ফোন, শেষে ফুলের বোকে, দুজনের সঙ্গে ছবি, তুমি কি কেবলই ছবি? সারা দেশের বিজেপি বিরোধী মানুষজন একটু হাঁফ ছেড়ে ভাবছিলেন, এবার ঘুরে দাঁড়াবেন বিশ্বম্ভর রায়, থুড়ি কংগ্রেস। কোথায় কী? রাজস্থানে হার, মধ্যপ্রদেশে হার তবুও চোখ খুলল না। ইন্ডিয়া জোট হিসেবে নয়, জোট বিরাটভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ল? তাও নয়।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | দেশের চারপাশে শত্রু তৈরি করতে এক নরেন্দ্র মোদিজি যথেষ্ট
রুখে দাঁড়াল মানুষ, বিজেপি আটকে গেল ২৪০-এ, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে অনেক দূরে, কিন্তু সেদিন থেকেই তারা মেরামতির কাজে নামলো আরও নতুন স্লোগান, আরও তীব্র হিন্দুত্বের প্রোগ্রাম নিয়ে নামল আরএসএস-বিজেপি সংঘ পরিবার। কংগ্রেস, জলসাঘরের জমিদার লোকসভার নির্বাচনে ১০০ ছুঁয়েই বেজায় খুশি, গড়গড়া টানতে বসল। ঘুম থেকে উঠে হরিয়ানার নির্বাচন। তো সেখানে আপ বা সমাজবাদী পার্টিকে পাত্তাও দিল না কংগ্রেস, তারপর হেরে ভূত, একই অবস্থা মহারাষ্ট্রে, এখন ইভিএম আর ভোট লুঠের গল্প বলে নিজেদের পিঠ নিজেরাই থাবড়াচ্ছে। প্রবল হিন্দুত্ববাদী বিজেপির বিরুদ্ধে আদিবাসী আইডেন্টিটিকে দাঁড় করিয়ে হেমন্ত সোরেন লড়াইটা দিলেন, জিতলেন। তারপর শপথগ্রহণের দিনে বিরাট হাত ধরাধরি ছবি। ফিরে এলেন সব্বাই, আপ সাফ জানিয়ে দিয়েছে তারা দিল্লির ভোটে ওই ইন্ডিয়া জোট ইত্যাদিতে নেই, তারা একলাই লড়বে। রাহুল গান্ধী ঢুকছেন ছবিটা দেখবেন, যেন এক বিরাট জয়ের পর আলেকজান্ডারের প্রবেশ। পার্লামেন্টে মমতা আর এসপি নিজেদের ইস্যু তুলছেন, তুলছেন কারণ তাঁদের রাজ্যের রাজনীতিতে টিকে থাকতে হবে। সমাজবাদী দলকে সম্ভবলের ইস্যু তুলতে হবে, ওরা জানে যে আদানি ভোটে পেট ভরবে না। কংগ্রেস তার তালে আছে। এবং কে সি ভেনুগোপাল এই সমস্যার মধ্যে অনেক সম্ভাবনাও নাকি খুঁজে পাচ্ছেন। যে সম্ভাবনা কংগ্রেস খুঁজে পেয়েছিল সেই কবে পঞ্জাবের মাটিতে। বনা কে কিউ বিগাড়া রে, বিগাড়া রে নসিবা, উপরওয়ালে, উপরওয়ালে। ‘জঞ্জির’ ছবিতে গেয়েছিলেন নায়িকা জয়া বচ্চন। ভাগ্য বিপর্যয়ের জন্য প্রশ্ন করছিলেন ভগবানকে, সব দিয়েও কেন সব কেড়ে নিলে ভগবান। কিন্তু কংগ্রেসের সে সুযোগও নেই, ভগবানের কোনও হাতই নেই নিজলিঙ্গাপ্পার দল নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য বিপর্যয় ডেকে এনেছে বহুবার। মনে করুন পঞ্জাবের কথা। পঞ্জাবে কংগ্রসের জেতাটা ছিল সময়ের অপেক্ষা। অমরিন্দর সিংয়ের বিরুদ্ধে মানুষের তেমন বিরাট অভিযোগ ছিল না। মাঠে নামলেন সিধু পাজি এবং রাহুল গান্ধী, ব্যস বনা বনায়া খেল ভোগে চলে গেল। আগামী ১০ বছরেও পঞ্জাবে কংগ্রেস কিছু করে উঠতে পারবে? মনে হয় না। উপনির্বাচনের ফল তাই বলছে। সিধু পাজি জেল থেকে বেরিয়ে কপিল শর্মা শোতে আবার ফিরে গেছেন।
একই রাজনীতি এর আগে মধ্যপ্রদেশে আমরা দেখেছি, মাধব রাও সিন্ধিয়া আর কমল নাথের লড়াই, শরিকি লড়াই, কে বসবেন গদিতে তার লড়াই এবং শেষমেশ সিন্ধিয়া পুত্র গেলেন বিজেপিতে। টিম রাহুলের একখানা জ্যোতিষ্কই শুধু খসল না, মধ্যপ্রদেশ বিজেপির হাতে। গুজরাটে টিম রাহুলে ছিলেন হার্দিক প্যাটেল, তিনি বিজেপিতে, ক্ষত্রিয় ঠাকোর সেনার অল্পেশ ঠাকুর হতেই পারতেন কংগ্রেসের সম্পদ, ছিলেনও। তিনি চলে গেছেন, টিম টিম করে জ্বলছেন জিগনেশ মেওয়ানি। এ বাংলায় বিধানভবনে রোজ ঝাড়ু পড়ে? আমার তো সেটাই মাঝেমধ্যে জানতে ইচ্ছে হয়। অধীরবাবু কথা বলার সময় তাঁর দুটো হাতকে যেভাবে নাড়ান সেভাবে যদি বাংলা কংগ্রেসকে নাড়ানো হয়, তাহলে দু’ চারজন প্রবীণ নেতা এবং কিছু খুচরো পয়সা ছাড়া ঝরে পড়ার আছেটা কী? দায়িত্ব পেয়েছেন শুভঙ্কর সরকার, কোথাও একটা কি সন্ধির পতাকা হাতে আছে? দেখতে হবে। ওড়িশায় কংগ্রেসকে পিছনে ফেলে বিজেপি চলে এসেছে প্রথম স্থানে। উত্তর পূর্বাঞ্চলে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কংগ্রেস। গোয়াতেও সেই একই ব্যর্থতা। কেরালাতে বামেদের সঙ্গে লড়াই, দিল্লি তো এখন বেসন কা লাড্ডু। তাহলে? তাহলে ওই সিনেমার দিকে আবার চোখ রাখুন, খুঁটিয়ে দেখুন জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের চরিত্রটাকে। হাত কাঁপছে, গলা শুকিয়ে গেছে, দৃষ্টি ঘোলাটে, কিন্তু মেজাজ বরকরার। তিনি এখনও জমিদার। কংগ্রেসের সঙ্গে বড্ড মিল। কিন্তু অমিলও আছে, বিশ্বম্ভর রায়ের কোনও ভবিষ্যৎ ছিল না, দৃশ্যতই তাঁর পাশে কেউ নেই, তিনি একলা, তাঁর শেষ হয়ে যাওয়াটাই ডেসটিনি, তাঁর উত্থান সম্ভব নয়। কিন্তু কংগ্রেসের? এখনও দেশের ২২-২৫ শতাংশ মানুষ তাদের সমর্থন করেন, এখনও মানুষ কংগ্রেসের উদার গণতান্ত্রিক অবস্থানের অপেক্ষায় বসে আছেন, এই তীব্র সাম্প্রদায়িক আবহ, এই জঙ্গি জাতীয়তাবাদের বিরদ্ধে রুখে দাঁড়াবে তারা, মানুষ সেটাই চাইছে। খুব স্পষ্ট যে তারা একটু ধরে খেললেই তাদের উত্থান সম্ভব। এতকিছুর পরেও সেটাই সত্যি।
একটা জাতীয় দল হিসেবে তাদের নেতৃত্ব দেবার অধিকার আর ক্ষমতা দুটোই রয়েছে, কেবল ওই জমিদারি মেজাজ ছাড়তে হবে। থামাতে হবে এই কোন্দল। কেবল পাঁচ গ্যারান্টি সে কাম নহি চলেগা। ফ্রি র্যাশন, বাসে মহিলাদের ফ্রি টিকিট, ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ফ্রি, বেকার ভাতা আর মহিলাদের ৩০০০ টাকা দিলে আপাতত গরিবের ভোট পাওয়া যায়, কিন্তু এই কোন্দল চলতে থাকলে সরকার চালানো তো যায়ই না, তৈরি করা সরকারও পড়ে যায়। আর ঠিক সেই দিকেই তাকিয়ে আছে বিজেপি, কড়া নজর তাদের আছে প্রত্যেক উচ্চাকাঙ্ক্ষীর দিকে, যে কোনও মুহূর্তে উইকেট পড়ে যাবে, আজ যাঁকে দেখে মনে হতেই পারে, ইনি? ইনি যোগ দেবেন বিজেপিতে? ঘুরিয়ে দেবেন খেলা? ধ্যাৎ তা হতেই পারে না। সেই তিনিই এক সকালে টুপ করে ঝরে পড়বেন বিজেপির কোলে, পাকা আমের মতো। তারপর আম কেটে, চুষে, চেটে খাওয়ার সব তরিকা বিজেপির, মোদি-শাহের জানাই আছে। সব থেকে বড় কথা মানুষের অবিশ্বাস, মানুষ মনেই করছেন এখনও এই শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেস দল এক পরিবারের নেতৃত্ব ছাড়া এক পাও চলতে পারে না, এবং নেতারা গদির জন্য আকচা আকচি করেন। দ্বিতীয়ত যে ফাটল রয়ে গেল যা ধামাচাপা দেওয়া হল, যে ফুটো বস্তা দিয়ে আপাতত ঢাকা হল তা যে কোনও মুহূর্তে আবার বিরাট আকার নিতে কতক্ষণ। বিভীষণকে চিহ্নিত করা আর তার কাছে উপযুক্ত উপঢৌকন নিয়ে হাজির হওয়া, ব্যস, যুদ্ধ জয় আর আটকায় কে? তখনও জমিদার বিশ্বম্ভর রায় ভেলভেটের বটুয়া হাতড়াবেন, গিনি মোহরের কথা ভাববেন, গুনবেন আর বলেই যাবেন, সে এক দিন ছিল, বুঝলেন…। বুঝবেন কে? সামনে তো কেউ নেই।