ক’দিন আগে দলের বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়ে কথা বলছিলেন শান্তনু সেন। আরজি কর কাণ্ডে অস্বস্তি বাড়িয়ে মাত্র ক’দিন আগে ডঃ সেন সেদিন উল্টো শিবিরের হয়ে চোখা চোখা অস্ত্র ছুড়ছিলেন। সেই তিনিও ঘণ্টা তিনেক অপেক্ষা করলেন কালীঘাটে একবার যুবরাজের সামনে গিয়ে হ্যাপি বার্থডে বলার জন্য। ঘণ্টা তিন সাড়ে তিন অপেক্ষা করার পরে হলেও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আসলেন হাসলেন, হ্যান্ডশেক করলেন, শুভেচ্ছা নিলেন। ঘর ওয়াপসির পথে এক ধাপ এগিয়ে ডঃ সেন ফিরে গেলেন নিজের ঘরে। তখনও কালীঘাটে সদ্য বিদেশ থেকে চোখের চিকিৎসা করে ফিরে আসা তৃণমূল দলের জেন নেক্সট লিডার শুভেচ্ছা আর অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসছেন। তৃণমূলের সেই ঝোড়ো উত্থানের দিনগুলোতে তিনি ছিলেন? ২০০৭? ২০০৮? সদ্য কৈশোর পার করা সেদিনের অভিষেক রাস্তায় ছিলেন না, ঘরে উত্তাপ পৌঁছেছে, নিশ্চয়ই আঁচ পেয়েছেন, কিন্তু সেদিন তৃণমূলের নেতৃত্বের স্তরে যাঁরা ছিলেন তাঁদের প্রায় সবাই নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছেন দলের এই তরুণ তুর্কির নেতৃত্ব। উত্তর থেকে দক্ষিণে পদযাত্রা করেছেন, দলের দফতরের বাইরে নিজের দফতর চালিয়েছেন, সমান্তরাল গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। তাঁদের অনেকের প্রকাশ্যে ঘোষণা, ইনিই হবেন আগামী মুখ্যমন্ত্রী, বিশ্বের রাজনীতিতে এমন কথা বলে রাজনৈতিক মার্কশিটের মার্কস বাড়ে, এখানেও তার ব্যতিক্রম হবে কেন? এঁদের কিছু অংশ পরিচিত তাঁরা অভিষেক ঘনিষ্ঠ এমন ছাপ মারা হয়েছে মিডিয়াতে, কিছু অংশ প্রকাশ্যে আসেন না কিন্তু প্রতিদিনের যোগাযোগ আর হোয়াটসঅ্যাপে অকারণ শুভেচ্ছা বিনিময় লেগেই থাকে। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই এই আবহে উঠে আসতে থাকে এক নবীন প্রবীণ বিতর্ক, মাঝে মধ্যেই তা প্রথম পাতায় উঠে এসেছে। মজার কথা হল স্বয়ং মমতা ব্যানার্জিও এই বিতর্ককে এক কথায় শেষ করে দেননি, বরং বলা যায় নিজে একেবারে শেষ কথাটা না বলে সেই বিতর্ক জিইয়ে রেখেছেন। যদিও উল্টো পিঠে কল্যাণ ব্যানার্জি বা সৌগত রায় ছাড়া খুব বেশি এই বিতর্ক চালিয়ে যাওয়ার নেতাও তৃণমূলে নেই। আর যাই হোক বক্সিদা বিতর্ক চালিয়েই যাবেন এ আশা কেউ করে না।
আসলে এই নবীন প্রবীণ ইত্যাদিটা আসল বিতর্ক নয়। দেশের আর দশটা আঞ্চলিক দলের মতই তৃণমূলও এক নেতা নির্ভর দল, তাকিয়ে দেখুন শিবসেনা থেকে এনসিপি থেকে ডিএমকে থেকে আরজেডি বা বিজেডির দিকে। এক নেতা বা নেত্রীকে ঘিরে এইসব দল গড়ে উঠলেও বার বার প্রশ্ন এসেছে উত্তরাধিকারের, এবং সেই উত্তরাধিকার কোনওদিনই গণতান্ত্রিক রীতি নীতি মেনে হয়েছে এমনটাও নয়। কিন্তু যে দল তাদের উত্তরাধিকারের সমস্যা যত তাড়াতাড়ি সর্বসম্মতভাবে মিটিয়েছে, সেই দল তত মসৃণভাবে তাদের শাসন ক্ষমতা ধরে রেখেছে, দলের প্রভাব প্রতিপত্তিকে ধরে রেখেছে, মানুষের সমর্থনকে ধরে রেখেছে। এই উত্তরাধিকার বাছা আর এক মসৃণ ক্ষমতার হস্তান্তরণ খুব জরুরি। ধরুন ডিএমকে, করুণানিধির পরে কে বসবেন মসনদে, কিছু কথাবার্তা চললেও খুব মসৃণভাবে ক্ষমতা গেছে স্তালিনের হাতে, তিনি ক্ষমতা ধরে রেখেছেন, দল সরকারে আছে। অন্যদিকে এই উত্তরাধিকার কার হাতে যাবে সেই লড়াই এএআইডিএমকে ক্রমশ তাদের জমি হারিয়েছে, আর কিছুদিন পরে তারা রাজ্যে তিন নম্বরে চলে গেলেও অবাক হব না। বালাসাহেব ঠাকরের পরে রাজ-উদ্ধবের লড়াই বিজেপিকে উত্থানের রাস্তা দেখিয়েছে, আজ সব অর্থেই তারা রাজ্যে এক নম্বর, উদ্ধব শিবসেনা তিন আর শিন্ডে শিবসেনা চার নম্বরে চলে গেছে। কিন্তু উদ্ধব ঠাকরে সেই ভুল করেননি, শুরু থেকেই পুত্রকে এগিয়েই রেখেছেন, উদ্ধব যেখানে আদিত্য সেখানে, সচেতনভাবেই তেজস ঠাকরে সেখানে নেই। যে কোনওভাবেই হোক উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ কবজির জোরেই উত্তরাধিকার ছিনিয়ে নিয়েছেন, দল তাঁর হাতে, কাকা শিবপাল বুঝেছেন দল অখিলেশের হাতে, অতএব দলে এবং মানুষের সমর্থন বরকরার।
আরও পড়ুন: Aajke | তিন মাসের আন্দোলন ইত্যাদি সামলে মমতা অপ্রতিদ্বন্দ্বী
বিজেডি দল কেবল নয়, ওড়িশার মানুষজন বিজু পট্টনায়কের উত্তরাধিকারী হিসেবে নবীন পট্টনায়ককে বেছে নিয়েছিল, কিন্তু নবীনবাবু তাঁর উত্তরাধিকারী ঠিক করার ক্ষেত্রে চরম গাফিলতি দেখিয়েছেন, শেষপর্যন্ত ঘোষণা না করলেও উৎকলবাসী নন এমন এক আমলাকে সামনে রেখে নিজে ডুবেছেন, দলকেও ডুবিয়েছেন। লালুর দুই পুত্র, কন্যা মিসাও আছেন রাজনীতিতে কিন্তু উত্তরাধিকার গেছে তেজস্বীর হাতে, তেজপ্রতাপ তেজ দেখানোর চেষ্টা করেননি তা নয়, কিন্তু লালুও বুঝিয়েছেন, তেজস্বীও সময় মতো নিজের ক্ষমতা হাতে নিয়েছেন। আরজেডি-তে উত্তরাধিকার নিয়ে আর কোনও সমস্যা নেই। সব মিলিয়ে প্রত্যেক আঞ্চলিক দল গড়ে তো ওঠে একজন নেতা বা নেত্রীকে ঘিরে, কিন্তু সেই দলে পরের জন কে হবেন সেই প্রশ্নের মীমাংসা খুব খুব জরুরি আর তৃণমূলেও সময় থাকতেই সেই প্রশ্ন কিন্তু সামনে এসে পড়েছে, এসে পড়েছে ভাইপো বা যুবরাজের কথা, এখনও পর্যন্ত মসৃণভাবেই উঠে আসছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। এই যে অনেকে বলেন শুভেন্দু আসলে আরএসএস করতেন, উনি গোঁড়া হিন্দু, বিজেপির আদর্শে অনুপ্রাণিত, এগুলো ডাহা মিথ্যে। তৃণমূল দলে উত্তরাধিকারি হিসেবে অভিষেকের উঠে আসাটাই ছিল শুভেন্দুর প্রথম আর প্রধান সমস্যা। উনি চেয়েছিলেন ঘোষিত দু’ নম্বর হতে, পরবর্তী মূখ্যমন্ত্রী হতে, এটাই তাঁর তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়ার এক এবং একমাত্র কারণ। এখন তৃণমূল দলে তাঁকে দু’ নম্বরে দেখতে কারা চেয়েছিলেন? কারা তাঁকে তলায় তলায় সমর্থন করেছিলেন? আমার ধারণা দলের মধ্যে এসব বিষয় তোলারও সুযোগ শুভেন্দু অধিকারীর ছিল না, তিনি নিজের স্বপ্নের পোলাও নিজেই রেঁধেছেন, নিজেই ঘি দিয়েছেন, উত্তরাধিকার বহন করার জন্য দলের কোনও স্তরের কোনও নেতার সমর্থনই তাঁর ছিল না। কিন্তু তিনি দেখেছিলেন সেই স্বপ্ন, একা একাই দেখেছিলেন আর সেইজন্যই অভিষেক বন্দ্যোপাধায়ের উঠে আসাটা তাঁর কাছে ছিল আন-অ্যাক্সেপ্টেবল, তিনি মেনে নিতে পারেননি, চেয়েছিলেন অবিলম্বে সমাধান, উপমুখ্যমন্ত্রিত্ব।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো ছেড়েই দিন কেউ পাত্তাও দেননি, উনি অমিত শাহের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে ওনার আরএসএস করার গল্প শুনিয়েছেন। তিনি বেরিয়ে গেছেন কিন্তু সেই সময় থেকেই দলে উত্তরাধিকারের প্রশ্ন এসেছে, একেবারে ঘোষণা করে মীমাংসা না হলেও এই উত্তরাধিকার যে অভিষেকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই যাবে, তা নিয়ে খুব একটা সংশয়ের অবকাশ নেই। তাহলে প্রশ্ন তো উঠতেই পারে মমতা নিজেই ঘোষণা করে দিচ্ছেন না কেন? কারণ খুব সোজা, এমন কোনও ঘোষণা করার চেয়েও এক শক্তপোক্ত অর্গানাইজার অভিষেককে তিনি দেখতে চান। অভিষেকের পিছনে তাঁর পূর্ণ সমর্থন আছে, সেটা তিনি খুব পরিষ্কারভাবেই জানান দেন আবার দলের সিনিয়র নেতারা যাতে আহত না হন, হঠাৎ করে দলের মধ্যে এক পালাবদল যাতে দলে সমস্যা না তৈরি করতে পারে, সেদিকে নজর আছে দিদিমণির। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই, বীরভূমের কেষ্ট তখন জেলে, মমতা এলেন, কোর কমিটি তৈরি করে দিলেন, যৌথ নেতৃত্বে চলবে বীরভূম তৃণমূল। লোকসভা ভোট অনায়াসে পার করেছে সেই কোর কমিটি। ইতিমধ্যে কেষ্ট মোড়ল ফিরেছেন, আবার কেষ্ট-রাজ? এবারে মাঠে অভিষেক, কেষ্ট মোড়ল কাজ করবেন কিন্তু ওই কোর কমিটির গুরুত্ব কমানো হল না, মানে যৌথ নেতৃত্ব চাই। না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটাও কথা বলেননি, যৌথ নেতৃত্বে কোর কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ হচ্ছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা ছেড়েই দিলাম, উত্তরবঙ্গেও অভিষেক নিজের সমান্তরাল না হলেও ওনার অনুগত টিম তৈরি করতে পেরেছেন, কাজও হচ্ছে। কাজেই আঞ্চলিক দলের টিকে থাকার শর্ত হিসেবেই উত্তরাধিকারী চিহ্নিত কেবল নয় তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও কোনও সন্দেহ নেই এবং তার চেয়েও বড় কথা হল পাল্টা দাবিদারও নেই। কাজেই দলের মুখপাত্র জন্মদিনের শুভেচ্ছায় অনায়াসে বলেই দিতে পারেন যে ভবিষ্যতে অভিষেকই হবেন মুখ্যমন্ত্রী, ধরবেন দল আর রাজ্যের হাল।
কিন্তু একটা প্রশ্ন তো থেকেই যাবে— দল, প্রশাসনের কাঠামো, চরিত্রে কোনও বদল আসবে কি? দল চালাতে গেলে টাকা লাগে, সে টাকার সোর্স কোনও জমানাতেই খুব স্বচ্ছ তো নয়ই বরং এক ধরনের দুর্নীতি জন্ম নেবেই, তা প্রশাসনের সমর্থন পাবেই, দলের নেতাদের আকাঙ্ক্ষা আছেই, তাঁরা তো জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব করবেন বলে ক্ষমতায় আসেননি। নানান বাধ্যবাধকতাও আছে, নির্বাচনে জেতার জন্য যে কোনও পদ্ধতি মেনে নেওয়ার ইতিহাস আছে, বাহুবলীদের অ্যালাও করতে হয়, বালি, কয়লা গরু পাচারের অভিযোগ থাকেই। এ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বসমক্ষে বা দলীয় স্তরে খানিক রাশ ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন, এটা জেনেই যে এই সব নিয়েই ঘর সামলাতে হয়, এই সব নিয়েই দল আর দলের লক্ষ লক্ষ সমর্থক। কিন্তু যুবরাজ? তাঁর কি কিঞ্চিত আলাদা কোনও প্রোগ্রাম আছে? তিনি কি এই ব্যাপারে গতানুগতিক ধারার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে চান? এর আগে তেমন কথাবার্তা তাঁর গলায় শোনা গেছে। দু’ চারটে আসনে হারি তো হারব কিন্তু মানুষকে ভোট দিতে বাধা দেওয়া চলবে না, দুর্নীতির অভিযোগ এলে প্রার্থী করা হবে না, স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কর্মী নেতাদের সামনের সারিতে আনা হবে। সামাজিক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত দলীয় কর্মীদের সমূলে বাদ দিতে হবে। এসব কথা তাঁর মুখে শোনা গেছে। কার্যক্ষেত্রে যার খুব বড় কোনও চিহ্ন আমরা দেখতে পাইনি, তবে এটা ভেবে খানিক আমোদ হয়েছে যে এই বাজারে এই কথাগুলোও তো অন্তত বলা হচ্ছে, মরা মরা মরা বলতে বলতে কখনও রাম রাম রাম যে বেরিয়ে আসবে না তা তো বলা যায় না। কিন্তু এসব কথা বলা এক ব্যাপার আর তাকে কাজে আনার জন্য যে স্বাধীনতা তাঁর হাতে থাকা উচিত, তা আর ঈক ব্যাপার। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল এতদিন রাস্তায় থেকে আন্দোলন করে, সিপিএম-এর হুমকি মাথায় নিয়ে, বাড়িছাড়া হয়ে, পুলিশের গুঁতুনি খেয়ে লাগাতার দলের ঝান্ডা তুলে ধরে রেখে যে কর্মী নেতারা আজ মন্ত্রী, নেতা তাঁরা তো তাকিয়ে আছেন মমতার দিকে, এক প্রাগম্যাটিক নেত্রীর দিকে, যিনি বাবা রে বাছা রে করে, ধমক দিয়ে, হুমকি দিয়ে, বুঝিয়ে সুঝিয়ে দলটাকে ধরে রেখেছেন, সেই দলে এমন যুগান্তকারী কথাবার্তা কোন ঢেউ তুলবে তা তো তিনিও জানেন না, অন্য কারও কথা বাদই দিলাম। জানেন না বলেই এখনও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আগামী উত্তরাধিকারী বটে, কিন্তু সেই উত্তরাধিকার তাঁর হাতে এখনও নেই, সেখানে গিয়ে সেই একটাই কথা, তৃণমূলে একটাই পোস্ট, বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট, বলেছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়।