আপনি মনে করছেন যে এই সরকার খুব খারাপ, এই সরকারের মন্ত্রীসান্ত্রীদের বড় অংশ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে, এই সরকারে থাকা দল দুর্নীতিবাজ, কাজেই এ রাজ্যের মানুষের আজকের এই দুর্দশার জন্য এই সরকারই দায়ী। এই ভাবনা কারও থাকতেই পারে, কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু যদি আপনি মনে করেন এই সরকারের আমলে ঘটে যাওয়া এক ধর্ষণ আর হত্যা আসলে এই সরকার আর সরকারে থাকা দলের ষড়যন্ত্র, তারাই লোক পাঠিয়ে ধর্ষণ আর খুন করেছে এই তিলোত্তমাকে। ব্যস, আর কি কিছু বাকি রইল? এর পক্ষে এবারে যা আসবে সব সত্যি, বিপক্ষে যা আসবে সব মিথ্যে, হুবহু যে একমত সে হল কমরেড, লড়াইয়ের ময়দানে দেখা হবে, সঙ্গে আছি, আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি। আর না মিললে শালা মমতার দালাল চটিচাটা। কেউ যদি বলে হ্যাঁ, দুর্নীতি আছে তো এই সরকারে, কিন্তু সেই দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই এই ধর্ষণ-হত্যার, সেও চটিচাটা। কারণ ওই যে হুবহু মিলতে হবে, মেলাতে হবে। ধরুন সবটা মেলার পরেও যদি কেউ বলে যে যেহেতু সুপ্রিম কোর্টের দেখরেখে তদন্ত চলছে, যেহেতু কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিআই তদন্ত করছে, তাহলে দেরি কেন হচ্ছে? বা বিচার চাই এই কথাগুলো সিজেআই কমলেক্স-এ গিয়েই বলা উচিত। দাদা কি রাজ্যসভার টিকিট চান? দাদা কি চটিচাটা। কেন? কারণ ওই যে প্রতিবাদের স্বরলিপি মেনে প্রতিবাদ করতে হবে না হলেই আপনি এই মঞ্চে এক বিশ্বাসঘাতক চটিচাটা বলে গণ্য হবেন। আচ্ছা ধরুন আপনি সবটাতেই একমত, কিন্তু আপনি বললেন আমি রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে নেই, কিন্তু আমি তো প্রতিবাদে আছি, তাহলেও হবে না? ঘরে বসে থাকা মিরজাফর চটিচাটা। আপনি রাস্তাতেও নামলেন, সব ব্যাপারে একমত কিন্তু ঋতুপর্ণাকে ওভাবে ভয় দেখিয়ে পালাতে বাধ্য করার ব্যাপারে একমত নন, তাহলেও আপনি চটিচাটা।
আসলে কিছু মানুষ মনে করেন যাবতীয় প্রতিবাদের গ্লোবাল টেন্ডার তিনি বা তাঁর গোষ্ঠী বা তাঁদের দল নিয়ে রেখেছেন, প্রতিবাদ তাঁদের বাপকেলে সম্পত্তি, তাহলেও সেই একই স্ট্যাম্প পড়বে আপনার কপালে— ধান্দাবাজ চটিচাটা। মাত্র গতকাল ওই রিমঝিম ইত্যাদিরা এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন কোনও দলকে তাঁরা মঞ্চে আসতে দেবেন না, সেখানে বিশেষ কিছু লোকজনকে ডাকা হয়েছে অপর্ণা সেন, জঁ দ্রেজ ইত্যাদিদের, ডেকেছেন তো ডেকেছেন, ওনারা একটা মঞ্চে জড় হয়েছেন ওনাদের মতো করে ডেকেছেন। কিন্তু তা নিয়ে আমাদের পরিচিত আর একজন প্রতিবাদী লিখেছেন, সাধু সাবধান, এর মধ্য থেকে নো ভোট টু-র গন্ধ বের হচ্ছে, খেলার উপরে খেলা হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। মানে এক্কেবারে উনি যেমন করে ভেবেছেন সেইভাবেই ভাবতে হবে সব্বাইকে, না হলে ওই যে চটিচাটা। চটি নিয়েই বা সমস্যা কোথায়? বিধান রায় বা জ্যোতি বসু যুগের হাওয়া মেনেই পাম্প শু পরতেন, সিদ্ধার্থবাবু রকমারি, বুট থেকে স্নিকার হয়ে কোলাপুরি চপ্পলেও দেখেছি, বুদ্ধবাবু চপ্পল বেশিরভাগ সময়েই আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিগনেচার হাওয়াই চটি। আবার উল্টোদিকের উদাহরণ এক অভিনেত্রী রাজ্য সরকারের দেওয়া পুরস্কার ফেরত দিয়েছেন, এটা তাঁর প্রতিবাদ, এদিকে তিনি জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছেন, কাজেই প্রশ্ন, কেন? মণিপুরের ঘটনায় কি জাতীয় পুরস্কারটা ফেরত দেওয়া যেত না? মানে আগে প্রতিবাদ যদি কেউ না করে থাকে, ধরে নিন ততটা সাহস সঞ্চয় করতে পারেননি, তাহলে আজ তার সাহসী হয়ে ওঠাটা ধান্দাবাজি? অনৈতিক?
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | আন্দোলন আপনার অধিকার, সে অধিকার কি কেবল আপনার?
একজন মনে করতেই পারেন যে এই ঘটনার জন্য রাজ্য সরকার দায়ী, চাইতেই পারেন মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ, কিন্তু তারই সঙ্গে তিনি হয়তো রাজি নন শারদীয় উৎসবে শামিল হব না, এবারে পুজো নয়, এবারে বিচার চাই, এরকম একটা স্লোগানের সঙ্গে তিনি একমত নন, ব্যস, তিনি চটিচাটা, তিনি ধান্দাবাজ? এ কোন নতুন ধারাপাত? যেখানে আমার মতের সঙ্গে তোমার মত না মিললেই ব্যস, তুমি আমার বিরোধী, তুমি মাকু সেকু, তুমি চটিচাটা? এখন অনেক কিছুর মতো এক আন্দোলনের হাওয়া চলছে, দেখলাম “আর কবে” প্রতিবাদী গানের গোল গলা টি শার্ট বিক্রি হচ্ছে ৩৯৯ টাকায়, যেমন চে লেখা গেঞ্জি বিক্রি হয়। হোক আমার আপত্তি নেই আন্দোলনের আগে মন রাঙানোতে আপত্তি কেন করব, কিন্তু আপনার আন্দোলনের প্রতিটা শব্দের সঙ্গে একমত হতে হবে এই মৌলবাদী চিন্তাভাবনা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। আরে আপনি আন্দোলন করছেন, তারজন্য রোজ বাসে রাস্তা আটকে বসে থাকবে লোকজন? এটা কেউ জিজ্ঞেস করতে পারবে না? ডাক্তারবাবুরা আন্দোলন করছেন, এক ২২ বছরের যুবক এসে এমার্জেন্সিতে পড়ে থাকল, মারা গেল, কেউ কথা বলবে না? প্রশ্ন করবে না? প্রশ্ন করবে না যে আপনার রাত দখলের অভিযান এক প্রতিবাদ, বোঝা গেল, কিন্তু তার লক্ষ্যটা কী? চাইছেনটা কী? মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ? সেটা বলুন, ল্যাটা চুকে যায়। ৪৫-৪৬ শতাংশ মানুষের ভোটে জিতে আসা এক সরকার যাকে আপনি চাননি, বিভিন্ন কারণেই চাননি, তো যান মানুষের কাছে যান, মানুষকে বলুন, নির্বাচন তো আবার আসছে, সরকার বদল করুন। কিন্তু একটা ধর্ষণ আর খুন, সেটা জঘন্য কিন্তু তার জন্য সরকার ছেড়ে চলে যেতে হবে যারা ক’মাস আগেও মানুষের ম্যান্ডেট পেয়েছে? কেউ এ কথাটা বললেই চটিচাটা? রাজ্যের ৪৬ শতাংশ মানুষ চটিচাটা? এই সিদ্ধান্তে আসার আগে আমরা একবার ভাবব না যে এইভাবে কোনও সভ্য সমাজের আলোচনা চলতেই পারে না। আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে, তা মৌলিক অধিকার, সংবিধান সেই গ্যারান্টি আমাদের দিয়েছে। কিন্তু সেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে সামনের মানুষটাকে অসম্মান করা নয়।
একবার ভাবুন তো আগামী কাল থেকে ওই আরজি করের যে ছেলেটি গতকাল এমার্জেন্সিতে মারা গেল, যার মা বলছেন তাঁর ছেলেকে ডাক্তার দেখেনি, তার সমর্থনে, সেই মাকে নিয়ে আর একটা রাত দখলের প্রোগ্রাম ডেকে বসে আরও কিছু মানুষ, বিচার চেয়ে পথে বসে পড়ে মানুষ। গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। কারণ অন্যপক্ষেরও তো মাকু নকু স্লোগান আছে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল বিচার চাইছেন তো, বলছিলেন ৯ তারিখে শুনানি আছে? কিসের শুনানি? ট্রায়াল? কিসের ট্রায়াল? কার ট্রায়াল? সুপ্রিম কোর্ট বলেছে যে সিবিআই-এর তদন্ত কেমন হচ্ছে, কীভাবে এগোচ্ছে, সেখানে কোনও সমস্যা আছে কি না, তা আমরা দেখব। সুপ্রিম কোর্টে বিচার হবে নাকি এই মামলার? এই বোধবুদ্ধি নিয়ে আন্দোলন হবে? কেউ ৮ তারিখ পথে থাকবেন, কেউ বলছেন ৯ তারিখ রাস্তা দখল করো, আরও নির্বোধ কিছু আছে তারা লিখেছে যদি ৯ তারিখে বিচার না পায় তাহলে তারা নাকি নবান্ন দখল করবে। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮-এ আজমল কাসভ অসংখ্য খুন জখম করার পরে ধরা পড়ে, অন্তত শ পাঁচেক প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, সি সি টিভি ফুটেজ ছিল। তারপরে তার বিচার শুরু হয় এবং সেই বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয় ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১১, আপিল হয়, সুপ্রিম কোর্ট সেই অর্ডার বহাল রাখে, ২০ আগস্ট ২০১২তে সর্বোচ্চ আদালতেও ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়, ২০১২ নভেম্বরে কাসভের ফাঁসি হয়। মানে ঘটনার ৪ বছর পরে। সব্বাই প্রথম দিনেই জানে বিয়ন্ত সিং সতবন্ত সিং ইন্দিরা গান্ধীকে গুলি করে মেরেছে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিয়ন্ত সিং রক্ষীদের গুলিতে মারা যায়, সতবন্ত সিং বেঁচে যায়, সেটা ছিল ৩১ অক্টোবর ১৯৮৪ আর ১৯৮৯ সালের ৬ জানুয়ারি তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। হ্যাঁ বিচারটা সিনেমাতে ওরকম হয়, দু আড়াই ঘণ্টার সিনেমাতে ঘটনা, তার ব্যাকগ্রাউন্ড, বিচার আর ফাঁসি সবটাই হয়ে যায়, বাস্তবে তা হয় না। সেটা অনেকে জানেন না, কিন্তু তাই বলে এত লোককে এই ভুল বোঝানো হচ্ছে।
সবচেয়ে বড় কথা, বিচার তো সুপ্রিম কোর্টে হচ্ছে না, হচ্ছে শিয়ালদহ কোর্টে, কারণ আরজি করে ঘটনা ঘটেছে, সেখানে সবে দু’ বার আনা হয়েছে অভিযুক্তকে, এর পরে তদন্ত শেষ হবে, চার্জশিট হবে, ট্রায়াল শুরু হবে শেষ হবে, বিচারপতি রায় দেবেন। হ্যাঁ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নন, ওই শিয়ালদহ আদালতের বিচারপতি। তারপর অভিযুক্ত উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারে, সেখানে আবার শুরু থেকে বিচার শুরু হতে পারে, যাঁরা এখন কলেজ পাশ করেছেন, তাঁরা তখন কর্মক্ষেত্রে, তারপর মামলা সুপ্রিম কোর্টেও যেতেই পারে, ফাঁসির রায় হলে যাবে। তারপর রাষ্ট্রপতির কাছে অ্যাপিল। হ্যাঁ এটাই বিচার ব্যবস্থা। কেন এত লম্বা কেন? কারণ ১০০ জন দোষী বেরিয়ে যাক একজনও নির্দোষ যেন শাস্তি না পায়, সেটা দেখার জন্য। তো এসব কথা থাক, যাঁরা ভাবছিলেন সুপ্রিম কোর্ট রায় দেবে, ৯ তারিখেই তাঁরা দেখলেন কিছু টেকলিক্যাল কথাবার্তার পরে সুপ্রিম কোর্ট আর একটা দিন নির্ধারণ করল এক সপ্তাহ পরে। তদন্ত কতটা এগোল সেটা দেখবেন বিচারপতিরা, আর স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন ডাক্তারবাবুরা কাজে ফিরুন, গলা চড়িয়ে কথা বলছিলেন বিজেপি নেতা কৌস্তভ বাগচী, চিফ জাস্টিস তাঁকে সতর্ক করে দিলেন, বললেন গ্যালারি গরম করার জায়গা এটা নয়। ন্যায়বিচারের জন্য সময় লাগবে, প্রথমেই এটা বুঝতে হবে, প্রতিবাদ করতে হলে অনেক দম রাখতে হয়, অর্চনা গুহনিয়োগীকে লালবাজারে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করা হয়েছিল, ১৯ বছর সেই নারকীয় অত্যাচারের বিচার চলেছিল, বাম জমানাতেই সেই অত্যাচারী পুলিশ অফিসারের প্রোমোশন হয়েছিল। একটা ধর্ষণ আর হত্যার বিচার মুড়ি মিছরি নয়, অনেক সময় লাগবে, যাঁদের দম ধরে রাখার ক্ষমতা নেই তাঁরা চু কিৎ কিৎ প্রাকটিস করে তারপর প্রতিবাদে নামুন। আমরা বিচারের দাবি করেই যাব, ন্যায়বিচার হোক সেই দাবি তুলব, আবার আমরা উৎসবেও থাকব, আমরা সিবিআই ভুল করলেও কথা বলব, রাজ্য সরকারের গাফিলতির কথাও বলব। আপাতত বলি দম ধরে রাখুন, লড়াইটা লম্বা, বিচার পদ্ধতি বুঝুন, হুট বলতে ঝুট বিচার পাওয়া যায় না।