২৫ জুন মাঝরাতে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল, দেশের মানুষ সাতসকালে উঠে জানতে পেরেছিলেন। তার আগেই ঘুম ভাঙিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে দেশের সেইসব নেতাদের যাঁরা ইন্দিরা গান্ধীর বিরোধিতা করছিলেন। তার বহু পরে কংগ্রেস দল, নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিজে ভুল স্বীকার করেছেন। কিন্তু ২৫-২৬ জুন মানুষের মাথায় আছে। এবারে সেই ২৫-২৬ জুন সংসদে স্পিকার পদের নির্বাচন হবে, এবং তা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক মহল সরগরম। কী সরকারি পক্ষ, বিজেপি বা তেলুগু দেশম, জেডিইউ, এলজেপি বা উল্টোদিকে কংগ্রেস থেকে সমাজবাদী দল থেকে, তৃণমূল বা ডিএমকে দলের নেতারা ঘুঁটি সাজাচ্ছেন, কারণ এই লড়াই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কী বিধানসভায় কী লোকসভা বা রাজ্যসভায় স্পিকার পদের এত গুরুত্ব কেন? এমনিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে তো স্পিকার শাসকদলের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনেই চলে। ইন সবকো সাসপেন্ড কর দো, নির্দেশ গেল, পালন করলেন স্পিকার, মহুয়া মৈত্রা কো বাহার নিকাল দো, পালন করেছেন স্পিকার, রাহুল গান্ধী কা সদস্যতা পদ খারিজ কর দো, স্পিকার সেই নির্দেশ পাঠিয়ে দেবেন সংসদের সেক্রেটারি জেনারেলকে, তা তামিল হবে হয়েছে। তার মানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে স্পিকার হবেন শাসকদলের এইচএমভি, হিজ মাস্টার্স ভয়েজ।
খেলা জমে যায় যখন সংসদে মিলিজুলি সরকার চলে, যখন কোনও একটি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে না। তখন স্পিকার হয়ে ওঠেন বেশ এক কেষ্টবিষ্টু মানুষ। বিভিন্ন রাজ্যে এর উদাহরণ আছে, এমনকী সংসদেও স্পিকারের কারণে সরকার টিকে গেছে বা পড়ে গেছে তারও উদাহরণ আছে। ধরুন অটল বিহারী বাজপেয়ীর ১৩ মাসের সরকারের কথা, সরকার চলছিল এই তেলুগু দেশম আর ডিএমকের সমর্থনে, ডিএমকে তার সমর্থন তুলে নেয়, সরকার সংখ্যালঘু হয়েছে মনে করেই অনাস্থা প্রস্তাব আনেন বিরোধীরা। কিন্তু হিসেব চলছে এবং বোঝা যাচ্ছে যে খুব কম সম্ভবত ১-২ সাংসদের ভোটে সরকার টিকবে বা পড়ে যাবে। এই সময়েই কংগ্রেসের গিরিধর গোমাঙ্গো, যিনি খোল বাজিয়ে গান করতেন, তিনি এমপি ছিলেন কিন্তু তাঁকে ওড়িশার দলের মধ্যে ঝগড়া সামাল দিতেই ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। কিন্তু উনি তখনও এমপি। এটা সম্ভব, ৬ মাসের মধ্যে ওনাকে একটা বিধানসভা থেকে জিতে আসতে হবে, তারপর তিনি সাংসদ সদস্য পদের থেকে পদত্যাগ করবেন এই ছিল হিসেব। কিন্তু তিনি তখনও সাংসদ, কাজেই কংগ্রেস জানাল তিনি ভোট দিতে আসবেন। কে ফাইনাল সিদ্ধান্ত নেবেন? স্পিকার। স্পিকার কে ছিলেন? স্পিকার ছিলেন তেলুগু দেশমের জি বালযোগী। তিনি সেক্রেটারি জেনারেলের কাছে আইনি সাহায্য চাইলেন, তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল এস গোপালন তাঁর পরামর্শ দিলেন, সেই পরামর্শ শুনে স্পিকার বালযোগী জানালেন, হ্যাঁ গিরিধর গোমাঙ্গো ভোট দিতে পারেন। ওই একটা ভোটে সরকার পড়ে গেল।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ২৪ জুন সংসদে মোদিজি বিরোধীদের সামনে দাঁড়াবেন নাকি এক গ্লাস জল খেয়ে পালাবেন?
ওনার জায়গাতে যদি বিজেপির স্পিকার হত? সরকার পড়ত না, কারণ উনি গিরিধর গোমাঙ্গোকে ভোটটাই দেওয়ার অনুমতি দিতেন না। আবার এই স্পিকার পদ নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে ইউপিএ ওয়ান সরকারের সময়ে, সম্মিলিত বিরোধী মানে বিপ্লবী সিপিআইএম এবং বিজেপি যৌথভাবেই সরকার ফেলে দিতে চায়, ছাগল ঘোড়ার মতো সাংসদদের দাম চড়ছে, সংসদেও সেই টাকা দেখানো হল, স্পিকার ছিলেন সোমনাথ চ্যাটার্জি, তিনি না শুনলেন দলের কথা না বিরোধী সাংসদদের দেখানো ওই টাকার বস্তা, তিনি ভোটাভুটি করালেন। কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার টিকে গেল, সেদিন সরকার পড়ে গেলে ২০১৪ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত না বিজেপিকে, ২০০৯-এই বিজেপির সরকার হত। এই কারণেই স্পিকার পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজ সেই প্রশ্নেই এসে দাঁড়িয়েছে সরকার তৈরির বিষয়টা। মানে সরকার তো হবেই, কিন্তু স্পিকার কে হবে? বাইরের বিবৃতিতে কান দেওয়ার কোনও কারণ আছে কি? নীতীশ কুমার বা চন্দ্রবাবু নাইডুর ডিগবাজি খাওয়ার ইতিহাস কে জানে না? এই চন্দ্রবাবু নাইডু, দেশের প্রত্যেক অবিজেপি, অকংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে এক ফেডারেল জোট তৈরি করার জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন, এ রাজ্যেও এসেছেন, মমতার সঙ্গে দেখা করেছেন। এসব তো হয়েছে। উনি সিএএ-এনআরসির তীব্র বিরোধিতা করেছেন, সব্বাই জানে।
মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণ যা নিয়ে মোদিজির সেই বিখ্যাত মন্তব্য, আপনার দুটো গরুর একটা ওরা নিয়ে যাবে, মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণ আমার জান থাকতে হবে না। জান তো আছে, চেয়ার চলে যাওয়ার ভয়ে তিনি চুপ করে আছেন, চন্দ্রবাবু নাইডু মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণকে সমর্থন করেছেন, তাঁর ইস্তাহারে সে কথা লেখা আছে, জেতার পরে ওনার ছেলে নারা লোকেশ এই সংরক্ষণের কথা বলেছেন। কাজেই উনিও জানেন বিজেপির কাছে স্পিকার থাকলে বিজেপি দল ভাঙবে, বিভিন্ন দল ভেঙে ২৭২-এর উপরে যাওয়ার চেষ্টা চালাবেন, তাই স্পিকার পদের দিকে ওনার নজর আছে, নীতীশকুমারেরও নজর আছে। ম্যানেজ হতে পারে না এমন কথা বলছি না কিন্তু তার জন্য বিজেপিকে বেশ বড় দাম দিতে হবে। কী দাম? কত দাম? ক্রমশ প্রকাশ্য। কিন্তু আপাতত যে দু’ তিনটে থিওরি দিল্লিতে ভাসছে তা হল এক স্পেশাল প্যাকেজের বদলে দুই মুখ্যমন্ত্রী নাকি দিল্লির সরকারের দিকে এখনই তাকাতে চান না, রাজ্য গুছিয়ে সামলিয়ে বছর তিন চার পরে তাঁদের খেলা দেখাবেন। কীরকম স্পেশ্যাল প্যাকেজ? সেরকম কিছু ঘোষণা করলে বাকি রাজ্যরা কি আঙুল চুষবে? সেখানে তো প্রবল বিজেপি বিরোধী হাওয়া উঠবে। তার কী হবে? শোনা যাচ্ছে ঘোষণা করে নয়, ঘোষণা ছাড়াই বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়ানো হবে, বিভিন্ন প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। কিন্তু তাও কি মানুষের চোখের আড়ালে করা সম্ভব? ওরকম কিছু হলে এই বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি আঙুল তুলে দেখাবেন না, দেখুন বলেছিলাম বাংলা বিপন্ন, আমরা তো আগেই বলেছিলাম মোদি সরকার বাংলাকে ভাতে মারতে চায় ইত্যাদি। এমনিতেই সেকথা মানুষ বিশ্বাস করে এসব হলে তো বিরোধী শাসিত রাজ্যে নতুন ইস্যু হয়ে যাবে।
আবার শোনা যাচ্ছে ডেপুটি স্পিকার পদ নাকি ছেড়ে দেওয়ার শর্ত নিয়ে হাজির বিজেপি, ডেপুটি স্পিকার একমাত্র স্পিকার না থাকলেই পূর্ণ ক্ষমতা পেয়ে থাকেন, কাজেই সাধারণভাবে ডেপুটি স্পিকার দেওয়াই যায়। কিন্তু প্রশ্ন হল নাকের বদলে নরুণ নিয়ে নীতীশ-নাইডু কি খুশি হবেন? কিছুতেই না। তাহলে? এরকমও শোনা যাচ্ছে যে নীতীশের নজর এবারে রাষ্ট্রপতি আসনের দিকে, সেই গাজর নাকি ঝোলানো হয়েছে। সমস্যা হল, না আরএসএস-এর মাথারা, না বিজেপি নেতৃত্ব এই ব্যাপার মেনে নেবেন, তাঁরা নীতীশ কুমারকে চেনেন জানেন। একটা নাম ভেসে এসেছে ডি পুরন্দেশ্বরী, কংগ্রেস করতেন, সম্পর্কে চন্দ্রবাবু নাইডুর শ্যালিকা, ২০১৪তে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। দুটো কারণে এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে বিজেপিতেও, তেমন সমস্যা হলে এই পুরন্দেশ্বরী যদি দলের কথা না শোনেন, কিছুই তো করার থাকবে না, মাথায় রাখুন স্পিকার মানে দল বিযুক্ত পদ, তাঁর উপর দলের হুইপ ইত্যাদি কাজ করে না, তিনি দলের নির্দেশ অগ্রাহ্য করলে কিচ্ছুটি করার নেই। আর মাত্র ২০১৪তে দলে যোগ দিয়ে স্পিকার পদ, এটাও তো ঠিক বিজেপি সুলভ নয়। সব মিলিয়ে স্পিকার পদ নিয়ে বিস্তর গোলযোগ না বলে ক্যাচাল চলছে বলা ভালো। এবং একা রামে রক্ষে নেই সুগ্রীব দোসর বলে না? সেরকম বিরোধী দলের তরফে জানানো হয়েছে তাঁরা স্পিকার পদে তেলুগু দেশম বা জেডিইউর প্রার্থীদের সমর্থন করবেন, যদি তাঁরা প্রার্থী না দেন, তাহলে স্পিকার পদের বিরোধীরা তাঁদের প্রার্থী দেবেন, কিন্তু তিনি কে? কেউ জানাননি, বিরোধীরা তাঁদের তাস লুকিয়েই রেখেছেন। এবং আমরা অবাক হয়ে দেখছি এসব সামলানোর জন্য বিজেপির অস্ত্র তো আছেই, ইডি পাঠিয়ে, সিবিআই পাঠিয়ে ধমকে চমকে সামলাতে তো পারতেন, অন্তত একটা চেষ্টা তো করতেই পারতেন, সে চেষ্টা করেননি, কেন? কারণ তাঁদের হাতে সেই ক্ষমতা নেই, এখনও স্পিকার পদ তাঁদের হাতে শিওর নয়, কাজেই তাঁরা দম ধরে খেলছেন, অত্যন্ত জমজমাট কাবাডি খেলা চলছে, দম ছাড়লেই দুম পটাস। ২৫-২৬ জুন আবার ভারতের ইতিহাসে আর এক নতুন অধ্যায় লিখবে? দেখা যাক।