skip to content
Friday, January 17, 2025
HomeScrollFourth Pillar | আদানির দুর্নীতি? নাকি মূল্যবৃদ্ধি, চাকরি? বিরোধীরা লড়বে কী নিয়ে?
Fourth Pillar

Fourth Pillar | আদানির দুর্নীতি? নাকি মূল্যবৃদ্ধি, চাকরি? বিরোধীরা লড়বে কী নিয়ে?

কী বিধানসভাতে কী লোকসভাতে, দুর্নীতির ইস্যু আর কাজ করছে না

Follow Us :

১৯৮৩-তে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, করাপশন ইজ আ গ্লোবাল ফিনোমেনা, দুর্নীতির বিশ্বজোড়া ছবির কথা বলেছিলেন। আর আজ ২০২৪-এ সেই দুর্নীতি দেশের প্রতিটা রাজ্যে, প্রতিটা ক্ষেত্রে, শিল্পে, বাণিজ্যে সর্বত্র। আর সেই দুর্নীতি এতটা ফুলে ফেঁপে উঠেছে কারণ কোথাও না কোথাও রাজনৈতিক ছত্রছায়া জুটে যাচ্ছে, মন্ত্রীসান্ত্রী নেতাদের প্রত্যক্ষ্য মদতেই দুর্নীতির এই বাড়বাড়ন্ত। যিনি ক্ষমতাতেই এলেন না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা, এই কথা বলে, তিনি এখনও প্রধানমন্ত্রী। সেই প্রধানমন্ত্রীর রাজত্বকালে ১৮০টা দেশের মধ্যে ভারতবর্ষ ২০২৩-এ ৯৩-এ দাঁড়িয়ে আছে। সেই ভিপি সিংয়ের তোলা বোফর্স-এর কিকব্যাকের ইস্যুর কথা মনে আছে, গলি গলি মে শোর হ্যায় রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়। সেই ১৯৮৯-এর ঘটনার পর থেকে মানে ওই ৮৯ সালের নির্বাচনের পর থেকে দুর্নীতির অভিযোগ ছাড়া কোনও নির্বাচন হয়নি। ২০১৪-তে মোদিজি জিতছেন, সে বছরে মূল ইস্যু কংগ্রেস সরকারের দুর্নীতি। কিন্তু এরপর থেকে দুর্নীতি ইস্যু কেমন যেন গা-সওয়া হয়ে উঠতে থাকে। তার কারণ দুর্নীতি দমনের আড়ালে সিবিআই বা ইডি লেলিয়ে দিয়ে মোদিজি আসলে বিরোধীদের শায়েস্তা করা শুরু করলেন। দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের শুরুয়াতি দিনগুলোতেই ওনাদের মনে ধরে এই ভিজিলেন্স এজেন্সিগুলোর কাজ কারবার, এদেরকে কাজে লাগানো যায় সেটাও ওনারা কিছুদিনের মধ্যেই বোঝেন, এবং তারপর থেকে লাগাতার এই কাজ ওনারা মূলত তিনভাবে করে এসেছেন।

প্রথম ভাগে পড়ে বড্ড তেঁএটে কিছু মানুষ, যাদের একজনকেও দুর্নীতির সঙ্গে জড়ানো যাবেই না, মানে ধরুন ভারাভারা রাও, কি গৌতম নওলাখা বা অরুন্ধতী রায় বা সোমা সেন, উমর খালিদ, এঁদের দুর্নীতি ৩০০ হাত মাটি খুঁড়েও মিলবে না। অতএব এনারা দেশদ্রোহী, নকশাল, আর্বান নকশাল, টুকরে টুকরে গ্যাং ইত্যাদি বলে এঁদেরকে জেলে ঢোকাও। কেবল জেলে ঢোকালেই তো হবে না, সাংঘাতিক মামলা দাও। ধরুন ওই অশীতিপর জেসুইট ফাদার স্ট্যান স্বামী, গৌতম নওলাখা, জি এন সাইবাবা, সোমা সেন, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং বা ভারাভারা রাওয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগটা কী? ওনারা নাকি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। যে প্রধানমন্ত্রীর সু্রক্ষার জন্য প্রতিদিন ১ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়, তাঁকে মারার জন্য জেলে পাঠানো হল কাদের? তাঁরা কবি, অধ্যাপক, উকিল, সমাজকর্মী, সাংবাদিক। ঠিক সেই সময়ে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা কী করছিলেন? মানে তাঁদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? অন্যদের কথা তো ছেড়েই দিলাম, সিপিএম সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, এগুলো দেশের সুরক্ষার ব্যাপার, তার জন্য এজেন্সি আছে, তারা দেখবে। এখন বুঝেছেন, কোর্স কারেকশন করছেন।

সেদিন ওই গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি বা ওই ধরনের কিছু গণসংগঠন ছাড়া প্রত্যেকে চুপ করে রইল, আরএসএস–বিজেপি সমাজের সবথেকে র‍্যাডিকাল, ভোকাল বিরোধীদের বৃত্তের বাইরে পাঠিয়ে দিল। খেয়াল করে দেখুন কী বাম, কী তৃণমূল, কী কংগ্রেস প্রত্যেকে ইউএপিএ ব্যবহার করেছে, বিরোধীদের টাইট করতেই ব্যবহার করেছে। এরপরে ছিল রাজনীতিবিদদের পালা, নির্বাচনে লড়তে হয়, টাকা দরকার, প্রতিবাদ করতে হয়, টাকা দরকার, সরকারে থাকলে বিভিন্ন প্রকল্পের টেন্ডার ইত্যাদি আছে তা নিয়ে দুর্নীতি হয়, কমবেশি সর্বত্র হয়, এবার সেই দিকে নজর গেল, বেছে বেছে বিরোধী এবং সরব বিরোধীদের বাড়িতে ইনকাম ট্যাক্স, ইডি, সিবিআই গেল। এমনকী সেই সব ব্যবসায়ী যাঁরা কিছুমাত্র সাহায্য করেছেন বিরোধীদের তাদের বাড়িতেও পাঠানো হল এই সব এজেন্সিগুলোকে। একটা পরিসংখ্যান দিই, ইডি ২০২১ থেকে ২০২৩ জানুয়ারি অবধি পিএমএলএ, মানে মানি লন্ডারিং-এর মামলা করেছেন ৫৪২২টা, এরমধ্যে একজনও, দায়িত্ব নিয়ে বলছি একজনও বিজেপি নেতা নেই। কিছু বিরোধী নেতার বিরুদ্ধে এসব এজেন্সির মামলা ছিল, তাঁরা দল বদলানোর পরে সেসব মামলা আবার ঠান্ডা ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ উদাহরণ অজিত পওয়ার, প্রফুল্ল প্যাটেল, ছগন ভুজবল, কেবল ইডি নয়, সিবিআই এমনকী এনআইএ-এরও মামলা ছিল, এখন সব ঠান্ডা। শুভেন্দু অধিকারীর নারদা ভিডিও তো দেখানো হয়েছিল বিজেপির রাজ্য দফতর মুরলীধর লেনেই, সেদিন বলা হয়েছিল ভাগ শুভেন্দু ভাগ, তিনি ভেগে আপাতত বিজেপিতে। মামলাও বন্ধ। হিমন্ত বিশ্বশর্মা, সারদার মামলা চলছিল, উনি তখন রাহুল গান্ধীর কাছের লোক, তারপর একছুটে বেড়া ভেঙে বিজেপিতে গেলেন, ব্যস, আর সে মামলা ওঠে না, বিলকুল গায়েব।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ইন্ডিয়া জোটের মাথায় মমতা? কংগ্রেস কী করবে?

বেছে বেছে বিরোধী দলের দুর্নীতিতে জড়িত নেতাদের গ্রেফতার করার সঙ্গে সঙ্গেই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নেই, এমনও কিছু বিরোধী দলের নেতাদের দরজায় গেল ইডি-সিবিআই, সারেন্ডার করো, আত্মসমর্পণ। খোকাবাবু হয়ে যাও। দেশজুড়ে তাও চলছে, এবং এ দিয়ে একটা পার্সেপশন তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছিল যে বিরোধী নেতা মানেই তো চোর। কিন্তু দিনের পর দিন সেসব মামলা চলছে, মামলা এগোচ্ছে না, মামলার যথেষ্ট প্রমাণ নেই, অনেকেই বেল পেয়ে যাচ্ছেন, অনেকেই জেলের বাইরে এসে আবার পুরো এনার্জি নিয়ে বিরোধিতায় নামছে, আর সাধারণ মানুষের মনেও ধীরে ধীরে প্রশ্ন তো উঠছে যে সব চোর বিরোধী দলে কেন? সরকারে থাকলে চুরি করার সুযোগ বেশি, চুরি হচ্ছেও কিন্তু ইডি সিবিআই-এর র‍্যাডারে কেবল বিরোধী নেতা, এটাই বা কেমন কথা? তারপর আজ যাদের দুর্নীতিবাজ বলা হল, পরের দিন তাঁরাই বিজেপিতে যোগ দিলেই ক্লিন চিট পাচ্ছেন, বিজেপির নেতা প্রকাশ্যেই বলছেন এধারে চলে এসো আমরা ইডি সিবিআই সামলে দেব। মানুষ বুঝতে পারছে। কিন্তু এখানেও সমস্যা আছে, বিরোধী দলের মধ্যে খেয়োখেয়ি আছে, তারা সম্মিলিতভাবে এর বিরোধিতা করার বদলে এর ঘরে ইডি ঢুকলে উল্লসিত হচ্ছে, আপ-এর নেতাকে ধরলে দিল্লির কংগ্রেস নেতারা উল্লসিত, রাহুল গান্ধীকে ইডি ডাকলে আপ উল্লসিত, তৃণমূলকে ডাকলে কংগ্রেস উল্লসিত আর সিপিএম তো সেই পাগল যার গোবধেও প্রভূত আনন্দ, তারা মিছিল করে ইডি দফতরে গিয়ে দাবি জানাচ্ছে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না। এই খ্যাপাসোনাদের জানাই নেই, মমতা, অভিষেক গেলে ক্ষমতায় আসবেন শুভেন্দু-দিলীপ, তারপর একটা লাঠিও নীচে পড়বে না। কিন্তু বিরোধীদের মধ্যের এই ভাগাভাগিকে কাজে লাগাচ্ছেন মোদি–শাহ।

এবং হতচ্ছাড়া সংবাদমাধ্যম। মোদিজি কেন, সারা পৃথিবীর রাষ্ট্রপ্রধানদের মনে হয় মূলধারার সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলই প্রভাবশালী। কিন্তু গত ১০ বছরে সেই ছবি পাল্টেছে, এখন মূলধারার কাগজ বা টিভি চ্যানেলের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট, ইউটিউব, সামাজিক গণমাধ্যম। কাজেই সেখান থেকেই ধারালো তিরের মতো নেমে আসছে সত্যি, মানুষ তা দেখছেন, জনমত তৈরি হচ্ছে, তাতেই ঘুরে যাচ্ছে খেলা। বাংলায় তৃণমূল, কেরালায় সিপিএম, ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস, প্রত্যেকেই সাংবাদিক কেলিয়েছে, জেলে পুরেছে। কিন্তু আরএসএস-বিজেপি অত মোটা দাগের কাজ করবে না, সিদ্দিক কাপ্পন ইত্যাদি করে মুখ পুড়েছে, সরকারের বিরুদ্ধে খবর করছে বলে গ্রেফতার করলে তো চলবে না, তাই সেখানেও তাদের ফান্ডিং নিয়ে তদন্ত চালাও, ইডি পাঠাও, ইনকাম ট্যাক্স পাঠাও, কড়কে দাও বুঝিয়ে দাও, কথা না শুনে চললে মালিকের ঘরে ইডি পাঠাও। সম্পাদকের নামে দেশজুড়ে মানহানির মামলা করো, বিভিন্ন রাজ্যে হাজিরা দিতে দিতেই জান কয়লা হয়ে যাবে। নিজের সংবাদমাধ্যম বেচে চুপ করে যাবে প্রণয় রায়ের মতো। সেই লাইনেই নিউজ ক্লিক আক্রমণের মুখে, নতুন ইস্যু চীনের টাকা। চীনের কোম্পানি মোদিজির পিএম কেয়ার ফান্ডে টাকা দিতে পারে, কিন্তু এদেশে সংবাদমাধ্যমে দিতে পারে না, অবশ্য সেও যে দিয়েছে, তারও কোনও প্রমাণ এখনও আমাদের সামনে নেই, আসবেও না।

তো এই হল মোটামুটি বিজেপির দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান, দেশসুদ্ধ মানুষজন বুঝে ফেলেছেন দুর্নীতি আসলে সর্বত্র, আর দুর্নীতির বিরোধিতা এক বিশুদ্ধ নৌটঙ্কি সে যেই করুক, এ ওর নামে, ও তার নামে, সে ওর নামে যে দুর্নীতির অভিযোগ করছে তা এখন মানুষের গা সওয়া। অন্যদিকে শিল্পপতিদের দুর্নীতি। চোখের সামনে বিস্তর কাগজপত্র এসে হাজির হল, আদানি কেমন করে টাকা সাইফন করছে, বিভিন্ন বেনামি কোম্পানিগুলোকে সামনে রেখে বেআইনি ব্যবসা চালাচ্ছে, ক’দিনের জন্য শেয়ার পড়ে গেল, তারপর আবার তা ঠিকও হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখুন, কী বিধানসভাতে কী লোকসভাতে, দুর্নীতির ইস্যু আর কাজ করছে না। মহারাষ্ট্র বিধানসভাতে অজিত পওয়ার গোষ্ঠীর ফলাফলের দিকে তাকান, ঝাড়খণ্ডে হেমন্ত সোরেনের ফলাফলের দিকে তাকান, দুর্নীতির অভিযোগ সত্যি কি মিথ্যে কাজ করছে না। তার মানে হল বোফর্স-এ ঘুষ দেওয়া হয়েছে এরকম এক দুর্নীতির অভিযোগে এদেশের সরকার আর বদল হবে না। মোদিজি আর কিছু করুন না করুন এদেশের মানুষকে দুর্নীতির ব্যাপারে স্টোইক, নিস্পৃহ করে তুলতে পেরেছেন। অন্যদিকে মানুষের হাতে ডাইরেক্ট ট্রান্সফার দেওয়া হচ্ছে, মানুষ জেনেই গেছে ওরা দুর্নীতি করবে, নেতাদের বাড়ি হবে গাড়ি হবে, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা হবে, তাই পার্থ চ্যাটার্জি জামিন পেলেও মানুষের মনে কোনও হেলদোল নেই। তাদের মাথায় ঢুকে গেছে ফেলো কড়ি মাখো তেল, আমি কি তোমার পর? তারা চিন্তিত তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা নিয়ে, উচ্চশিক্ষাতে ভর্তির খরচ নিয়ে, তাদের কমতে থাকা মাইনে নিয়ে, তারা চিন্তিত ডাক্তার ওষুধের খরচ নিয়ে, তারা চিন্তিত ছেলে বা মেয়ের বেকারত্ব নিয়ে, তার কানের কাছে গিয়ে আদানি বলতে তো হবেই, দেশ জুড়ে লুঠমার চলছে সে কথা তো বলতেই হবে কিন্তু সেই বলাটা তার ছেলের চাকরির কথা থামিয়ে নয়, তার চাকরির স্থায়িত্বের কথা ভুলে নয়, বাড়তে থাকা জিনিসপত্রের দামের কথা বাদ দিয়ে নয়। কেন বলছি এই কথাটা? কারণ আপাতত বিজেপি বিরোধী, মোদি সরকার বিরোধী জোটের সামনে এই প্রশ্নটা এসে দাঁড়িয়েছে, আদানি ইস্যুতে সংসদ অচল, আদানি ইস্যুতে রুখে দাঁড়িয়েছে কংগ্রেস, এদিকে তৃণমূল বা এসপি বা শরদ পওয়ার গোষ্ঠীর বক্তব্য এই ইস্যুতে সংসদ অচল করে দিয়ে মানুষের মন পাওয়া যাবে না, স্বাধীনতার অমৃতকাল পার করার পরেও আজও আমাদের দাবি সেই রোটি কপড়া আউর মকান। সেই দাবিতে গলা মেলালেই মানুষকে পাওয়া যাবে সঙ্গে, না হলে সোরস আর আদানি কেচ্ছাতে সরগরম হবে সংসদ ভবন, আম আদমিকে সেই উত্তাপ ছুঁতেও পারবে না।

RELATED ARTICLES

Most Popular