আজকের নয়, সেই বাপ-দাদাদের কাছ থেকে শোনা গল্প, দুটো পরিবারের গল্প। পাশাপাশি থাকা দুটো পরিবার, তাদের সুখ আহ্লাদ, একে অন্যের সঙ্গে প্রগাঢ় সম্পর্ক, দেওয়া নেওয়া, সুখে দুঃখে পাশে দাঁড়ানো হঠাৎ এক ফকির এসে চুরমার করে দিল। সেই আগন্তুক একজনের বাড়িতে আশ্রয় নিল, আর তারপরে একের পর এক মিথ্যে তথ্য দিয়ে বিষিয়ে দিল তাদের মন, তাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হল, তারা একে অন্যের ক্ষতি করতে লাগল। এক বৈরিতার ইতিহাস চলতে লাগল যুগ যুগ ধরে। কারও জানতে বাকি রইল না ওই দুই পরিবারের ঝগড়ার কথা, কাজিয়ার কথা, তাদের মজাই লাগত, তাদের কেউ কেউ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টাও করত। বহুযুগ কেটে যাওয়ার পরে সেই দুই পরিবারের দুই যুবক শহরে পড়তে এসে বন্ধু হয়ে গেল। তাদের চেষ্টায় দুই পরিবারের মুরুব্বিরা এক জায়গাতে বসলেন। যুবক দুজনেই বলেছিল, আমরা কেবল একটাই প্রশ্ন করব, তার উত্তর তোমরা দেবে, ব্যস, তারপরে তোমাদের যা মনে হয় তোমরা কোরো। দুই পরিবারের মুরুব্বিরা বসল দাওয়ায়। দূরে ছিল পরিবারের অন্য মানুষজন। দুই যুবক একই সঙ্গে প্রশ্নটা করল? তাইলে কাকা লাভ কার? হু স্ট্যান্ডস টু গেইন? কার লাভ হবে আমরা যদি এই ঝগড়া চালিয়ে যাই। তোমার না তোমার? দুই পরিবারের মুরুব্বিরা অনেক মাথা খাটিয়েও এই ঝগড়া চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে তাদের কোনও লাভের কথা বলতেই পারল না, বরং তাদের কত ক্ষতি হয়েছে সে কথাই বলতে থাকলো। তোরা আমাদের খেতে গরু ছেড়ে দিয়েছিস, তোরা আমাদের কুকুরকে বিষ দিয়েছিস, তোরা আমাদের পুকুরের মাছ মেরেছিস, তোরা আমাদের গোলায় আগুন দিয়েছিস। হাজারো ক্ষতির লিস্ট সামনে আসার পরে দুই যুবক বলেছিল, এত বছর ধরে ঝগড়া করার পরে যদি কারও লাভই না হয়, তাহলে ঝগড়াটা চালিয়ে যাচ্ছ কেন?
ভিতরের ঘর থেকে শাঁখ বাজল, ওধারের মেয়েরা সেমাই আনল, এধারের পুরুষরা তামাক এগিয়ে দিল, ওধারের মহিলারা জোকার দিল। সেদিন রাতে পাত পেড়ে খাওয়া হয়েছিল, এধারের ঘর থেকে খিচুড়ি, ওই বাড়ি থেকে হাঁসের ডিমের কারি। আমার গল্পটি ফুরল নটে গাছটি মুড়োল। হ্যাঁ আজও যখন কাজিয়া করার ইচ্ছে হবে, তখন একটা প্রশ্ন নিজেই নিজেকে করবেন, হু স্ট্যান্ডস টু গেইন? তাইলে কাকা লাভ কার? একই কথা প্রযোজ্য ভারত-বাংলাদেশের মধ্যেও, আমরা ভাগ করিনি দেশ, বাংলাদেশিরাও নয়, আপামর হিন্দু হাত তুলে বলেনি আমার দেশকে টুকরো করো, আপামর মুসলমানও বলেনি আমার জায়নামাজের জমিন ছেড়েই আমি চলে যাব নতুন দেশে। এই ভাগ করেছিল কিছু রাজনীতিবিদ আর ইংরেজরা। ওই র্যাডক্লিফ সাহেব দাগ কেটে দিল আমাদের মাঝখানে আর আমরা সেই থেকে কাজিয়াই করে চলেছি। দুই ভাই একসঙ্গে এক সংসারে থাকলে ঠোকাঠুকি লাগবে, দিনান্তে সেই ঠোকাঠুকি গলাগলি হয়ে উঠতে সময় নেয় না। কিন্তু কাজিয়া? সে করে না, করানো হয়, যারা এই কাজিয়ার বীজ বপন করে, তাদের অন্য মতলব আছে, তাদের প্রথম মতলবই হল আমাদের আত্মিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক সম্পর্কটাকে টুকরো করে চুলোয় ফেলে কেরোসিন ঢেলে তাতে আগুন দেওয়া, তারপর আরামসে সেই আগুনে রুটি সেঁকে নেওয়া। কাজেই আমরা কাজিয়া করে মরি আর অন্যদিকে কেউ লাভের কড়ি গোনে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | এক দেশ, এক ভোট মোদিজির নয়া নৌটঙ্কি
দু’ দেশের রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি আর বিরাট সমস্ত সেলিব্রিটিদের কথা যদি বাদ দেন তাহলে এই দু’ দেশের আম আদমির কোন সুখ মিলবে এই কাজিয়াতে? কী দেয় রাষ্ট্র আমাদের? দু’ দেশের সাধারণ মানুষের গড় আয়ু কত? বাংলাদেশে ৭৬ আর ভারতে ৬৯, জন্ম হার কত? বাংলাদেশে ১.৮২ শতাংশ ভারতে ১৬.৪২ শতাংশ, মৃত্যুহার বাংলাদেশে ৫.৩ শতাংশ, ভারতে ৯.০৭ শতাংশ। দু’ দেশের বেকারত্ব কত? বাংলাদেশে ৫.১৫, ভারতে ৪.১ শতাংশ, মুল্যবৃদ্ধি কত? বাংলাদেশে ৯.৮৮ শতাংশ, ভারতে ৫.৬৫ শতাংশ। জীবনযাপনের খরচ যদি আমেরিকার তুলনায় করা হয়, মানে আমেরিকায় বাঁচতে গেলে ১০০ টাকা লাগলে বাংলাদেশে ২৮.৪৬ শতাংশ আর ভারতে ২৩.৬৩ শতাংশ। মানুষের গড় রোজগার কত? বাংলাদেশে ২৮৬০ ডলার, ভারতে ২৫৪০ ডলার। এই হিসেব দেখে চমকে উঠবেন না। দুই দেশের ওই রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি আর বিভিন্ন ক্ষেত্রের সেলিব্রিটিরাই এই আয়ের সিংহভাগ খেয়ে যায়, আম আদমির জন্য দুই দেশের ৭০০-৮০০ ডলারের বেশি থাকে না। ধারবাকি কত? বাংলাদেশে এখন ৫৩ শতাংশ, ভারতে ৫৫ শতাংশ, অর্থনীতির দিক থেকে বাংলাদেশ ছোট দেশ বলে ধারবাকি দেখতে কম হলেও সেটা বেশ বেশিই। দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশ ৭৬ নম্বরে, ভারতও পিছিয়ে নেই ৬১ নম্বরে। প্রতি ১০০০ জনের জন্য ক’টা হাসপাতালের বিছানা আছে? বাংলাদেশে ০.৮৮, মানে ১ জনেরও কম, আর ভারতে সেটা ১.৬৩, মানে দেড় জনের মতো, ডাক্তার প্রতি হাজার জনে কতজন আছেন? বাংলাদেশে ০.৬৭ আর ভারতে ০.৭৩। মানে এক হাজার জনে একজন ডাক্তারও নেই।
ওয়ার্ল্ড ডেটা ডট ইনফোতে এসব পাওয়া গেল, সময়ের ফেরে একটু আধটু হেরফের হতেই পারে, কিন্তু মূল ছবি পাল্টাচ্ছে না। হ্যাঁ, দুটো দেশের রাষ্ট্র তাদের আম আদমির জন্য কোনও জন্নত তৈরি করে দেয়নি। দুটো দেশেই রাজনীতিবিদদের মধ্যে রয়েছে র্যাম্পান্ট দুর্নীতি, রয়েছে অশিক্ষা, রয়েছে ক্ষুধা। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে কাজিয়া কী নিয়ে? কিছু উন্মাদের দল বেনাপোলে চলে গেল, কী? না লং মার্চ করব ঢাকায় যাবো। ওদিকে ঘোড়ায় চেপে ত্রিপুরা ঢুকব। এদিকে খুলনা কেড়ে নেব ওদিকে চার দিনে কলকাতা দখল করব। এঁদের প্রত্যেকে কিন্তু খুব ভালো করেই জানেন যে এর কোনওটা সম্ভব নয়, এর কোনওটা করার মতো ধক কারও নেই, এঁরা স্বপ্নেও এ কাজ করবেন না। তাহলে বলছেন কেন? এনাদের উদ্দেশ্য রয়েছে, এপারে শুভেন্দুর সাফ উদ্দেশ্য হল হিন্দু ভোট জড়ো করে মুখ্যমন্ত্রী হওয়া। গেল গেল হিন্দু ভোট অতএব সেই ভোট রাখতে মমতা ব্যানার্জিও কমেন্ট জুড়েছেন আমরা কি ললিপপ খাব নাকি? কেন জুড়লেন, ওই যে হিন্দু ভোট, তাঁরও তো চাই। ওদিকে পিনাকী ভট্টাচার্য তাঁর ভিউয়ারশিপ বাড়াতে চান, বাংলাদেশের মধ্যে ঘোড়ায় চড়ে যিনি ত্রিপুরা আসার কথা বলছেন আমি নিশ্চিত সামনের নির্বাচনে ওনাকে দেখা যাবে প্রার্থী হিসেবে। এবং খেয়াল করে দেখুন এই কাজিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের আম জনতা দরকারি ওষুধ পাচ্ছেন না, ভারতের আম জনতা বাংলাদেশ থেকে আসা সস্তার পোশাক বেশি দাম দিয়ে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। মানে আম জনতার লাভ নেই। চিরটাকাল এমনটাই হয়ে আসছে। যে কোনও জুয়াখেলার আসরে চলে যান, একটু খেয়াল করে দেখুন সব্বাই হারছে, কিন্তু যে বা যাঁরা আসর চালাচ্ছেন তাঁদের পকেটে ঢুকছে কোটি কোটি টাকা। সেটাই তো হচ্ছে। আজ হাসিনা-মোদি জমানাতে যদি আদানির পকেটে লাভের কড়ি ঢুকে থাকে তাহলে কি মনে করছেন সেই আদানি এবার যারা আসবে তাঁদের ম্যানেজ করতে পারবেন না? বা ধরে নিলাম আদানি চলেই গেল, তার বদলে যে মোদানি আসবে সেও তো একই ভাবে কমিশন দিয়ে ঘুষ দিয়েই বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েই বিক্রি করবে। ইতিহাসের পাতায় একশো বছর কোনও হিসেবই না। আমরা অনায়াসে মোঘল সাম্রাজ্যের ৩০০ বছরের ইতিহাসকে এক প্যারাগ্রাফে লিখে ফেলতে পারি।
ভারত-বাংলাদেশ ভাগ হয়েছে একশো বছরও নয়, তার আগের দীর্ঘ ইতিহাস পাশাপাশি থাকার, ইদের সেমাই আর দুগগা পুজোর খিচুড়িভোগ ভাগ করে খাওয়ার, যখন ইশার নামাজের আজান অনায়াসে মিশে যেত মন্দিরের সন্ধ্যা আরতির ঘণ্টার শব্দের সঙ্গে। কেউ কোনওদিন এ নিয়ে একটা কথাও বলেনি, আক্কেল চাচার বাড়িতেই মানুষ হয়েছেন এমন অনেককে আমি জানি, আবার সাহাদের বাড়ির ছেলের সঙ্গে ভাব-ভালবাসা ছিল এমন মেয়ের কথাও আমি জানি। এমন বহু মধুর স্মৃতি আছে, আপনারা যখন লড়ে মরবেন বলে ঠিক করেছেন লড়ুন হে রাষ্ট্র পরিচালকেরা, হে ধার্মিক পণ্ডিত মৌলানারা, টিআরপি ওলা বুদ্ধিজীবীরা লড়ে যান, লড়ে যান, আম আদমি কে ক্ষ্যামা দিন, তাদের রেয়াত করুন। কারণ রাষ্ট্রের মাথায় যে বসে সে আম আদমির স্বার্থ দেখে না এ সত্য আমাদের জানা হয়ে গেছে। আমরা হাত ধরে থাকব, আমরা বেঁধে বেঁধে থাকব, আমরা ইদের আনন্দে শারদীয়া উৎসবে, বড়দিনের প্রার্থনায় থাকব। আমরা কাচ্চি বিরিয়ানি, মাওয়া ঘাটের ইলিশ, বর্ধমানের মিহিদানা, বহরমপুরের ছানাবড়াতে থাকব, আমরা ভাওয়াইয়া, ভাটি গান, বাইচ রেসে থাকব, আমরা লালনের মাজারে, কালীঘাটের মন্দিরে থাকব, ডিসেম্বর এলে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল কিংবা পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার ঘুরে দেখব। আপনারা কাজিয়া চালিয়ে যান মহাশয়েরা, কাজিয়াতে আপনাদের পকেট ভরে, মনও ভরে, আমাদের কোনও লাভ নেই, কারণ বসে বসে ওই প্রশ্নটা নিয়েই ভাবছিলাম, তাইলে কাকা লাভ কার? দেখলাম আমাদের নয়, আম আদমির নয়। তাই ভগবানের দিব্যি, আল্লার কসম আমরা এই কাজিয়া করব না, কাজিয়া কেউ শুরু করলে তাকে থামানোর চেষ্টা করব। আজ আবার ওই নজরুল দিয়েই শেষ করি।
মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মোসলমান।
মুসলিম তার নয়ণ-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ॥
এক সে আকাশ মায়ের কোলে
যেন রবি শশী দোলে,
এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান॥
এক সে দেশের খাই গো হাওয়া, এক সে দেশের জল,
এক সে মায়ের বক্ষে ফলে একই ফুল ও ফল।
এক সে দেশের মাটিতে পাই
কেউ গোরে কেউ শ্মশানে ঠাঁই,
মোরা এক ভাষাতে মাকে ডাকি, এক সুরে গাই গান॥