আপনি চাকরি পেয়েছেন, ধরে করে হোক, ঘুষ দিয়ে হোক, মেধার বলেও পেয়ে থাকতেই পারেন। সে চাকরি সরকারি হলেও নিশ্চয়তা আছে এমন গ্যারান্টি আর রইল না, যে কোনও সময়ে সে চাকরি ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারে। সমস্ত প্রমাণ দলিল বিচার করে বিচারক আপনার চাকরি জীবনের ছ’ বছরের মাথাতেও জানাতেই পারে যে আপনার চাকরির নিয়োগ পদ্ধতি বৈধ নয়। অতএব আপনার চাকরি তো গেল, এবার এই চাকরি জীবনে পাওয়া টাকা ছ’টা ইনস্টলমেন্ট-এ ফেরত দিয়ে দিতে হবে। এদিকে আপনি ১২ বছরে শোধ করবেন বলে হোম লোন নিয়েছেন, আপনার কেনা নতুন ফ্রিজের আট কিস্তি টাকা দেওয়া বাকি। এবং এটা রূপকথা নয়, কোনও এক গাঁয়ের বধূর গল্পও নয়। কেবল তাই নাকি, নিয়োগ পদ্ধতি নিশ্চয়ই ভুল, তাই মহামান্য বিচারপতি হাজার তিরিশেক নিয়োগ বাতিল করে দিয়েছেন।
এই বাজারে হাজার তিরিশেক যুবক যুবতী যাঁরা চাকরি করছিলেন গত পাঁচ কি ছ’ বছর ধরে, তাঁরা জানতে পারলেন তাঁদের চাকরি নেই। অনেকেই চাকরি পেয়ে বিয়ে করেছেন, সন্তান আছে, পুজো আছে, জামাইষষ্ঠীর নেমন্তন্ন আছে, হোম লোন আছে, বাইকের লোন আছে। মহামান্য বিচারপতি জানিয়েছেন নিয়োগ পদ্ধতি ভুল থাকার দরুন তাঁদের চাকরি নেই। তাঁদের সন্তানকে পাশের বাড়ির বন্ধু জানিয়েছে, তোর বাবার চাকরি দুর্নীতিতে, চাকরি গেছে। সেই ৩২ হাজার যুবক যুবতীর মানসিক অবস্থার কথাটা ভাবুন। ভাবুন এই স্কুলের ছাত্রদের কথা যারা জেনেই ফেলেছে তাদের স্যর চোর। তাদের অবস্থা ভাবুন, তারা তো বিচারপতির রায় পড়বে না, ঘুষ দিয়ে চাকরি সবাই জেনেছে, কুন্তল, অয়ন, পার্থ, মানিকের কথা এরা সব্বাই জানে। এবার সেই তালিকায় নিজের মাস্টারমশাইকে জুড়ে নিল। কেবল তাকেই জুড়ল নাকি শিক্ষকদের সম্পর্কেই ছাত্রদের ধারণা বদলে গেল কে জানে? আজ সেটাই বিষয় আজকে। ববিতার চাকরি বাতিল।
আরও পড়ুন: Aajke | খুলে গেল দরবার?
সেসব মাস্টারমশাইরা এখন গল্পের পাতাতেও নেই যাঁরা ছাত্রের অসুখ শুনে বাড়িতে চলে আসতেন, হুট বলতে ঝুট বাড়িতে এসে পড়াতে বসতেন, ছাত্রদের বই কিনে দিতেন। শিক্ষকতা এখন আর পাঁচটা প্রফেশন, আর দশটা চাকরির মতোই কেবলই চাকরি। তা কোনও ব্রত নয়, তা কোনও আদর্শও নয়। কাজেই তা পেতে নীতি নিষ্ঠার চেয়েও বেশি লাগবে মেধা বা ধরাকরা বা চাঁদির জোর। এবং তার বদলে সেই শিক্ষক মাসের শেষে মাইনে গুনে নেবেন, ডিএ-র দাবি করবেন, আরও বেশি মাইনের দাবিও থাকবে এবং তার পরেও প্রাইভেট টিউশন দিয়ে মাইনের সমপরিমাণ কিংবা দ্বিগুণ কামানোর কাজে মন দেবেন। আপনি বলতেই পারেন, আরে বাহ, বাকি সবাই ফুর্তি ডট কম আর শিক্ষকরা কেবল আদর্শবাদী হবে? ডাক্তার মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের পয়সায় ম্যাকাও ঘুরে আসছেন, সাংবাদিক মাইকের তার ঠিক করেই বিখ্যাত হয়ে উঠছেন, বিচারক অটোগ্রাফ বিলোচ্ছেন যেন মিঠুন চক্কোত্তি, কেবল শিক্ষকের থাকবে আদর্শ? বলতেই পারেন, বলার আগে ভাবুন আপনি চোখ খোলার পর আপনার আসল চোখ খোলার কাজ যার, তিনি যদি নিজেই চোখ বন্ধ করে থাকেন, তাহলে ঘটনাটা কেমন দাঁড়াবে। এসব কথা থাক, আপাতত সেই বিচার প্রসঙ্গে মানুষের রায় জেনে নেওয়া যাক, এই যে নিয়োগ পদ্ধতিতে চাকরি খারিজ, একজন চাকরি পাচ্ছেন, আবার তার চাকরি চলে যাচ্ছে, এসব নিয়ে মানুষ কী ভাবছেন?
মহামান্য বিচারপতিরা নিশ্চয়ই বহু কিছু দেখে ন্যায় বিচারই করছেন, আমরা তা নিয়ে কথা বলার কে? কিন্তু এই অবস্থাটা নিয়ে তো আমাদের ভাবতেই হচ্ছে, ৩২ হাজার শিক্ষকের চাকরি চলে গেল, তার মানে কমবেশি দেড় লক্ষের বেশি মানুষের বেঁচে থাকার রসদ বন্ধ হতে চলেছে, তাদের কী হবে? লক্ষাধিক ছাত্র ক’দিন থেকে শিক্ষক পাবে না, তাদের কী হবে? যে মাস্টারমশাইরা চাকরির বয়স পার করে ফেলেছেন, তাদের কী হবে? তাঁদের সন্তানদের কাছে, পরিবারের কাছে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুদের তাঁদের মানসম্মান কোন তলানিতে ঠেকবে? ববিতার চাকরি গেল, এখন টাকা ফেরত দিতে হবে, টাকা না হয় কোনওভাবে ফেরত দেবেন, কিন্তু সম্মান? নাকি এসব সম্মান ইত্যাদিরও এখন কোনও মূল্যই নেই। শিক্ষক দুর্নীতি হয়েছে, লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতি, কিন্তু এই দুর্নীতি বাংলার শিক্ষা জগতের, ছাত্রদের, পঠনপাঠনের যে ক্ষতি করে গেল তার বিচার কে করবে? ববিতা চাকরির টাকা ফেরত দিয়ে দেবেন, ৩২ হাজারের চাকরি চলে যাবে কিন্তু শিক্ষা জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে চলেছে, যার দিকে সম্ভবত আমাদের নজর নেই। আপনারা আপনাদের মতামত জানান।