Placeholder canvas

Placeholder canvas
HomeলিডFlorence Nightingale | দ্বিশতবর্ষ পেরিয়ে সেবার আলো আজও প্রজ্জ্বলিত

Florence Nightingale | দ্বিশতবর্ষ পেরিয়ে সেবার আলো আজও প্রজ্জ্বলিত

Follow Us :

তাঁর হাতের আলোটা জ্বলছে। বিশ্বব্যাপী হিংসা, দ্বেষ, স্বার্থমগ্নতার শামিয়ানার নীচে সে আলো আজও প্রজ্জ্বলিত। ম্রিয়মান শিখার বুকের ভিতর থেকে আজও বেরিয়ে আসে সেবার করকমল। তপ্ত কপালে তাঁর হাতের স্পর্শে আজও যেন মৃতের শরীরে প্রাণ আসে। শিখাটা কাঁপছে বড় আজ, যুদ্ধ, শত্রুতার কঠিন বর্ম ভেদ করতে চায় সে শিখা, শিখাটা কাঁপছে বড্ড আজ। নিষ্ঠুরতার অন্ধকার চিরে ভেসে আসে আলো, মানবসেবার আলো, শিখাটা কাঁপছে ভীষণ আজ।

আলো হাতে এক নারী, 
উজ্জ্বল চোখ, বিমুগ্ধ মুখ, তেজদীপ্তের হাসি
জনমদুখিনী এসেছে গো, যেন আমাকেই ভালবাসি।
সে যেন আজ সেবাব্রতী নারী, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল
মায়ের ভালবাসা বক্ষে তোমার, বিলায়েছো তুমি আজ
তবুও মর্ত্যে  মূর্খরা বোঝে না, ভালবাসার কারুকাজ।

আরও পড়ুন: Florence Nightingale | আজও হাতে আলো নিয়ে হেঁটে চলেছেন ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেল 

জলধর মল্লিকের সাবেক কলকাতার ইতিকথা বইটা পড়ছিলাম। এক মহিয়সী নারীর আত্মত্যাগ, আজীবন আর্তের সেবায় ব্রতী এক অসামান্য নারীর কর্মক্ষেত্র যেন আধুনিক চোখের পুরু পর্দা এক টানে ছিঁড়ে ফেলছিল। কুখ্যাত ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পরেও, বাংলায় তথা ভারতে মহামারীর প্রকোপ বজায় ছিল দীর্ঘদিন। তার অন্যতম কারণ ছিল এশিয়াটিক কলেরা। সাধারণ মানুষ যাকে ওলাওঠা বলত। সুদূর টেমসের পাড়ে বসেও চিন্তিত ছিলেন একজন। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। সেবাই ছিল যাঁর জীবনের মূল মন্ত্র।

ভারতের মাটিতে কোনওদিন তাঁর পা পড়েনি বটে, তবে এ দেশের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল বহুধা বিস্তৃত। এই যোগাযোগের সূত্রপাত ১৮৫৭ সাল। মহাবিদ্রোহের হাত ধরে। তার আগে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ দেখেছে এক একলা নারীর অসম্ভব আত্মত্যাগের সজলঘন ছবি। দিনরাত এক করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর শুশ্রূষা করে সারিয়ে তুলেছেন ক্ষত। সারাতে চেয়েছিলেন হিংসার ক্ষতও। ব্রিটিশ সরকার বুঝেছিল, একটি সুস্থ সেনাবাহিনীই তার সাফল্যের মূল সূত্র হতে পারে। আর এই কাজ ফ্লোরেন্সের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। ভারতে বিদ্রোহের সময় অসুস্থ জওয়ানদের চিকিৎসার জন্য ফ্লোরেন্সের মতামত চায় সরকার। তাঁর তত্ত্বাবধানেই গড়ে ওঠে একটি রয়্যাল কমিশন। মহিলা হওয়ার কারণে তিনি নিজে অবশ্য এই কমিশনের সদস্য হতে পারেননি। কিন্তু তাঁর নির্দেশেই সমস্ত কাজকর্ম চলতে থাকে। ১৮৫৮, ১৮৫৯ এবং ১৮৬২ সালে তিনটি ঐতিহাসিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন রয়্যাল কমিশনের সদস্যরা। আসলে প্রতিটা প্রতিবেদন ফ্লোরেন্সের নিজের হাতে লেখা। এর মধ্যেই তিনি বেশ বুঝতে পারছিলেন, দেশের সামগ্রিক জনজীবনের উন্নতি না ঘটিয়ে সৈন্যবাহিনীকেও সুস্থ করে তোলা যাবে না। ১৮৬৩ সাল থেকেই তিনি একটি বৃহৎ উদ্যোগের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। দেশজুড়ে চলতে থাকা মহামারীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্যোগ। তখন এদেশের শাসক বড়লাট লর্ড মেয়ো। বড়লাট এবং কয়েকজন ব্রিটিশ অফিসার সাময়িক আগ্রহ দেখালেও শেষ পর্যন্ত ফ্লোরেন্স কোনও সহযোগিতা পাননি তাঁদের কাছ থেকে। ফ্লোরেন্স জোর দিয়েছিলেন সেচ ব্যবস্থার উন্নতির বিষয়েও। অথচ খাল কেটে তেমন লাভ হয় না। বরং রেললাইন বসাতেই সরকারের আগ্রহ ছিল বেশি। ফ্লোরেন্স অবশ্য পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছিলেন, মহামারীর প্রকোপ কমাতে পারলে সরকারের খাজনার পরিমাণও অনেকটাই বাড়বে। কিন্তু সেদিকে শেষ পর্যন্ত কান দেয়নি অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসক।

১৮৬৭ সালে রেভারেন্ড জেমস লং এবং মেরী কার্পেন্টার তৈরি করলেন বেঙ্গল স্যোশাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন। লং সাহেব চিঠি লিখলেন ফ্লোরেন্সকে। এই সভার সভ্য হওয়ার আবেদন জানালেন। সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি জানিয়ে লং সাহেবকে চিঠি লিখলেন ফ্লোরেন্স। আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু। লং সাহেব এবং মেরী কার্পেন্টার এদেশের অবস্থার খুঁটিনাটি লিখে জানাতে লাগলেন ফ্লোরেন্সকে। ফ্লোরেন্স ইংল্যান্ডে বসেই দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য নানা পরামর্শ দিতে লাগলেন। ফের ব্যর্ত ফ্লোরেন্স। তাঁর পরামর্শ কার্যকর করতে গেলে সরকার অথবা জমিদারদের উপর চাপ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কিন্তু সমিতির কাজ বিচার বিশ্লেষণ করা, বিক্ষোভ দেখানো নয়। এই অজুহাতে শেষ পর্যন্ত আর কিছুই হল না। তবে মহারাষ্ট্র এবং গুজরাতে কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করেছিলেন। এর মধ্যে লর্ড মেয়ো মারা গেলেন ১৮৭২ সালে। ১৮৭৮ সালে জেমস লং ইংল্যান্ডে ফিরে গেলেন। স্যোশাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের কাজও বন্ধ হল। কিন্তু ফ্লোরেন্সের চিন্তার জগৎ থেকে ভারতের নাম মুছে গেল না। ইংল্যান্ডের নানা সংবাদপত্রে এবং বিভিন্ন সভায় একাধিক প্রবন্ধ লিখতে লাগলেন ফ্লোরেন্স। ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রতিবেদন ঘিরে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল সাধারণের মনে। খাল কাটা বনাম রেলপথ, এই নিয়ে জোর তর্ক চলত লন্ডনে। এদেশের কৃষকদের শিক্ষিত করে তোলার প্রয়োজনও বুঝেছিলেন ফ্লোরেন্স। ভারতবর্ষের কৃষকদের উন্নতির কথা ভেবে গিয়েছেন শেষদিন পর্যন্ত।

১৯১০ সালে তাঁর মৃত্যুর পরেও দেখা যায় ঘরভর্তি ছড়িয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ আর পরিসংখ্যান। তার অধিকাংশই ভারতবর্ষের বিষয়ে। আসলে মানুষের দুর্দশা তাঁকে সবসময় পীড়িত করেছে। সে মানুষ ইংরেজ হোক, বা ভারতীয়।

All that poets sing of the glories of this world seem to me untrue.
All the people I see are eaten up with the care or poverty or disease.

 এমন দরদী মন নিয়েই মানবসেবায় নিজেকে আজন্ম নিয়োজিত করেছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। আঠারোশো কুড়ি সালের বারোই মে ইংল্যান্ডের এক অভিজাত পরিবারে জন্ম। আসল ভালবাসা ছিল আর্ত মানুষের সেবা। কিন্তু ভিক্টোরিয়ান আবহাওয়ায় থেকে নিজেকে সেবাকার্যে ব্যাপৃত করা ছিল কার্যত অসম্ভব। প্রচুর সাধনায় সে অনুমতিও আদায় করেন পরিবারের কাছ থেকে। ফ্লোরেন্স তখন তিরিশ। নাইটিঙ্গেল পরিবার তখন জার্মানিতে। কাইজারবাখ হাসপাতালে পেশাদার ট্রেনিং শুরু ফ্লোরেন্সের, একজন নার্স হিসেবে। পরের বছর পরিবারের সঙ্গে লন্ডনে ফিরে আসেন। কাজ শুরু করেন একটি ছোট হাসপাতালে। আঠেরোশো চুয়ান্নয় যোগ দেন কিংস কলেজের হাসপাতালে নার্সিং সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে। তখনই তিনি সারা লন্ডনে সমাদৃত একজন দরদী সেবাকর্মী হিসেবে।

বলকান অঞ্চলে রাশিয়া ব্রিটেন আক্রমণ করল। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে প্রচুর সৈন্যের প্রাণ যাচ্ছে। যাঁরা বেঁচে থাকছেন তাঁদের অবস্থাও বেশ সঙ্গিন। আহত সৈনিকদের শুশ্রূষা ও চিকিৎসার অবস্থা খুব খারাপ। ফ্লোরেন্সের কাছে প্রস্তাব আসে হাল ধরার। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রায় ৩০০ মাইল দূরে স্কুটারি। আজকের তুরস্কের ইস্তানবুল থেকে খুব দূরে নয়। সেখানকার সেনাছাউনি হাসপাতাল তখন আহত সৈনিকদের প্রধান চিকিৎসাকেন্দ্র। ফ্লোরেন্স সেখানে পৌঁছে দেখলেন কী নিদারুণ উদাসীনতায় ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন আহত সৈনিকেরা। দুমাস নিরলস পরিশ্রমের পর অবস্থা খানিকটা আয়ত্তে এল। শুধু হাসপাতালের ব্যবস্থা ঠিক করা নয়, সুদূর লন্ডন থেকে যথেষ্ট পরিমাণ চিকিৎসা ও অন্যান্য সামগ্রী আনার ব্যবস্থা তাঁকেই করতে হয়েছিল। নিয়মিত জোগান যাতে থাকে, সে ব্যবস্থাও। আজকের ভাষায়, হাসপাতালের সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, চিকিৎসক ও কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করা, আহতদের চিকিৎসা সেবায় নিজেদের সহমর্মী মন নিয়ে। রাত এগারোটার পর সবাই যখন সারাদিনের পরিশ্রমের শেষে নিদ্রায় নিমগ্ন, ফ্লোরেন্স তখন টহল দিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক ওয়ার্ড, বিল্ডিং। হাতে ছোট্ট একটি ল্যাম্প। এই কল্পনা থেকেই পরবর্তীতে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলকে অভিহিত করা হয় ‘দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’। উদাসীনতার অন্ধকার দূর করার আলোকবর্তিকা হাতে সেবার প্রতিমূর্তি এক মহিয়সী মানবী।

যদি এই সেবার প্রতিমূর্তি ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের সবচেয়ে জনপ্রিয় পরিচিতি হয়, তবে দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় প্রথম চিকিৎসা সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসেবে। চিকিৎসা এবং আনুষঙ্গিক সেবার ধরন পাল্টে যায় ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের তথ্যভিত্তিক সেবা মডেলের পর। ফ্লোরেন্স দেখেছিলেন সেনা হাসপাতালে মৃত্যুর ষাট শতাংশই রোগ সংক্রমণের জন্য। আঘাতে মৃত্যুর তুলনায় অনেক বেশি এই মৃত্যুহার। যা ১৬৬৫ সালের কলেরার মৃত্যুহারের থেকেও বেশি। এপ্রিল ১৮৫৪ থেকে মার্চ ১৮৫৫, এই দুবছরে স্কুটারিতে মৃত্যুর তালিকা তুলনা করে তিনি একটি অসাধারণ গ্রাফ তৈরি করেন। এই একই গ্রাফ দিয়ে দেখাতে পেরেছিলেন কীভাবে মৃত্যুহার কমছে সার্বিকভাবে, আবার একই সঙ্গে মৃত্যুর কারণ কীভাবে পাল্টে গেছে এক বছরের মধ্যে। মৃত্যুহার, তার পরিবর্তন, আবার মৃত্যুর কারণ, সব তথ্য এভাবেও সুন্দরভাবে একটি ছবিতেই প্রকাশ করা যায়, ফ্লোরেন্স প্রথম দেখালেন। এই চার্টের নাম ‘পোলার এরিয়া ডায়াগ্রাম’। অনেকে বলেন, ‘নাইটিঙ্গেল রোজ ডায়াগ্রাম’। ডেটা সায়েন্স বা তথ্যবিজ্ঞানের একটি অতি পরিচিত শাখা ডেটা ভিজুয়ালাইজেশন। ফ্লোরেন্স সেখানেও অগ্রদূত। শহর ও গ্রামের সাধারণ পরিছন্নতা, নিকাশি ব্যবস্থা নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তাঁর রিপোর্টের ভূয়সী প্রশংসা হয়। তাঁর রিপোর্টগুলিতে ছবি ও গ্রাফের বহুল ব্যবহার প্রচলন করেন। এই রিপোর্টগুলি চিকিৎসা ব্যবস্থায় সংখ্যাতত্ত্বের প্রয়োগের এক উজ্জ্বল ঐতিহাসিক উদাহরণ হয়ে আছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আর্কাইভে আজও এগুলি সযত্নে রক্ষিত। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর তিনি নজর ঘোরান সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা কলোনিগুলোর ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর দিকে। তাঁর লেখা ‘নোটস অন দ্য হেলথ অব ব্রিটিশ আর্মি’তে দেখা যায়, আহত সেনাদের চিকিৎসার বা শারীরিক অবস্থার নিয়মমাফিক কোনও তথ্য সংগ্রহ বা নথিভুক্ত করা হচ্ছে না। তাঁর ভাষায়, ‘এক অমূল্য গুপ্তধন আমরা হেলায় হারাচ্ছি, যা কি না হয়ে উঠতে পারত ভবিষ্যতের চিকিৎসকদের প্রধান সহায়।’

এমনকি তৎকালীন ব্রিটেনে সাধারণ নাগরিক হাসপাতালগুলোতেও এর অন্যথা হচ্ছিল না। প্রথমেই কয়েকটি সাধারণ ফর্ম তৈরি করেন প্রত্যেক রোগী ও তাঁর চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য। লন্ডনের সমস্ত বড় হাসপাতালকে অনুরোধ করেন, এই দলিল নিয়মিত সংগ্রহ করতে। এই ভাবে সব হাসপাতালকে একটা সাধারণ তথ্য সংগ্রহ ব্যবস্থার আওতায় আনা গেল। সবাই একই পদ্ধতিতে সমস্ত রোগী ও অসুখকে দলিল করতে শিখলেন। আধুনিক ভাষায় বলতে গেলে তথ্যের স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন সম্পন্ন হল।
পাশাপাশি সরকারকে বাধ্য করলেন রোগের প্রাদুর্ভাব, বাসস্থানের পরিছন্নতা, ইত্যাদি তথ্যকে সেনসাসের অন্তর্ভুক্ত করতে। ফ্লোরেন্সই প্রথম অনুধাবন করেন পরিবেশ পরিছন্নতার সঙ্গে রোগের প্রাদুর্ভাব বা অবলুপ্তির সম্পর্ক গভীর। হাসপাতালে তথ্য সংগ্রহের এই বিশেষ অগ্রণী পদক্ষেপটির পরিণতি খুবই সুদূরপ্রসারী। আজও বিশ্বের সমস্ত হাসপাতাল, সমস্ত দেশে এই একই সাধারণ তথ্য সংগ্রহ ব্যবস্থা চালু আছে। ফলে গবেষকদের কাছে এক অনন্ত তথ্যভাণ্ডার উন্মুক্ত। ফ্লোরেন্সের মডেলের ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে তৈরি হয় আন্তর্জাতিক রোগ ক্লাসিফিকেশন পদ্ধতি। আধুনিক মহামারী বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রে তথ্যবিজ্ঞানের অন্যতম স্তম্ভ এই আইএসডিসি।
সংখ্যাতত্ত্বে এই অভাবনীয় ব্যবহারিক অবদানের জন্য রয়াল সোসাইটি অব স্ট্যাটিস্টিক ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলকে প্রথম মহিলা সদস্য হিসেবে সম্মানিত করে। পরে আমেরিকান স্ট্যাটিস্টিকাল অ্যাসোসিয়েশনও তাঁকে সাম্মানিক সদস্যপদ প্রদান করে। 

নাইটিঙ্গেল যেখান থেকে শুরু করেছিলেন, সেই সামূহিক তথ্য বিশ্লেষণ থেকে আমরা এভাবেই পৌঁছে যাব ব্যক্তিবিশেষের তথ্য বিশ্লেষণে, তার দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতা আন্দাজ করতে পারব। এবং পূর্বানুমান করতে পারব কোনও সম্ভাব্য রোগের। বা বর্তমান রোগের দিকনির্ণয় সম্ভব হবে। এখানে কাজ করতে হবে তথ্যবিজ্ঞানীদের, যাঁদের সহায় হবে আধুনিক তথ্যভাণ্ডার ও আজকের উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি। এবং অবশ্যই চিকিৎসা-গবেষকেরা, যাঁরা কিনা প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণের সিদ্ধান্তকে চিকিৎসাশাস্ত্রের নিরিখে মান্যতা দিতে পারবেন। তথ্য বিশ্লেষণে তত্ত্বগত ভুল হলে সঠিক দিকনির্দেশ করতে পারবেন। এভাবেই তথ্যবিজ্ঞানের হাত ধরে চিকিৎসাশাস্ত্রে এক নতুন যুগের আবাহন হবে, যেখানে একটি প্রধান ভূমিকা নেবে সংখ্যাতত্ত্ব। আগাম অনুমানে সঠিক হয়ে উঠবে চিকিৎসাব্যবস্থা, কমবে অনেক জটিলতা। চিকিৎসা ক্ষেত্রে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের অবদানের প্রতি এর থেকে মূল্যবান আর কোনও শ্রদ্ধা অর্পণ হতে পারে না।
 

মাত্র ১৭ বছর বয়সেই নাইটিঙ্গেল বিশ্বাস করতেন স্রষ্টা তাকে সেবিকা হওয়ার জন্যই পাঠিয়েছেন। নিরলস প্রচেষ্টায় ১৮৫৯ সালে তিনি নাইটিঙ্গেল ফান্ডের জন্য সংগ্রহ করেন প্রায় ৪৫ হাজার পাউন্ড। লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালে নার্সিংকে সম্পূর্ণ পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৮৬০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল। তার বর্তমান নাম ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্কুল অব নার্সিং। ডা. এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েলের সঙ্গে যৌথভাবে ১৮৬৭ সালে নিউইয়র্কে চালু করেন উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ। ১৮৮৩ সালে রানি ভিক্টোরিয়া তাঁকে রয়্যাল রেডক্রস পদকে ভূষিত করেন। প্রথম নারী হিসেবে অর্ডার অব মেরিট খেতাব পান ১৯০৭ সালে। ১৯০৮ সালে লন্ডন নগরীর অনারারি ফ্রিডম উপাধি। ক্রিমিয়া যুদ্ধের পর তিনি বহু দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। নারীমুক্তির জন্যও পূর্ণমাত্রায় সোচ্চার ছিলেন। নাইটিঙ্গেলের বিশ্বাস ছিল, মানবসেবার এমন কাজে নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য ঈশ্বরের কাছ থেকে তাঁর ডাক এসেছে। এখন যাঁরা এই পেশায় নতুন আসেন তাঁরা ‘নাইটিঙ্গেল প্লেজ’ নামে একটি শপথ গ্রহণ করে তাঁর প্রতি সম্মান জানান। ১৯৭৪ সাল থেকে তাঁর জন্মদিন ১২ মে পালিত হয়ে আসছে ‘ইন্টারন্যাশনাল নার্সেস ডে’।

ইস্তাম্বুলে তাঁর নামে চারটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। লন্ডনের ওয়াটারলু ও ডার্বিতে রয়েছে তাঁর প্রতিকৃতি। লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালে রয়েছে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল মিউজিয়াম। ব্রিটিশ লাইব্রেরি সাউন্ড আর্কাইভে সংরক্ষিত রয়েছে তাঁর কণ্ঠস্বর, যেখানে তিনি বলেছেন, যখন আমি থাকব না, সেই সময় আমার এই কণ্ঠস্বর আমার মহান কীর্তিগুলোকে মানুষের কাছে মনে করিয়ে দেবে এবং এসব কাজের জন্য উৎসাহ জোগাবে। দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ হয় ১৯২৯ সালে, যার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন এডিথ ইভানস। তাঁর জীবনী নিয়ে চারটি সিনেমা তৈরি হয় ১৯১২, ১৯১৫, ১৯৩৬ ও ১৯৫১ সালে। ১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট ৯০ বছর বয়সে এই মহীয়সী নারী চলে যান পৃথিবী ছেড়ে প্রশান্তি নিয়ে। মৃত্যুর সময় তিনি নিজের বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন। ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারে সেন্ট মার্গারেট চার্চে তাঁকে সমাহিত করা হয়

 জন্মদিনের নিরন্তর শুভেচ্ছা, নাইটিঙ্গেল!  আলো হাতে চলিয়াছো তুমি, তোমার আলোয় চির ভাস্বর 

RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments