সুনামির মতো ফেক নিউজ আসছে, এবং সে সব যে বেশ খেটেখুটে এক ফ্যাক্টরিতেই তৈরি করা তাও পরিষ্কার। যে যা পারছেন লিখে যাচ্ছেন, যা খুশি। লিখুন, মতামত দেওয়ার অধিকার প্রত্যেকের আছে, থাকাই উচিত, কিন্তু তথ্য দেওয়ার আগে যাচাই করার দরকার নেই? কোনও এক অঙ্কিতা বাউড়ি নামে একজন নাকি সেই রিক্লেইম দ্য নাইটের রাতে ঘরে ফেরার পথে ধর্ষিতা হয়েছেন, নিখোঁজ, মৃত, এইসব লেখা হল, লিখলেন কারা? যাঁদের সমাজমাধ্যমে মানুষের চোখ থাকে, তারপর লক্ষ মানুষ দেখার পরে টুক করে সেটা তুলে নিলেন। ইতিমধ্যে লক্ষ মানুষ অঙ্কিতার ধর্ষণ আর মৃত্যুর দাবি তুলছেন। একজন একটা অডিও রেকর্ডিং করলেন, তারপর তা ভাইরাল হয়ে গেল, আমি সোমা বলছি রে, জানিস তো, ওকে না জরাসন্ধের মতো চিরে ফেলা হয়েছে, ব্যস। সেই ভাইরাল ক্লিপ আপাতত উধাও কিন্তু তার বেসিসে প্রশ্ন উঠেছে, ওই চারজন ডাক্তারের ফাঁসি চাই। এক হাফ সাংবাদিক লিখলেন, এই ছবির ছেলেটিকে চেনেন, তাহলে পুলিশকে খবর দিন। কেন? সেসব উহ্য থাকল, বুঝিয়ে দেওয়া হল এই মুহূর্তে এই হল পালের গোদা, তারপর সেই পোস্ট তিনি তুলে নিলেন, কিন্তু বিষয় আর ছবি ভাইরাল। আরজি করে চিকিৎসক-ছাত্রীকে খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় এমন বহু তথ্য অনায়াসে ছড়িয়েছে সমাজমাধ্যমে। যার অধিকাংশই ভুয়ো বলে দাবি পুলিশের। ইতিমধ্যেই লালবাজার সমাজমাধ্যমে ভুয়ো তথ্য ছড়ানোর দায়ে শ’ খানেক মানুষজনকে নোটিস পাঠিয়েছে। এবং যেহেতু বিরাট অংশের মানুষের মধ্যে প্রথম ধারণাটা এটাই ছড়ানো হয়েছে যে পুলিশ নিজেই এই ব্যাপারে জড়িত তাই তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাও তলানিতে। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক থেকে ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, যা ছড়ানো হচ্ছে তার সব কিছু ঠিক নয়। মনোরোগ চিকিৎসকদের দাবি, ‘‘ভুয়ো তথ্যের বিস্ফোরণ ঘটেছে। ভীত সমাজকে এই ভুয়ো তথ্যের ভাণ্ডার আরও আতঙ্কিত করে তুলছে।’’ সমাজমাধ্যমে কয়েকদিন ধরে ঘুরছে তরুণীর সুরতহালের রিপোর্ট। তারপরেই ছড়ায় যে, ঘটনাস্থল থেকে ১৫০ গ্রাম বীর্য, সেমিনাল ফ্লুইড পাওয়া গেছে। সে সবের ভিত্তিতে আরও ছড়িয়েছে যে, নির্যাতিতার ‘পেলভিক বোন’ ও ‘কলার বোন’ ভাঙা হয়, পা মাঝখান থেকে ৯০ ডিগ্রি কোণে চিরে দেওয়া হয়। ঘটনার সময়ে তরুণীর হাত-পা অন্য কেউ চেপে ধরেছিল। অর্থাৎ, খুনি এবং ধর্ষক একাধিক। এবং এসব পড়ার, জানার পরে বহু মানুষ পুলিশ প্রশাসন আর সরকারের কাছে জবাব চাইছেন। যা নেই, যা ঘটেনি, তার জবাব দেওয়া সম্ভব নয়, অতএব সরকার বা প্রশাসনের তরফে বড় জোর বলা হচ্ছে এগুলো ফেক নিউজ, তখন আরও জোরে চিৎকার উঠছে, এড়িয়ে গেলে চলবে না, জবাব চাই জবাব দাও। অঙ্কিতা বাউড়ির ধর্ষকদের গ্রেফতার করতে হবে ইত্যাদি। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, রাশি রাশি ফেক নিউজের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে ধর্ষিতার আর্তনাদ।
এসব ফেক নিউজ কি ভুয়ো অ্যাকাউন্ট থেকে ছড়ানো হচ্ছে? তাও নয়, শুভেন্দু অধিকারী তাঁর টুইটার হ্যান্ডেলে ৫টা পয়েন্ট দিয়েছেন, যা তিনি নাকি জেনেছেন, কী সেগুলো? ১) মৃতার ভিসেরা বদলে দেওয়া হয়েছে। ২) এই ঘটনাতে আরও কয়েকজন জড়িত ছিল। ৩) রক্তের স্যাম্পল ইত্যাদি বিভিন্ন তথ্য যা কলকাতা পুলিশ সংগ্রহ করেছিল, তা বদলে দেওয়া হয়েছে। ৪) ওয়াশ বেসিন বদলে দেওয়া হয়েছে। ৫) মৃতাকে অন্য কোথাও হত্যা করে ওই কনফারেন্স রুমে রাখা হয়েছিল। সাংঘাতিক ব্যাপার, রাজ্যের বিরোধী দলনেতা এসব জানেন, প্রমাণ? তথ্য? না সেসব দেওয়ার দরকার তিনি মনে করেননি।
আরও পড়ুন: Aajke | রোগীরা কী অপরাধ করল?
এই রাজ্যের একজন বিধায়ক, অগ্নিমিত্রা পল, তিনি জোর গলাতেই বলছেন এই সঞ্জয় রায়কে ফাঁসানো হয়েছে, অর্থাৎ ছেলেটি নির্দোষ, কে বলছেন? একজন নির্বাচিত বিধায়ক। আচ্ছা তিনি যদি সবটাই জানেন তাহলে তিনি সিবিআই-এর কাছে যান, বলুন আসলে কী ঘটেছিল। বলেছেন? বলবেন? বলবেন না। কিন্তু এই বক্তব্যের ভিত্তিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই কথাগুলো বলে যাচ্ছেন। কেন করছেন? কেন ফুটবল ডার্বি বাতিল হল? এই অবস্থাতে অতবড় মানুষের জমায়েত সামলাতে পুলিশ দেওয়া সম্ভব নয়, এবং এই অবস্থাতে আরও কিছু ঘটনা ঘটে যাক সেটা চাইছে না সরকার। অনুমতি দিল না, তার প্রতিবাদ চলছে, যদি অনুমতি দিত, কিছু ঘটে যেত, তাহলে তো কথাই নেই। এমনিও অনুমতি দিলে সমাজমাধ্যমে লেখা হত, শোকের আবহে ফুটবল খেলার আয়োজনে হাজার পুলিশ মোতায়েন। আপনার মনে হতেই পারে যে এই কাজ একজনের নয়, আপনি লিখুন। আপনার মনে হতেই পারে যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিছু লোকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে, লিখুন, কিন্তু এই মিথ্যে তথ্য দিয়ে আসলে কোন উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে? তৃণমূলের রাজ্যসভার সদস্য, শুখেন্দুশেখর রায়, তিনি তাঁর এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, কুকুর কেন নিয়ে যাওয়া হল তিন দিন পরে? কেন পুলিশ কমিশনারকে কাস্টডিয়াল ইন্টারোগেশন, মানে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না? এদিকে তথ্য বলছে ওই ৯ তারিখেই সন্ধ্যেবেলা গিয়েছিল, আবার গিয়েছিল ১২ তারিখে। শুখেন্দুশেখরের বিবেক দংশনের কারণ কি দলের মধ্যে অন্য কোনও সমীকরণ জানি না, কিন্তু মিথ্যে বলছেন, এটা জানি। একদল করছেন যাঁদের এজেন্ডা আছে, সেই আমার নানা রংয়ের দিনগুলো ফেরানোর, একদলের এজেন্ডা আছে ওই নানা রংয়ের দিনগুলো আনার, একদলের এজেন্ডা হল এই নানা রংয়ের দিনগুলোকে বজায় রাখার। কিন্তু মধ্যিখানে তাঁদের এজেন্ডার তলায় চাপা পড়ছে আসল কথাগুলো, সেই সব রাজনৈতিক এজেন্ডা, ছকবাজির তলায় চাপা পড়ছে মূল অপরাধ। আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, এক নৃশংস হত্যা, ধর্ষণের বিচার চাওয়ার জন্য এত মিথ্যে কেন? কেন রাশি রাশি ফেক নিউজ ছড়ানো হচ্ছে? শুনুন মানুষজন কী বলছেন?
মিথ্যা তৈরির কারখানা আছে জানা ছিল, তা থেকে রাশি রাশি মিথ্যে ছড়ানো হচ্ছে জানা ছিল, কিন্তু এরকম এক জঘন্য ধর্ষণ হত্যাকাণ্ডকে সামনে রেখে মিথ্যের এই জোয়ার তৈরি করে সমস্ত বিষয়গুলোকে সরিয়ে যে সুনামি আনা হল তার তলাতেই পড়ে থাকবে আমাদের কন্যার আর্তনাদ। এই অজস্র তৈরি করার মিথ্যেকে সামনে রেখেই অভিযুক্ত তৈরি করবে তার বয়ান, সেদিন আমাদের বিবেকের সামনে আমাদেরই জবাবদিহি করতে হবে, মাথায় রাখুন, তৈরি থাকুন।