শেষপর্যন্ত এক কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়ে আরজি কর নির্যাতিতার অভিভাবকদের পাশ থেকে সরে গেলেন আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার। তাঁর তরফে, তাঁর দফতর থেকে জানানো হয়েছে যে তাঁরা যে কোনও মামলাকে আইন, সাক্ষ্যপ্রমাণ আর আইনজীবীদের নৈতিকতার দিক থেকেই বিচার করি। জানালেন যে তাঁদের কাজে বাইরে থেকে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে যে কারণে তাঁরা এই মামলা থেকে সরে যাচ্ছেন। তাঁরা এই বিবৃতিতেই জানিয়েছেন যে এই মামলার প্রতিটি স্তরে বৃন্দা গ্রোভার নিজে বা তাঁর সহযোগী আইনজীবীরা কাজ করেছেন, ঠিক যা যা করার ছিল তা করেছেন। গতকাল সন্ধে নাগাদ এই বিবৃতি জারি করে তাঁরা সরে গেলেন। ১৩ তারিখ এই ধর্ষণ খুনের মামলাতে আরজি কর প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ আর টালা থানার ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে আদালতে পেশ করার কথা, আর দু’ তিন দিনের মধ্যে সাক্ষ্যপ্রমাণ নেওয়া শেষ হবে। এইরকম একটা ক্রুসিয়াল মোমেন্টে তিনি সরে গেলেন কেন? আচ্ছা এই বৃন্দা গ্রোভার কে? উনি সোনি সোরির হয়ে মামলা লড়েছেন, যাঁরা নামের সঙ্গে মাওবাদী তকমা ছিল, ১৯৮৪-র শিখ দাঙ্গার মামলা লড়েছেন, হাসিমপুরা পুলিশ কিলিং মামলাতে লড়েছেন, ২০০৪-এ ইসরত জাহান মামলা তাঁর হাতে ছিল যেখানে গুজরাত সরকারের বিরুদ্ধে ঠান্ডা মাথায় এনকাউন্টারের অভিযোগও ছিল। এই মামলাতে অমিত শাহের নামও জড়িয়ে ছিল, শিশুদের উপর যৌন অত্যাচার, ধর্ষণের আইন রচনার সময়ে কাজ করেছেন। সাধারণভাবে তিনি ২০-২৫ লক্ষ টাকা ফি নেন একটা মামলাতে হাজির হওয়ার জন্য, কিন্তু এই আরজি কর মামলাতে তিনি নিজে কোনও ফি নেননি। মামলাটি শুনেই তিনি অভয়ার অভিভাবকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই সময় যখন বিকাশ ভট্টাচার্য এই মামলা লড়বেন না বলে জানিয়ে দেন। কাজেই এই নিয়ে দু’জন আইনজীবী ওই পরিবারের আইনি সহায়তা দেওয়ার জায়গা থেকে সরে এলেন। কাজেই সেটাই বিষয় আজকে, অভয়ার আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার সরলেন, দায়ী ডাঃ কিঞ্জল নন্দ অ্যান্ড কোম্পানি।
বৃন্দা গ্রোভার সরে এলেন, তার কারণ হিসেবে জানিয়েছেন যে বাইরের হস্তক্ষেপের কারণেই তিনি এবং তাঁর সহযোগীরা এই মামলা থেকে সরে যাচ্ছেন। বাইরে মানে কারা? কারা হস্তক্ষেপ করছিলেন? বৃন্দা গ্রোভার এই বাজারে বিলকিস বানোর মামলা লড়েছেন, অমিত শাহের বিরুদ্ধে ইসরত জাহানের মামলা লড়েছেন, কাজেই সিবিআই তাঁর কাজে হস্তক্ষেপ করছিল এটা হতেই পারে না। আর বাংলার রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপ? প্রশ্নই নেই, তেমন হলে ঐ সুপ্রিম কোর্টেই তা খোলসা করে জানিয়ে দিতেন বৃন্দা গ্রোভার। কলকাতা পুলিশের এই দম নেই, থাকার কথাও নয় কারণ তারা এই মামলার দায়রাতেই আর নেই। তাহলে হস্তক্ষেপ করল কারা?
আরও পড়ুন: Aajke | শারদীয়া উৎসব বয়কট, ফিল্ম উৎসবে সব্বাই আছেন
এই মামলা ছিল কার কাছে? বিকাশ ভট্টাচার্য বিনা পয়সাতেই এই মামলা লড়তে রাজি হয়েছিলেন, এই অভিভাবকদের সঙ্গে দীর্ঘ আইনি আলোচনাও করেছেন। এরপরে এক বিরাট হাইপ উঠল, সুপ্রিম কোর্টে আজ শুনানি, আজই বিচার চাই, ডাক্তারবাবুরা, ওই ডাঃ কিঞ্জল নন্দ অ্যান্ড কোম্পানি হাজির থাকলেন রাস্তায়, আজই বিচার চাই। কী হল? আমরা দেখলাম কী সব সাংকেতিক ভাষায় কথা চলছে আর সেসব কথার মধ্যেই বিকাশবাবু মাত্র দুটো কি তিনটে শব্দ যোগ করেছেন। সেদিন রাস্তায় আন্দোলনকারীরা প্রত্যেকে বার অ্যাট ল হয়ে উঠেছিলেন, আইনের প্যাঁচ পয়জার বোঝাচ্ছিলেন। তো তেনাদের মুখে শুনলাম দুউউস, বিকাশ বাবু তো শাস্তির দাবিটাও তুললেন না। কে ঐ পণ্ডিতদের বোঝাবে যে অভিযুক্তের শাস্তির দাবি তোলার জায়গাই ওটা নয়, কিন্তু গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটে গেল, বিকাশদার কম্ম নয়। বিকাশ ভট্টাচার্য একবার বললেন বটে যে আরে বাবা বিচার শুরু হতে দিন, তারপরে আন্দোলনের ক্ষতি হয়ে যাবে সম্ভবত এই ভেবেই চুপ করে গেলেন। পরের শুনানিতে ওনাকে দেখাই গেল না, তারপর উনি জানিয়েই দিলেন উনি নেই। কিন্তু ওই কিঞ্জল নন্দ অ্যান্ড কোম্পানিরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে আছে দু’ তিন পুরুষ ধরে আন্দোলন করেই বেঁচে থাকা আন্দোলনজীবীর দল। তেনারা এর আগেও বহু লড়াইকে ওই দিল্লির সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে হাজির করেছেন, তাঁদের পরামর্শেই যোগাযোগ করা হল বৃন্দা গ্রোভারের সঙ্গে, আরজি কর তখন হট টপিক, তাই প্রো বোনো, মানে তেমন কোনও আর্থিক লেনদেন ছাড়াই মামলা হাতে নিলেন বৃন্দা গ্রোভার। তিনি তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ফেলার জন্য মামলা হাতে নেননি, ওদিকে তাঁকে নিয়োগ যাঁরা করেছেন বা ব্যবস্থা করেছেন তাঁদের তো ওয়ান পয়েন্ট এজেন্ডা ছিল ওটাই, দফা এক দাবি এক মূখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ। কাজেই কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট শুরু হল। এখানে সরকার জড়িত, সরকারের দুর্নীতি জড়িত, তাদের চক্রান্তের ফলেই হয়েছে এই খুন আর ধর্ষণ, সঞ্জয় রায়কে তো ফাঁসানো হয়েছে ইত্যাদি প্রি কনসিভড আইডিয়া। আগে থেকে ভেবে রাখা ধারণা নিয়েই তো তাঁরা মাঠে নেমেছেন, বৃন্দা গ্রোভার নেমেছেন সাক্ষ্যপ্রমাণ, আইন আর পেশাগত নৈতিকতা নিয়ে। কাজেই ঠোকাঠুকি হতে বাধ্য। হল কখন? মাত্র তিন দিন আগেই ওই অভয়ার অভিভাবকরা আবারও জোরের সঙ্গে বলেছেন যে তাঁরা বিচার পাচ্ছেন না, সুপ্রিম কোর্ট, সিবিআই তাঁদের কথা শুনছে না, এমনকী চার্জশিট জমা করার আগে তা তাঁদের দেখানোও হয়নি। আমাদের জানা নেই সিবিআই চার্জশিট পেশ করার আগে তা অভিযুক্তের বা ভিকটিমের বাবা-মাকে দেখাবে এমন কোনও শর্তে এই বিচার শুরু হয়েছিল কি না কিন্তু এই দাবি অন্যায্য, বেআইনিও বটে। তাঁরা বলছেন রাজ্য সরকার এই ধর্ষণ খুনে জড়িত আছে, এটা বলার ক’দিন আগেই তাঁরা বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর উপর তাঁদের ভরসা আছে। সেই সময় কলকাতা পুলিশও ঠিকঠাক তদন্ত করছে এমন কথাও তাঁরা বলেছেন, যদিও তা নাকি তাঁদের চাপ দিয়ে বলানো হয়েছে বলে পরে বলেছেন, যদিও সেই চাপ দেওয়ার কথাটা সিবিআইকে জানাননি। পরে বলেছেন দেশের সুপ্রিম কোর্টের উপরে তাঁদের বিশ্বাস আছে, তার ক’দিন পরেই বলছেন ওখানে তো বিচারই হচ্ছে না। এই পরস্পর বিরোধী কথা তাঁরা কেন বলছেন? কারণ এই জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠন ওই ডাঃ নন্দ অ্যান্ড কোম্পানি মিলেই এক ন্যারেটিভ তৈরি করেছিলেন। তাঁদের এজেন্ডা অনুযায়ী, তাঁদের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম এই অভিভাবকদের গলায়। আর সেটা শুনেই বৃন্দা গ্রোভার ইউ টার্ন নিলেন, বেরিয়ে গেলেন মামলা থেকে। কারণ তিনি চাইছেন আইনের পদ্ধতি মেনে বিচার আর তাঁর ক্লায়েন্ট ওই ডাঃ নন্দ অ্যান্ড কোম্পানির কথা মেনে তাঁদের ন্যারেটিভ অনুযায়ী এক সরকারের বিরুদ্ধে জেহাদে নেমেছেন। ওই নন্দ অ্যান্ড কোম্পানি এক ক্যাঙ্গারু কোর্ট বসাতে চায় যেখানে তাঁরা যাঁদের দোষী মনে করছেন তাঁদের ফাঁসি দিতে হবে। সমস্যা হল সেটাতে তো বৃন্দা গ্রোভারের মতো একজন আইনজীবী সায় দিতে পারেন না। কাজেই তিনি সরে গেলেন। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, প্রথমে বিকাশ ভট্টাচার্য, তারপরে বৃন্দা গ্রোভারের মতো আইনজীবী মামলা ছেড়ে দিলেন। এই নিয়ে দ্বিতীয় আইনজীবী সরে গেলেন আরজি কর ধর্ষিতা মৃতার পাশ থেকে। আসলে ওই জুনিয়র ডাক্তারদের তৈরি করা এক কল্পিত অপরাধীদের চিহ্নিত করে নির্বাচিত রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধেই আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা থেকেই ওই অভিভাবকদের ভুল বুঝিয়েছিলেন ডাঃ কিঞ্জল নন্দ অ্যান্ড কোম্পানি। তাই কি এমনটা হচ্ছে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
বৃন্দা গ্রোভার একজন দক্ষ আইনজীবী, তিনিও সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখেছেন, তিনি জানেন এই মামলার ফলাফল, তিনি জানেন প্রত্যক্ষভাবে আর একজনও এই মামলাতে জড়িয়ে নেই। তিনি জানেন এরপরেই এই মামলা থেকে এক্কেবারে খালাস পেয়ে যাবেন সন্দীপ ঘোষ আর টালা থানার ওসি। হ্যাঁ, সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করা যেতেই পারে, সেটাও কম নয়, কিন্তু আইনের মন্দিরে এমন আলফাল কথা বলে মামলার গুরুত্ব হালকা করে দেওয়ার যে কাজ এই ডাক্তারেরা করলেন তা ক্ষমার অযোগ্য। অত্যন্ত ভদ্র বলেই কেবল হস্তক্ষেপের কথা বলেই এই মামলা থেকে সরে গেলেন বৃন্দা গ্রোভার, যিনি বিলকিস বানো মামলার রায় এনে দিয়েছিলেন।