ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি যে নিছক একটা কাগজ, তা যে কিছুই প্রমাণ করে না, বা বলা ভালো তা আছে বলেই যে কাউকে শিক্ষিত বলে ধরে নিতেই হবে, তা যে নয়, সেটা আরেকবার প্রমাণ হল আমাদের কাঁথির খোকাবাবুর কথাবার্তায়। গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক, এবং তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন বিরোধী দলের নেতা, তিনি বললেন সবকা সাথ সবকা বিকাশ চলবে না। বলতেই পারেন, স্লোগান তো নরেন্দ্র মোদির, দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ তো আগেই জানেন ওই স্লোগান হল ১০০ শতাংশ বিশুদ্ধ ঢপবাজি। কাজেই শুভেন্দু মোদিজির ওই স্লোগান রাখবেন না ফেলে দেবেন নাকি কেটে ছেঁটে নিজের মতো করে নেবেন সেটা তো একান্তভাবেই তাঁর ব্যাপার। তিনি বলেছেন নো নিড ফর সংখ্যালঘু মোর্চা, পাড়ার পানের দোকানে, চায়ের দোকানে এরকম আধা ইংরিজি আধা বাংলা মেশানো কথা বলে খানিক উচ্চতা পাওয়া যায়, কাঁথির খোকাবাবুর সে স্বভাব এখনও যায়নি, তিনি বললেন নো নিড ফর সংখ্যালঘু মোর্চা। সত্যি তো বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চা তো আসলে এক সোনার পাথরবাটি। এক আদন্ত্য আনখ হিন্দুত্বের গোঁড়া হিন্দুত্বের এজেন্ডা নিয়ে চলা এক দলের সংখ্যালঘু মোর্চা মানে পয়সা দিয়ে কিছু দালাল পোষা, তাও তো আমরা সব্বাই জানি। কাজেই উনি ওনার দলের সংখ্যালঘু মোর্চা রাখবেন না ছুড়ে ফেলে দেবেন, আগামিকাল থেকে চার্লস নন্দী মুরলীধর লেনের ফুটপাথেই বসে থাকবেন কি না, জেলার ১৮ জন সংখ্যালঘু মোর্চার সভাপতিরা দল থেকে বহিষ্কৃত হবেন কি না তা তো বিজেপির নেতৃত্বই ঠিক করবে এবং সেই অর্থে সুকান্ত বা দিলীপ ঘোষ না মানলেও শুভেন্দু তো এখনও বিজেপি নেতা, কাজেই তাঁর হক আছে, রাজ্যের সংখ্যালঘু মোর্চা তুলে দেওয়ার। শমীক সুকান্ত সমর্থন না করলে কী হবে তিনি তথাগত রায়ের সমর্থন তো নিশ্চিত পাবেন। কিন্তু এসব নিয়ে কথা নয়, কথা হল আমাদের শান্তিকুঞ্জের এই চরম অশান্তির আর একটা কথা নিয়ে, তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন মুসলমানদের উনি রাষ্ট্রবাদী মনেই করেন না। উনি আর মুসলমানদের রাষ্ট্রবাদী বলবেনই না, আর সেটাই আমাদের বিষয় আজকে বাংলার, এই দেশের মুসলমানরা দেশপ্রেমিক নন?
বঙ্গ বিজেপির সমস্ত জেলার নেতা, বিধায়ক, সাংসদ, ক্যাবিনেট মন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর, সুনীল বনসল, মঙ্গল পাণ্ডের সামনেই এক উন্মাদ বললেন, মুসলমানদের উনি রাষ্ট্রবাদী বলে মনেই করেন না, অর্থাৎ তাঁরা রাষ্ট্রদ্রোহী, তাঁরা দেশপ্রেমিক নন, তাঁরা এই রাষ্ট্রের গণশত্রু। এবং তাঁর এই বক্তব্যের পরে একজনও সেখানে প্রতিবাদ করেননি, একজনও হাত তুলে বলেননি যে আপনি ভুল বলছেন অন্যায় বলছেন, কিছু লোকজন তালিও বাজিয়েছেন। ওই সভাতেই উপস্থিত সংখ্যালঘু মোর্চার নেতারা কী কোনও কথা বলেছেন? না, বলেননি কারণ তাঁরা তো জানেন এটাই বিজেপির আদত চেহারা।
আরও পড়ুন: Aajke | রাজ্যপাল বলবেন, মমতা বলবেন না?
কিন্তু রাজ্যের মানুষকে তো জানতে হবে, এই বিজেপির আসল চেহারাটা তো মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে, সেই কাজটা আপনারা প্রত্যেকে শুরু করুন। ওই মূর্খ গোঁয়ার সাম্প্রদায়িক মানুষটাকে বলতে হবে, কাজি নজরুল ইসলাম কে ছিলেন, সেই অর্থে রবি ঠাকুরও ব্রাহ্ম ছিলেন, হিন্দু ছিলেন না, বাংলার শেষ নবাব সিরাজ উদ দৌল্লা লড়েছিলেন ক্লাইভের সঙ্গে, এ বাংলায় জসিমুদ্দিনের কবিতা কে পড়েননি? কে পড়েননি তাঁর নকশী কাঁথার মাঠ? এই কলকাতাতেই বড় হয়েছেন আমাদের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, কার জানা নেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিতুমিরের সেই লড়াইয়ের কথা? এই বাংলার মুসলিম স্থাপত্য কে অস্বীকার করবে কে? আজও এই বাংলার দর্জি আর রাজমিস্ত্রির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ মুসলমান। এই বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকা কে অস্বীকার করবে? নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস তাঁর মহানিষ্ক্রমণের সময়ে নাম নিয়েছিলেন মহম্মদ জিয়াউদ্দিন, তাঁর জার্মানি থেকে টোকিওতে আসার সঙ্গী আবিদুর রহমান, তাঁর শেষ যাত্রার সঙ্গী হাবিবুর রহমান। এটাই আমাদের বাংলার ইতিহাস বাংলার ঐতিহ্য। আমাদের বাংলায় অনায়াসে মিশে যায় আজানের সুরের সঙ্গে মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি। চেষ্টা কি হয়নি এই ভ্রাতৃত্ববোধকে ভেঙে চুরমার করতে, হয়েছে তো, দেশ বিভাজনই তো ছিল সেই পরিকল্পনার সবচেয়ে বড় অংশ। কিন্তু তারপরেও এ বাংলার হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে থেকেছে, এক সে আকাশ মায়ের কোলে যেন রবি শশী দোলে, এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান। আজ এক আহাম্মক সেই নাড়ির সম্পর্ককে ভাঙার কথা বলছে। আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলছেন মুসলমানরা দেশদ্রোহী, মুসলমানরা এদেশের নাগরিক নন, মুসলমানরা এ দেশকে ভালবাসেন না। আপনি কি একমত? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
আসলে এক বেড়ে ওঠার কাহিনি, এক আপব্রিঙ্গিং, যেখানে মানুষকে ধর্ম জাত রং ভাষা দিয়ে আলাদা হতে শেখায়। কিন্তু পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এগুলোকে বাদ দিয়েই এক উন্নত সমাজ গড়ে তোলার কথা বলে, আমাদের ধর্মের জ্ঞানী পণ্ডিত মানুষজন বারবার এই ধর্মে ধর্মে বিরোধের বিরুদ্ধেই কথা বলেছেন, রামকৃষ্ণদেব ধর্মের ফারাক বোঝার জন্য কলমা পড়ে মুসলমান হয়েছিলেন, তারপরে বলেছিলেন যত মত তত পথ। আর কিছু অন্ধ মূর্খ মানুষ এই ধর্মের আড়ালে আসলে নিজের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা চালায়, যেমন শুভেন্দুর আসল দৃষ্টি ওই মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সির দিকে।