সেই দ্রৌপদী বলেছিলেন, আমি নাথবতী অনাথবৎ, আমার পাঁচ পাঁচজন স্বামী আছে কিন্তু আমি অনাথ। বঙ্গ বিজেপির অবস্থা খানিক সেই রকম। সারা দেশে জয়জয়কার, মহারাষ্ট্রে আঞ্চলিক দলের মাথায় চেপে বিজেপি তার ক্ষমতা বাড়িয়েছে। নিশ্চিতভাবেই এরকমই চলতে থাকলে, মানে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ক্রমাগত ভুল হতেই থাকলে আর পাঁচ বছর পরে বিজেপি এই রাজ্যে শরিক দলগুলোর দিকে ফিরেও তাকাবে না যেমন তারা এখন বিজু জনতা দলের দিকে, বা মায়াবতীর দিকে, বা হরিয়ানার জেজেপির দিকে ঘুরেও তাকায় না। ঝাড়খণ্ডে হেরেছে, কিন্তু ভোটের পার্সেন্টেজ-এর দিক থেকে তারাই সব থেকে বেশি ভোট পেয়েছে। উত্তরপ্রদেশে আবার তীব্র উগ্র হিন্দুত্ববাদকে সামনে রেখে তাদের ক্ষয় আটকাচ্ছে, কিন্তু এই বাংলায়? তারা এক চালচুলোহীন, ছন্নছাড়া, দিশাহীন পথিক, যাদের দেখলেই বলতে ইচ্ছে করে, পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ? হোয়ার ইজ দ্য জোশ? সেসব বলার মতোই অবস্থা নয়, ৭৭টা আসন জিতে বিধানসভাতে এসেছিল, পূর্ণিমার চাঁদের মতো ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে রোজ। অমন যে অমন ডাবগ্রাম ফুলবাড়ি, সেখানকার বিধায়ক শিখা চ্যাটার্জি মাত্র গতকাল বিধানসভাতে বলেছেন দিদি, আমাকে একটু বুঝিয়ে দেবেন। বিধানসভাতে ওনার নেতা কথায় কথায় বলেন মমতা বেগম, কালীঘাটের নেত্রী, সেই বিধানসভাতে বসে এক বিজেপি নেত্রী বলছেন দিদি, বুঝিয়ে দিন। এর থেকে অনেক কিছু বোঝার আছে। দলের কমসম করে আরও জনাদশেক বিধায়ক ক্যামাক স্ট্রিটে যোগাযোগ রাখছেন, কালীঘাটের গ্রিন সিগন্যাল পেলেই ওনাদের দলে দমবন্ধ লাগা শুরু হবে। বিধানসভা ছেড়েই দিলাম, রাস্তাতেও বা বিজেপি কই? আর সেটাই বিষয় আজকে, বিজেপি এই রাজ্যে অনাথ, ছন্নছাড়া, দিশাহীন?
কতটা দিশাহীন? কতটা ছন্নছাড়া? কতটা অনাথ? আসুন আলোচনা করা যাক। সেই কবে থেকে শোনা যাচ্ছে যে রাজ্যে একজন ফুলটাইম রাজ্য সভাপতি চাই, কারণ সুকান্ত মজুমদার হাফ হলেও মন্ত্রী তো। কিন্তু হচ্ছে না, তা নিয়ে বাংলা বিজেপির লাউডমাউথ তথাগত রায় সমাজমাধ্যমে একতক্তা লিখেও ফেললেন, জানালেন শুভেন্দুকে রাজ্য সভাপতি করা হোক। কী ভাবছেন, উনি সত্যি করেই শুভেন্দুকে চাইছেন? তত সোজা ব্যাপারটা নয়, বিজেপি দলে দুটো পদ রাখা যায় না, কাজেই শুভেন্দু রাজ্য সভাপতি হলে বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা পদটা যাবে ভোগে। শুভেন্দু রাজি হবেন? কভি নহি। তিনি বড় নেতা, বাংলাতে বিজেপির যাঁরা সক্রিয় তাদের মধ্যে অন্যতম, ৬টা নির্বাচনে গোহারান হারার পরে সাফ জানিয়ে দিলেন, নির্বাচন, প্রার্থী, প্রচার, স্ট্রাটেজি এসব ওনার আওতায় পড়ে না, মানে জানিয়ে দিলেন এসবে বিস্তর ভুল আছে, জানাতে ভুললেন না যে তিনি আদতে ওই পশ্চিম মেদিনীপুরের নেতা, বললেন সেখানে দুটো আসনেই তো জিতে দেখিয়েছি।
আরও পড়ুন: Aajke | এখন সিসিটিভিতে আপত্তি কেন ডাক্তারবাবুরা?
কিন্তু যে দল ২০১৯-এ ৪০.২৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, সেই দল কেন ২০২৪-এ কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী আর নির্বাচন কমিশনের যাবতীয় সুবিধে নিয়ে, টাকার পাহাড় খরচ করে, ধুঁয়াধার প্রচার চালিয়েও শেষ পর্যন্ত ৩৮.৭৭ শতাংশ ভোট পেল কেন, সেটা বলেননি। ২১-এর পর থেকে প্রতিটা বাই ইলেকশনে বিরাট হার, কিন্তু বিজেপির এ রাজ্যে তিন ঘোড়া তিনমুখো, শুভেন্দু বলে আমায় দেখ, দিলীপ বলে আমায়, সুকান্ত মজুমদার কী যে বলেন ওনার দলের লোকজনেরাই বুঝে উঠতে পারে না তো মানুষ কী বুঝবে। অন্যদিকে শমীক ভট্টাচার্য, তিনি এই লড়াইয়ের মধ্যে খানিক স্যান্ডুইচ, মিডিয়া সামলাতেই দিন কেটে যায়। তৃণমূল ২০১৯-এ পেয়েছিল ৪৩.২৭ শতাংশ ভোট, ২০২৪-এ পেল ৪৫.৭৬ শতাংশ ভোট। আর উপনির্বাচনও জানান দিচ্ছে তৃণমূলের ভোট আরও বাড়ছে আর বিজেপির ভোট দ্রুত গতিতে কমছে। কেবল তাকিয়ে দেখুন এই আরজি কর আন্দোলনের দিনগুলোর দিকে, এরকম এক ইস্যু পেলে মমতা ব্যানার্জি কী করতেন, ভাবা যায়? সেই দলে শিক্ষানবিশী করার পরে বিজেপিতে এসে আমাদের কাঁথির খোকাবাবু কী করলেন? নিজেদের দলের ব্যানারে একটা নবান্ন অভিযান করার সাহসও নেই, কোথাকার কোন ছাত্রসমাজের নামে লোক হাসিয়ে দলকে ডোবালেন। এতবড় আন্দোলন পুরোটার কন্ট্রোল নিল বামেরা, বিজেপি সেই আন্দোলনের কোথাও সামান্য দাগও কাটতে পারেনি বরং মাঝেমধ্যেই ওই জুনিয়র ডাক্তারদের কাছে তাড়া খেয়ে পাবলিকের কাছে হাসির খোরাক হলেন। আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম যে বাংলাতে বিজেপি প্রায় ছ’ মাস হল সভাপতি পর্যন্ত ঠিক করে উঠতে পারছে না, তিন নেতা শুভেন্দু, দিলীপ আর সুকান্ত একসঙ্গে কাজ করা তো দূরস্থান, একে অন্যের মুখদর্শনও করেন না। দেড় বছর পরেই ভোট, বিজেপি কি আবার সেই তিন নম্বরে নেমে যাবে? শুনুন কী বলেছেন মানুষজন।
সমস্যাটা অবশ্য ঠিক এই তিন নেতার নয়, সমস্যাটা মাটির, এই মাটিতে বিজেপি বেমানান। এই মাটিতে এক ‘অশিক্ষিত বামুন’ সেই কবেই বলেছিলেন যত মত তত পথ, আর সেটা বলার আগে নিজে মুসলমান হয়ে বুঝেছিলেন যে পথ অনেক হলেও সেই সর্বশক্তিমান একজনই। এই মাটিতেই সেই কবে এক খ্রিস্টান পাদ্রি সাহেব নেচে নেচে গেয়েছিলেন, আমার খোদা যে হিন্দুর হরি সে, ওই দ্যাখ শ্যাম দাঁড়িয়ে আছে, গেয়েছিলেন ক্রিস্টে আর কৃষ্ণে কোনও বিভেদ নেই। এই মাটিতে দাঁড়িয়ে ত্রিশূলধারী ভণ্ডদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন নেতাজি, এই মাটিতেই শাশ্বত মানবতার গান গেয়েছেন আমাদের ঠাকুর, রবি ঠাকুর। এখানে আওরঙ্গজেবের অওলাদ বলে গাল পাড়লে চারদিক থেকেই তার প্রতিবাদ হবে, এখানে ৭০ শতাংশ ভোটকে এক জায়গাতে আনতে চাইলে তা হবে না। এই মাটিতে বিজেপির দর্শন বেখাপ্পা, বেমানান। এখানে বিজেপির নেতারা ওই নাথবতী অনাথবৎ হয়েই কাটিয়ে দেবেন চিরটাকাল।