বাংলায় ভোট পরবর্তী ‘সন্ত্রাস’ দেখতে এসেছিলেন বিজেপির দিল্লি থেকে পাঠানো এক দল। ছিলেন করেন ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা এবার লোকসভায় জেতা বিপ্লব দেব, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদরা। গিয়েছিলেন কোচবিহারে, ফিরে আসার পরেই জানা গেল বিজেপির রাজ্যসভা সদস্য অনন্ত মহারাজ বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে হলুদ উত্তরীয় আর গুয়াপান দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। না, কোনওরকম হিংসা ইত্যাদির অভিযোগ তিনি করেননি, ইন ফ্যাক্ট কোচবিহার থেকে হিংসার তেমন অভিযোগ আসেওনি, এসেছে নিশীথ প্রামাণিকের ইভিএম লুঠের অভিযোগ। তো উত্তর থেকে দক্ষিণে নেমে এসেছেন দিল্লির দলবল, এবারে সঙ্গে অগ্নিমিত্রা পাল, কিন্তু হিংসার অভিযোগ দেখার বদলে দলের কোন্দল দেখল বিজেপির কেন্দ্রীয় দল। তাও আবার সেই কোন্দলের ঘটনা ঘটল অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারে। মঙ্গলবার সকালে আমতলায় বিপ্লব দেবদের গাড়ি থামিয়ে জেলা সভাপতি অভিজিৎ সর্দারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন স্থানীয় বিজেপি কর্মীরা। গাড়িতে বসেই স্থানীয় বিজেপি কর্মীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন দিল্লির নেতারা। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। বিজেপির কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল আমতলা ছেড়ে গোসাবার দিকে রওনা হওয়ার পরেই স্থানীয় পার্টি অফিসে তালা লাগিয়ে দেন বিক্ষুব্ধেরা। জেলা সভাপতির অনুগামীদের সঙ্গে তাঁদের হাতাহাতিও হয় বলে খবর। কেউ হতাহত হয়নি এই যা রক্ষে। মজাই পেয়েছে শাসকদল, তারা, বিজেপির গোষ্ঠীকোন্দলে যা ঘটছে, তা তৃণমূলের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সন্ত্রাস হয়নি এক্কেবারে তা নয়, কিন্তু সন্ত্রাস দেখতে এসে যা দেখছেন দিল্লির প্রতিনিধিরা তা নিপাট দলীয় কোন্দল। সেটাই বিষয় আজকে। বিজেপির কোন্দল চলছে চলবে।
ভোট হয়েছে, কোথাও কোথাও কোন্দল ছিল বইকী, সে তো কেবল বিজেপিতে নয়, তৃণমূলে এমনকী সিপিএম-এ, ২৪ পরগনাতে ভোট করাতে গিয়ে বার বার থমকাতে হয়েছে এমনকী সিপিএমকেও, তৃণমূলে তো ছিলই, মারধরও হয়েছে, কিন্তু বিজেপিতে তা ছিল লাগাতার এবং দৃশ্যমান। দিলুবাবুর ছেলেপুলেরা মেদিনীপুর থেকে ধাঁ, অগ্নিমিত্রার অনুগামীরা আসানসোলে নেই এরকম কত কিছু। কিন্তু ফলাফল হাতে পেতেই বিজেপির মধ্যের কোন্দল মগডালে উঠেছে। তিন চারটে শিবির এবং ৬-৭ জন মাথা প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: Aajke | কেন ঘটেছিল ওই দুর্ঘটনা? কারা দায়ী?
এদিকে শুভেন্দু বলেই দিয়েছেন সংগঠন আমার দেখার বিষয় নয়, ওটার জন্য আলাদা লোক আছে আর দিলীপ ঘোষ বলেছেন আমি নয়, পিছনে আরও লোক আছে যারা বলবে। এগুলো দেখছেন তাঁদের অনুগামীরা এবং সেই মতো লড়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে চারটে উপনির্বাচন আর তার প্রার্থী ঘোষণা হয়েছে, হওয়ার পরেই নতুন ক্যাচাল, তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই রায়গঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের উপ-নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন মানসকুমার ঘোষ। সোমবার দলের তরফে মানসের নাম ঘোষণা হওয়ার পরেই পুরনো কাউকে কেন প্রার্থী করা হল না, সে প্রশ্নে দলের উত্তর দিনাজপুর জেলা কার্যালয়ে শোরগোল পড়ে যায়। বেশ কিছু নেতা দলীয় পদ থেকে ইস্তফা দিতে তৈরি হয়েছেন বলেও সমাজমাধ্যমে ছড়ায়। তাতেও শুরু হয় হইচই। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সমস্যা দেখিয়ে দলের জেলা সভাপতি পদ থেকে অব্যাহতি চেয়ে দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের কাছে পাঠানো ইস্তফাপত্র সামাজিক মাধ্যমে ‘পোস্ট’ করেন বাসুদেব সরকার। বিজেপির যুব মোর্চার জেলা সহ-সভাপতি শুভম স্যান্যালও একই কারণে পদ থেকে ইস্তফা দিতে চেয়ে সংগঠনের নেতৃত্বের কাছে পাঠানো চিঠি সামাজিক মাধ্যমে ‘পোস্ট’ করেন। বাসুদেব দিনভর ফোন ধরেননি। হোয়্যাটসঅ্যাপেও তাঁর প্রতিক্রিয়া মেলেনি। শুভমের দাবি, তিনি ব্যক্তিগত কারণে পদ থেকে ইস্তফা দিতে চেয়েছেন। বিজেপির রায়গঞ্জ শহর মণ্ডলের সহ-সভাপতি অমিত দাস বলেন, “দলের পুরনো নেতা প্রার্থী না হওয়ায় ক্ষোভ স্বাভাবিক।” বিজেপির জেলা সাধারণ সম্পাদক কমল দেবনাথ বলেন, “দলের ঘোষিত প্রার্থীকে দলের নেতা-কর্মীদের মানতেই হবে। তবে কারও সাময়িক ক্ষোভ হতেই পারে।” এরকম এক ক্যাচাল মুহূর্তে জেলা তৃণমূল সভাপতি কানাইয়ালাল আগরওয়াল দাবি করেন, “রায়গঞ্জে বিজেপির প্রার্থীকে পুরনো নেতা ও কর্মীরা মানতে পারছেন না। তাঁরা অপমানিত ও বঞ্চিত বোধ করে ইস্তফা দিতে শুরু করেছেন।” ২০০৮-২০১১ সাল পর্যন্ত মানস রায়গঞ্জ ব্লক যুব কংগ্রেস ও ২০১১-২০১৭ জেলা যুব কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৩ সালে মানস রায়গঞ্জ পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ হন কংগ্রেসের টিকিটে জিতে। ২০১৭ সালে তিনি তৃণমূলে যোগ দিয়ে দলের জেলা সহ-সভাপতির দায়িত্ব পান। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিনি পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূলের সহ-সভাপতি ছিলেন। মাঝে ২০১৯-২০২২ সাল পর্যন্ত মানস রায়গঞ্জ ব্লক তৃণমূল সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তার পরে তৃণমূলের জেলা সাধারণ সম্পাদকের পদে থাকাকালীন পঞ্চায়েত ভোটের মুখে, বছরখানেক আগে, মানস বিজেপিতে যোগ দেন। এবারের লোকসভা ভোটে তিনি রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী কার্তিকচন্দ্র পালের ‘ইলেকশন এজেন্ট’ ছিলেন। ব্যস, তিনিই প্রার্থী এবং গোলযোগ। ওদিকে রানাঘাটেও বিক্ষোভ চলছে, বাগদাতে অবশ্য শান্তনু ঠাকুরের স্ত্রীকে টিকিট না দেওয়ায় আপাতত ক্ষোভের খবর নেই কিন্তু এন্টালিতে কল্যাণ চৌবেকে দেওয়া নিয়ে দলের মধ্যেই কিছু নেতা বলেছেন দাঁড় করিয়ে হারাব, এনারা সুকান্ত অনুগামী। সবমিলিয়ে জমজমাট কোন্দলের চেহারা। আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম ভোটের ফলাফল আর চার উপনির্বাচনে প্রার্থী নিয়ে বিজেপির মধ্যের ঝগড়া এখন প্রকাশ্যে, দলের দফতরে তালা দিয়ে দিচ্ছে বিক্ষুব্ধরা, এ রাজ্যে বিজেপি কি ক্রমশ জমি হারাচ্ছে? শুনুন কী বলেছেন মানুষজন।
অবশ্য এমন ছবি কেবল বাংলাতেই একথা ভাবলে ভুল ভাবা হবে। উত্তরপ্রদেশে তো অনেক বিজেপি নেতা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, কেউ কেউ নিজের সিকিউরিটি বাড়াচ্ছেন। মহারাষ্ট্রে দলের বিধায়ক নেতারা আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে যাতে রাজ্য নেতারা এনসিপি অজিত পওয়ার গোষ্ঠীর সঙ্গে জোট না বাঁধে তার জন্য লিখিত আবেদন করেছেন দলের সভাপতির কাছে। আসলে জয়ের ফসলের ভাগীদার অনেকেই হতে চায়, হারের দায় কেউ নিতে চায় না। বাংলাতে এই তো পেয়ে গেছি রাজ্যটা, তারপর এই ফলাফল, কাজেই শুরু হয়েছে ঘরশত্রু বিভীষণদের খোঁজা, আর উইচ হান্টিং চিরটাকাল এরকমই হয়ে থাকে।