আরজি কর ধর্ষণ আর খুনে অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়। হ্যাঁ রায়, রাই নয়, অন্তত তার আধার কার্ড, সরকারি আইডেন্টিটি কার্ড ইত্যাদিতে সে সঞ্জয় রাই নয় সঞ্জয় রায়। তো সেই অভিযুক্তকে শিয়ালদহ কোর্টে আনা হলে সে প্রিজন ভ্যান থেকে চেঁচিয়ে বলে আমি নির্দোষ, আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে। সে কিছুই করেনি ইত্যাদি ইত্যাদি। এরকম কথা বলাটার মধ্যে নতুনত্ব কিছুই নেই, খুব ব্যতিক্রমী কিছু বাদ দিলে প্রত্যেক অভিযুক্তই নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করে। তাহলে তা নিয়ে আলোচনা কেন? কারণ সিপিএম দল তাদের অফিসিয়াল সোশ্যাল মিডিয়াতে সেই আমি নির্দোষ, আমাকে ফাঁসানো হয়েছে এই কথাগুলোকে তুলে ধরেছে, এবং বিখ্যাত আইনজীবী এবং আপাতত এই বাংলায় সিপিএম-এর সবেধন নীলমণি রাজ্যসভা সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্য বলেছেন, এটা গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। ক’দিন আগে এই বাংলার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, আমার আপনার প্রতিদিনের প্রতিটা কর্মকাণ্ডের উপর কঠোর নজরদারি রাখত যে দল, নিরবচ্ছিন্নভাবে ৩৪ বছরের সরকার চালানোর রেকর্ড যাদের আছে সেই সিপিএম যখন তাদের সমাজমাধ্যমে এই বক্তব্য তুলে ধরে, তখন তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ তো থেকেই যায়। প্রশ্ন তো ওঠেই যে এরপরে কি জাস্টিস ফর সঞ্জয় রায় বলে এক নতুন আন্দোলন শুরু হবে? খামোখাই এক ধর্ষণ খুনে অভিযুক্তের বয়ান আপলোড করে সিপিএম দল কোন বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে? পার্থ চট্টোপাধ্যায় থেকে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও তো বারে বারে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছেন, কই সেসব ভিডিও তো সিপিএম-এর সমাজমাধ্যমে আপলোড করা হয়নি? তার মানে নিশ্চিতভাবেই সঞ্জয় রায়ের এই দাবির সঙ্গে কোথাও না কোথাও এই বিপ্লবী দলটি একমত, তাঁরা কি এই নিয়ে রাস্তায় নামতে চান? আন্দোলন গড়ে তুলতে চান? সে আন্দোলনের বর্শামুখে থাকবেন কি মহম্মদ সেলিম? এসব প্রশ্ন তো উঠবেই, উঠছেও। কাজেই সেটাই বিষয় আজকে, জাস্টিস ফর ধর্ষক খুনি সঞ্জয় রায়: সিপিএম।
আমরা যদি আজ থেকে ৯০ দিন আগের, ৯ অগাস্টের ঘটনার কয়েকটা তথ্য আবার সামনে আনি তাহলে বোঝা যাবে এই সঞ্জয় রায় কীভাবে এই দাবি তোলার সাহস পেলেন, কাদের অনুপ্রেরণাতে এই ধর্ষণ খুনে অভিযুক্ত ছেলেটি আজ নিজেকে কেবল নির্দোষই দাবি করছেন না, তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে বলেই দাবি করছেন, এক ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন, যেখানে নাকি কিছু অতি ক্ষমতাবান মানুষজনের অন্যায়কে ঢাকতেই তাঁকে নাকি বলির পাঁঠা করা হয়েছে, এমনটা দাবি করছেন। অথচ এই ছেলেটিই ধরা পড়ার পরেই, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বলেছিল, হ্যাঁ আমি এই কাজ করেছি, আমাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ সমস্ত তথ্যপ্রমাণ হাতে রেখেই জানিয়েছিল যে এই ছেলেটিই সেদিনের ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষ দোষী। আমরা আমাদের অনুষ্ঠানেই এই ছেলেটি তার আগের দিন থেকে ধরা পড়া পর্যন্ত কী কী করেছিল, কোথায় কোথায় গিয়েছিল, কাকে কাকে ফোন করেছিল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আপনাদের জানিয়েছিলাম।
আরও পড়ুন: Aajke | উপনির্বাচন, বাংলায় ৫-১? না, ৬-০ ও হতে পারে
কিন্তু ঠিক সেই সময়েই এই ঘটনাকে এক রাজনৈতিক পালাবদলের চেহারা দেওয়ার জন্য মাঠে নামে সিপিএম এবং কিছু জনবিচ্ছিন্ন অতিবাম মানুষজন, প্রাথমিক আন্দোলন এবং এই হুজুগে ছিল বিজেপিও, যারা কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে যায় এই আন্দোলন থেকে তাদের কোনও ফায়দা হবে না। কিন্তু ওই সিপিএম আর কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষজন একটা প্রচার শুরু করে যাতে বলা হতে থাকে যে আসলে এই সঞ্জয় রায় এক বোড়ে, আসলে এই মেয়েটি নাকি আরও বড় এক অপরাধচক্রের বিভিন্ন অপরাধ অন্যায় দুর্নীতি জেনে ফেলেছিল তাই সেই চক্রের লোকজনেরা মেয়েটিকে ধর্ষণ করায়, খুন করায়। এটা ঘটনা যে আরজি কর কর্তৃপক্ষের বহু গাফিলতির জন্যই সঞ্জয় রায় এই ঘটনা ঘটাতে পেরেছে, হাসপাতালে নিরাপত্তার অভাব ছিল, ডাক্তারদের রেস্টরুমের অভাব ছিল আর সেসব গাফিলতি এই ঘটনার অপ্রত্যক্ষ্য কারণ তো বটেই। কিন্তু এই ঘটনার সরাসরি অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়, অন্য কেউ না, অন্তত পুলিশের সাক্ষ্যপ্রমাণ তো তাই বলছে। আরজি কর কর্তৃপক্ষের গাফিলতি দুর্নীতির তদন্ত হোক, বিচার হোক, কিন্তু সে সবকিছুকেই এই ঘটনার কারণ বলে দাবি করলে এই অভিযুক্ত একটা সময়ে সেই যুক্তিগুলোকেই আঁকড়ে ধরবে, এগুলো আমরা সেসময়েই বলেছিলাম। আজ ঠিক সেটাই হচ্ছে, সেদিন এই দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষজন যা যা বলেছিলেন, সিপিএম বা তাদের পরিচালিত সংগঠন থেকে যা যা বলা হয়েছিল, আজ সেগুলোই সঞ্জয় রায় বা তাঁর পক্ষের আইনজীবীরা আদালতে দাঁড়িয়ে বলছেন। নৈহাটিতে ভোট প্রচারে গিয়ে কমরেড সেলিম বললেন যে সিবিআই আবার বিচার করে নাকি? আমরা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি দিয়ে বিচারবিভাগীয় তদন্ত চাইছি। তাই নাকি? তাহলে কালো শামলা পরে আপনাদের সবেধন নীলমণি সাংসদ কলকাতা হাইকোর্টে গিয়ে সিবিআই তদন্তের দাবি কেন জানালেন? আপনারাই বা ফলাও করে সিবিআই নিয়ে নিল তদন্তের ভার বলে গণশক্তিতে হেডলাইন করলেন কেন? সেইদিনই আমরা বলেছিলাম, সিবিআই-এর হাতে থাকা আরও দশটা মামলার মতোই এই মামলা চলতেই থাকবে, চলছেও, যদিও এখনও পর্যন্ত এই ঘটনাতে সরাসরি জড়িত আছেন এমন একজনের কথার উল্লেখ পর্যন্ত সিবিআইও করেনি। অন্যদিকে সেদিন রাস্তায় নেমে সিপিএম যা যা বলেছিল সেটাকেই হাতিয়ার করে সঞ্জয় রায় নিজেকে বাঁচাতে নেমে পড়েছেন, এবং কী আশ্চর্য, সিপিএম সঞ্জয় রায়ের সেই দাবি তাদের সমাজমাধ্যমে আপলোড করছে। আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে ধর্ষণ খুনে অভিযুক্ত সঞ্জয় রায় দাবি করেছে সে নির্দোষ, সিপিএম তার সেই বক্তব্যকে তাদের সোশ্যাল মিডিয়াতে তুলে ধরেছে, সিপিএম কি পরোক্ষভাবে ওই ধর্ষক খুনির পক্ষেই দাঁড়াচ্ছে না? আপনারা কি মনে করেন যে ওই সঞ্জয় রায় নির্দোষ? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
কেবলমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য মিথ্যাচার, মিথ্যে প্রচার, অনর্গল মিথ্যে বলে যাওয়ার যে নিদর্শন সিপিএম রেখে চলেছে তা সত্যিই বাংলার বাম রাজনীতিতে খুব নতুন কিছু নয়। তবুও এক তরুণী মেধাবী ডাক্তারের ধর্ষণ আর মৃত্যু নিয়ে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতি এই সময়ে বাম রাজনীতির দেউলিয়াপনাকেই তুলে ধরে। এবং এই অর্বাচীন রাজনীতির জন্য অভয়ার বিচার প্রক্রিয়া আরও বহুদিন ধরে চলবে, অন্যদিকে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিচারও হবে না। আসলে এই ধর্ষণ আর খুন ছিল একটা ঘটনা, আরজি করের দুর্নীতি ছিল আর একটা বিষয়, কোথাও অপ্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকলেও দুটোকে একসঙ্গে মিলিয়ে কেবল ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করার চেষ্টা অভয়ার বিচার প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে। আর ঠিক তাই সেদিন এই সিপিএম বা জনবিচ্ছিন্ন কিছু অতিবাম মানুষজন যা যা বলেছিলেন, আজ ওই ধর্ষক খুনি সঞ্জয় রায়ের গলাতে ঠিক সেটাই শোনা যাচ্ছে।