আমরা তখন রোজ ভাবছিলাম বাংলার সবচেয়ে বড় উৎসব আসছে, অন্তত সেই সময়টার জন্য আন্দোলন স্থগিত রেখে মানুষের উৎসবে শামিল হয়েই ডাক্তারবাবুরা, বা আরজি কর আন্দোলনের সেলিব্রিটি সমর্থকরা সেই উৎসবকে কাজে লাগিয়েই মানুষের মধ্যে থাকবেন। আসলে আমরা তাঁদের কাছ থেকে একটু বোধবুদ্ধি আশা করেছিলাম, ভেবেছিলাম ওনারা তো সমাজের এগিয়ে থাকা লোকজন, ডাক্তার, মোক্তার, শিল্পী, সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী মানুষজন, ওনাদের সংবেদনশীলতাতে আমাদের একটু বেশি আস্থা ছিল, ওনাদের মগজের গ্রে ম্যাটার নিয়েও আমাদের সন্দেহ ছিল না। কিন্তু ওই যে শিকড়টা হল আমাদের দেশের সেই প্রাচীন কমিউনিস্টদের যাঁরা দেশের মাটিই চিনে উঠতে পারেননি। মার্কস সাহেব যেটাকে ক্লাস বলেছেন সেটাই যে এদেশে কাস্ট হয়ে বসে আছে, ওই চামার দুসাধ ডোম মেথর মুচিরাই যে আদতে সেই সর্বহারা শ্রেণির মানুষজন তাঁরা বুঝে উঠতে পারেননি, তাঁরা লোকায়ত বা সাধারণ হিন্দু পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মিথকে বুঝে উঠতে পারেননি, অবহেলা করেছেন, আজ কেবল সেই মাটির সঙ্গে সংযোগ না থাকার জন্য তাঁরা ভোলাটাইল সাবস্ট্যান্স, উদ্বায়ী পদার্থ। তো সেই কমিউনিস্টদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ এই আন্দোলনকারীরা সজোরে প্রত্যাখ্যান করেছিল বাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসবকে, তাঁরা দুর্গাপুজোর কার্নিভালের বদলে দ্রোহের কার্নিভাল খুলে বসেছিলেন, এবং এই আন্দোলনের আবহে এবারের শারদোৎসব ম্যাড়ম্যাড়ে, কিছুটা হলেও, হয়েছিল বইকি। হাতিবাগান থেকে গড়িয়াহাটের হকারদের বিক্রিবাটা তেমন হয়নি, যা হলে তাদের ঘরের সন্তানদের একটা জামা বা এক প্যাকেট বিরিয়ানি জুটত। বীরভূম, হুগলি, বর্ধমানের ঢাকিদের এবারে তেমন চাহিদা ছিল না, তাতে বাকিদের কী হয়েছে জানি না কিন্তু সেই তাদের ঘরে আনন্দ মাটি হয়েছে। সেই ডাক্তারবাবু, ডাঃ কিঞ্জল নন্দকে দেখা গেল রাজ্য সরকার আয়োজিত ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে, দেখা গেল বাদশা মৈত্রকে, দেখা গেল সুদিপ্তা চক্রবর্তীকে। মানে? ফিল্ম উৎসব চলবে, তাতে তাঁরা যাবেন, গলায় মালা পরবেন কিন্তু বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব বয়কট করবেন, এই তো? সেটাই বিষয় আজকে শারদীয়া উৎসব বয়কট, ফিল্ম উৎসবে সব্বাই আছেন।
কোন যুক্তিতে তাঁরা এসে হাজির হলেন ফিল্ম উৎসবে? এখানেও সেই সরকারের মাথায় কি মমতা ব্যানার্জি নেই, তিনিই কি এখনও পুলিশ দফতরের মন্ত্রী নন? রাজ্য জুড়ে দুর্নীতি বন্ধ? নাকি আরজি কর ধর্ষিতা তিলোত্তমার যে বিচার আপনারা চেয়েছিলেন তা পেয়ে গেছেন? কোনটা? একটা লজিক এসেছে বটে সেটাকে অবশ্য লজিক না বলে প্রচুর মুলো খাওয়ার পরের প্রতিক্রিয়াও বলাই যায়, বলেছেন আমি তো অভিনেতা, আমার দ্বৈত সত্তা আছে। ডাক্তার হিসেবে আন্দোলন করেছি, অভিনেতা হিসেবে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এসেছি।
আরও পড়ুন: Aajke | আবার, এবারে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নিয়ে সিপিএমের ভুল স্বীকার
তো মিঃ জেকিল অ্যান্ড হাইড, আপনাকে কেউ তো ডাক্তার হিসেবে শারদীয়া পুজোর ফেস্টিভ্যালে ডাকে না বা এমনও নয় যে ওই শারদীয়া উৎসব এক ডাক্তারদের উৎসব? উত্তর না থাকলে চুপ করে থাকতে হয় এটা প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময়ে শেখানো হয়নি? আর কত অনৈতিক কাজ করবেন আপনারা? এখনও পর্যন্ত নারী নির্যাতনে অভিযুক্ত আপনার শ্বশুরমশাই সম্পর্কে আপনার স্ট্যান্ড জানাতে পারেননি, অন্য কাউকে দিয়ে যা লিখিয়েছেন তা ওই একই মুলো প্রতিক্রিয়া। একবারও বলেছেন যে কর্মবিরতির ডাক দিয়ে অনৈতিকভাবে কেন ৫৬৩ জন ডাক্তার প্রাইভেট হাসপাতালে কাজ করছিলেন? ধক আছে তা নিয়ে কিছু বলার? আপনার কমরেড আসফাকুল্লা নাইয়া এমএস হওয়ার দু’ বছর আগে থেকে চরম অনৈতিকভাবে নিজের নামের পাশে সেই ডিগ্রি ঝুলিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছিলেন, তা নিয়ে একটা কথা? বলবেন না, বলতে পারবেন না। আর সেই জন্যই মানুষ জোয়ারের প্লাবনের মতো আপনাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, সেই প্লাবন আজ কোথায়? ভাটার টানে রাস্তায় হাজার লোকও হচ্ছে না। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, শারদীয়া উৎসবে ছিলেন না, উৎসব বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন ডাঃ কিঞ্জল নন্দ বা টলিউডের সেলিব্রেটি অভিনেতা পরিচালকেরা, সেই তাঁরাই আজ একই রাজ্য সরকার আয়োজিত ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এসে গলায় মালা পরছেন। কী বলবেন আপনারা? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
ছোট বড় আন্দোলন প্রতিবাদ রুখে দাঁড়ানোর আগে গান্ধী পড়ুন। গান্ধী পড়ুন কারণ সেই রুখে দাঁড়ানোর জোর, সেই প্রতিবাদের রোখ, সেই আন্দোলনের ঢেউ কোথা থেকে আসে, কী করে তৈরি হয় তা জানতে পারবেন, বুঝতে পারবেন। এক অসম্ভব নৈতিক অবস্থান ছাড়া কোনও প্রতিবাদ শেষপর্যন্ত প্রতিবাদ থাকে না, কোনও আন্দোলনই দানা বাঁধে না। চালাকি আর প্রতিবাদ, আন্দোলন একসঙ্গে হয় না, মানুষ ধরে ফেলে। আর ক’টা দিন অপেক্ষা করুন ডাঃ নন্দ, মানুষ রাস্তায় দেখলেও ছিঃ ছিঃ করবে। হ্যাঁ, সেই মানুষ যাঁরা আপনার মধ্যে একদিন বিপ্লব দেখতে পেয়েছিল।