শোনা যায়, বহুকাল আগে ফ্রান্সে তখনও রাজা রানিদের শাসন, ক্ষুধার্ত মানুষেরা জড়ো হয়েছিল রুটির দাবিতে। রানি মারী আতোয়ানেঁ শুনে বলেছিলেন, লেট দেম ইট কেক, রুটি পাচ্ছে না? তো কেক খাক। তারপর জানা গেল উনি ঠিক কেক বলেননি, বলবেনই বা কী করে, কেক শব্দটাই তো নেই ফরাসি ভাষায়। উনি বলেছিলেন ব্রিয়োচে, মাখন ডিম দিয়ে তৈরি রুটি, তা সেও তো সাধারণ মানুষের খাওয়ার সাধ্য ছিল না, তারা তো পাতি রুটির দাবিতে জড়ো হয়েছিল। সারা পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম ইনসেনসিটিভ শাসক আমরা বার বার দেখেছি। রোম যখন পুড়ে ছাই হচ্ছিল, তখন সম্রাট নিরো বেহালা বাজাচ্ছিলেন। আমরা জানি আমাদের দেশের মহম্মদ বিন তুঘলকের কথা, রোজ ফতোয়া জারি হত, উনি রাজধানী নিয়ে গেলেন অন্য জায়গাতে, সব মানুষকে ঠাঁইনাড়া হতে হয়েছিল, সম্রাটের সঙ্গে যেতে হয়েছিল। আবার যখন সেখানে ভালো লাগেনি, আবার দিল্লিতেই ফিরেছেন, আবার সব্বাইকেই ফিরতে হয়েছে। আমরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দেখেছি মানুষের খাবার ধান গম চাষ না করতে দিয়ে নীল চাষে বাধ্য করতে। স্বাধীন ভারতেই কি কম? প্রতিটা রাজ্যে এক রাজ্যপাল নিয়োগ করা হল, বিপুল খরচ তাদের জন্য, পদ্মজা নাইডু বলেছিলেন হোয়াইট এলিফ্যান্ট, সফেদ হাতি। আমরা জানি আমাদের পার্লামেন্টে সাবসিডাইজড বিরিয়ানির পয়সায় বাইরে ডাল ভাতও জুটত না। আমরা জানি ইন্দিরা গান্ধী মারা যাওয়ার পরে শিখ গণহত্যার সময় রাজীব গান্ধী বলেছিলেন বড় গাছ পড়লে জমি কাঁপে। আমরা জানি গুজরাত গণহত্যার সময়েই যখন মোদিজিকে প্রশ্ন করা হয়, এত হাজার হাজার সংখ্যালঘু মানুষজনের মৃত্যুতে আপনার কষ্ট হচ্ছে না? উনি বলেছিলেন সে তো একটা কুকুরও গাড়ির চাকার তলায় চাপা পড়ে মরলেও কষ্ট হয়। আমরা এই অনুভূতিহীন মানুষজনদের দেখেছি বারবার, এবার দেখলাম সংসদেই, সরকারপক্ষে বসে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবকে, সেটাই বিষয় আজকে।
গত দু’ সপ্তাহের মধ্যে গোটা সাতেক রেল দুর্ঘটনা হয়েছে, মঙ্গলবারের দুর্ঘটনাতে মারা গেছেন দুজন। ২০১৯ থেকে আজ পর্যন্ত ৩৫০ মানুষ মারা গেছেন। প্রতিটা ক্ষেত্রেই রেলের পরিকাঠামো দায়ী, তা পরিষ্কার, কোথাও সিগন্যালিং সিস্টেমের গন্ডগোল, কোথাও রক্ষাকবচ কাজ করেনি, কোথাও রক্ষাকবচ ছিলই না, কোথাও ট্র্যাক মেনটেনেন্স হয়নি, কোথাও কোচের গন্ডগোল ছিল। এদিকে রেলে এক লক্ষের মতো শূন্যপদ পড়ে রয়েছে, কর্মচারীদের উপর কাজের বোঝা, কাজের চাপ বাড়ছে, ছুটি নেই, বিশ্রাম নেই কাজেই হিউম্যান এরর বাড়ছে।
আরও পড়ুন: Aajke | অধীরবাবুর মনে বড় দুঃখ
আমাদের দেশের মহান প্রধানমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় চলা রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব গতকাল সংসদে ভাষণ দিতে উঠে তার আগেরদিন ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার উল্লেখও করেননি, তিনি কথা বলছিলেন বুলেট ট্রেন নিয়ে। সেই কবে করোনাকালে আমাদের দেশের সিনিয়র সিটিজেনদের টিকিটের ছাড় বাতিল করেছিল মোদি সরকার, সে করোনাকাল কেটে গেছে, কিন্তু ছাড় কেন ফিরল না, আমাদের রাজ্যের দুজন সাংসদ দেব এবং জুন মালিয়া এই প্রশ্ন তুলেছেন। অশ্বিনী বৈষ্ণব তার কোনও উত্তর দেননি, আসলে গায়ের চামড়া গন্ডারের চেয়েও মোটা হলে এমনটাই স্বাভাবিক, তিনি বুলেট ট্রেনের কথা বলছেন। সে ট্রেন কোথা থেকে কোথায় যাবে? মুম্বই থেকে আমেদাবাদ। তার জন্য যত টাকা খরচ হবে তা দিয়ে আমাদের ইস্ট ওয়েস্ট ফ্রেট করিডোর তৈরি করে ফেলা যায়, রেলের আয় বাড়ানো যায়, ওই পয়সাতে সারা দেশে সুরক্ষা কবচ চালু করা যায়, দুর্ঘটনা কমবে। কিন্তু ওঁদের তো লক্ষ্য গুজরাট, দুই শিল্পপতি আর বুলেট ট্রেন, বাকি দেশ যাক চুলোর দোরে, মানুষ মরুক তাতে ওঁদের কিছুই যাবে আসবে না। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, যে টাকা দিয়ে সারা দেশের রেল লাইনে সুরক্ষা কবচ চালু করা যায়, যার ফলে দুর্ঘটনা কমবে তা না করে সেই টাকার ১০ গুণ খরচ করে আমেদাবাদ–মুম্বই ট্রেন চালানোটাকে আপনারা সমর্থন করেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
সেই কবে শুনেছিলাম হম দো হমারে দো। লাগু হয়েছে কি সারা দেশে? মা-বাবার দুই সন্তান? সম্ভবত সব জায়গাতে নয়। কিন্তু দেশের রাষ্ট্রকাঠামোতে তা এক্কেবারে খাপে খাপ পঞ্চুর বাপ। মাথায় মোদি আর অমিত শাহ, আর তাঁদের দুই ইয়ার জিগড়ি দোস্ত আদানি আম্বানি এক গুজরাটি কার্টেল তৈরি হয়ে গেছে। আর সেই লক্ষ্যেই চলেছে মোদি-শাহ সরকার, তাই দুর্ঘটনার পরের দিন সংসদে বসেই দেশের রেলমন্ত্রী সে দুর্ঘটনা নিয়ে একটা কথাও না বলে মশগুল থাকেন আমেদাবাদ-মুম্বই বুলেট ট্রেন নিয়ে। গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট হচ্ছে, লোক মরছে, তাতে কি, আমরা দ্রুতগতি বুলেট ট্রেন ক’দিনের মধ্যেই চালু করছি। মনে থাকবে দেশের, মনে থাকবে মানুষের, এই চূড়ান্ত অসংবেদনশীলতা মানুষ ভুলবে না, মানুষ ভোলেনি রানি আতোয়ানেঁর কথা, রুটি নেই? কেক খাও।