দেদার শব্দবাজি ফেটেছে, এটাই হেডলাইন কলকাতা থেকে প্রকাশিত, প্রায় সবকটা খবরের কাগজের প্রথম পাতায়। কোথায় ফেটেছে? কলকাতা আর কাছাকাছি শহরতলিতে, তার বাইরে বিস্তৃত গ্রামবাংলায় ছবিটা কেমন ছিল? সব খবরই আদতে শহরকেন্দ্রিক, কলকাতায় বাজি ফাটলে বলা হয় দেদার বাজি ফাটল। কলকাতাতে আলো না গেলেই খবর হয় বিদ্যুতের হাল এখন অনেক ভালো, কলকাতায় ডেঙ্গি হলে বলা হয় রাজ্য কাঁপছে ডেঙ্গি জ্বরে। গ্রামবাংলাতে কালীপুজোর রাতে দেদার বাজি ফেটেছে? এমন খবর আছে নাকি? এবং খেয়াল করে দেখুন সেই বাজি কলকাতাতেও কোথায় ফেটেছে? তার বেশিরভাগটাই আবাসনে এবং তারও বেশিরভাগটাই বিত্তশালীদের আবাসনে। পিলে চমকানো সে সব বাজি আকাশে যাওয়ার আগেই প্রকাণ্ড আওয়াজ করছে, যত আওয়াজ তত আনন্দ। বিত্তবানরাই এক রাতে তিরিশ চল্লিশ পঞ্চাশ, ষাট হাজারের বাজি পোড়ায়, পোড়াতে পারে। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তদের আবাসনে এক ধরনের সচেতনতা বেড়েছে, সেখানে রংমশাল, চরকি, ফুলঝুরি, বড়জোর তুবড়ি। আর এক্কেবারে গরিবগুর্বো এলাকায় ফেটেছে চকলেট বোমা, তবে তার পরিমাণ বা গুণমান তেমন বিরাট কিছু নয়। ঠিক যে রকমভাবে পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে গোটা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি অবদান সবচেয়ে বিত্তবান দেশগুলোর, তাদের ইলেকট্রনিক গার্বেজ, তাদের পরমাণু তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ আজ পৃথিবীর সামনে সবথেকে বড় সমস্যা, ঠিক সেরকমভাবেই কলকাতা বা তার শহরতলিতে শব্দবাজির সমস্যার মূলে বিত্তবান মানুষজন। সে কথা আরেক দিন বলা যাবে। আমাদের আলোচনা এই বাজি আসছে কোথা থেকে। হিসেব বলছে ওই সব পিলে চমকানো বাজি যা বিরাট শব্দও করছে আবার আকাশে গিয়ে আলোর রোশনাই তৈরি করছে তার ৮০ শতাংশ কিন্তু আমাদের রাজ্যে তৈরিই হয় না। বেশিরভাগ দামি বাজি কিন্তু আসছে দক্ষিণ থেকে। সে বাজি আসছে বিভিন্ন পথে, বিভিন্ন ভাবে, সেটাই আজ আমাদের বিষয় আজকে, কালীপুজোয় মুড়ি মুড়কির মতো বাজি ফেটেছে, এল কোথা থেকে?
দেশের সবথেকে বড় বাজির কারখানাগুলো কিন্তু এ রাজ্যে নয়, উত্তর ভারতেও নয়, দক্ষিণ ভারতে। শিবকাশীই শুধু নয়, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক কেরল জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় এই বাজি তৈরি হয়। একসময় বিদেশেও রফতানি হত, এখন সে জায়গা ক্রমশ চীন ধরে নিয়েছে। আমাদের দেশের দক্ষিণেও বাজি কারখানাগুলো ধুঁকছে পুঁজি আর নতুন টেকনোলজির অভাবে। আবার সেই দক্ষিণের তুলনায় আমাদের রাজ্যের বাজি কারখানা অত্যন্ত নিম্ন মানের। কিছু কারিগর যাঁরা দক্ষিণে কাজ করেছেন আর কিছু দক্ষিণের কারিগরি সাহায্য নিয়ে বেড়ে ওঠা। এর উপরে আছে লাইসেন্স না থাকা ছোট ছোট ইউনিট যেগুলো গড়ে উঠেছে মধ্য ষাট সত্তরে। সেগুলোতে মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা হয়েছে, মানুষ মরেছে, যখন মরেছে তখন হই চই হয়েছে, কিছুদিন পরে সব ভুলে গেছে সব্বাই। অথচ আমাদের রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠতেই পারে ছোট ছোট বাজি কারখানা, নতুন নতুন রঙিন বাজি, নতুন আইডিয়া নিয়ে তৈরি বাজি হতেই পারে, হচ্ছে না কেবল পরিকল্পনার অভাবে।
আরও পড়ুন: Aajke | তোতাপাখি বনাম দলের সংস্কৃতি, শমীক বনাম অনুপম হাজরা
অন্য আরও কয়েকটা বিষয়ের মতো সরকার যদি এই দিকে সামান্য নজর দেয় তাহলে নতুন রোজগারের দরজা খুলে যাবে। তা না হয়ে যেটা হচ্ছে তা হল দক্ষিণের বাজি চোরাপথে ঢুকছে, তার গুণমান দেখার কেউ থাকছে না। বিরাট পয়সায় সেসব বাজি বিকোচ্ছে, কিনছেন অভিজাত আবাসনের পয়সাওলা মানুষজন, তাঁদের বেশিরভাগের কাছেই এটা দীপাবলি নয় দেওয়ালি, কাজেই তাস, জুয়া, আর বিকট শব্দের বাজি ফাটছে কলকাতা আর শহরতলিতে। পরিবেশ দূষণ হচ্ছে আবার সরকার এই বাজি বিক্রি থেকে যে পয়সা পাওয়ার কথা তাও পাচ্ছে না। আর আমাদের রাজ্যের বাজি কারখানায় তৈরি হচ্ছে চকলেট বোমা আর তুবড়ি, কিছুটা আইনি পথে কিছুটা বেআইনি পথে বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু যে পদ্ধতিতে তৈরি হচ্ছে তা বিপজ্জনক। বছরে দু’ তিনটে বড় দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে, আদতে এই বাজি শিল্পের জন্য এক ঠিকঠাক পরিকল্পনা না তৈরি হলে এই দুর্ঘটনা বন্ধ হওয়া সম্ভব নয়। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম দেদার শব্দবাজি ফাটল কলকাতা আর শহরতলি জুড়ে, সেসব বাজি কোথা থেকে এল? কারা বিক্রি করল? পুলিশ প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে তা বিক্রিই বা হল কী করে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
যে শব্দে অনাগত এক সন্তান, এখনও যে সূর্যের আলোই দেখলো না, সে বধির হয়ে যেতে পারে, এক অসুস্থ মানুষ মারা যেতে পারে, তেমন শব্দবাজি নিয়ে যারা উৎসবে মাতে তাদের রুচি আর পছন্দ নিয়ে প্রশ্ন তো আছেই কিন্তু এ জিনিস তো কেবল শুভবুদ্ধির উপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। এই জঘন্য কাজ আইন দিয়েই বন্ধ করতে হবে। আবার মাথায় রাখতে হবে অসংখ্য মানুষের রোজগার এই বাজি কারখানা, বাজি বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে, অতএব আমেরিকা বলিল, ফ্রান্স বলিল এটাই শব্দের সীমা, আর তাই মানুষের পেটের ভাত কেড়ে নেবে তাও তো হয় না। আসলে এ এক জটিল বিষয়, পেট আর পরিবেশের এক দ্বন্দ্ব তো চিরকালীন, সে দুটোকে একজায়গায় আনতে হলে ঠিকঠাক পরিকল্পনা দরকার। আমরা কিছু মানুষ জ্বালাও আলো, শব্দ দূরে থাক বলে ফেসবুকে পোস্ট করলেই সমস্যা মিটে যাবে না, আবার আইন করে দীপাবলির দিনে হাজার মানুষকে হাজতে ভরে দিলেও সমস্যা মেটার নয়। বাজি শিল্পের জন্য সঠিক পরিকল্পনা তৈরি হোক, বহু মানুষের রোজগার হোক, বিকল্প বাজি বাজারে আসুক, তারপর না হয় কিছু উনুঝুনু পয়সাওলা ফুর্তিবাজদের বুঝে নেওয়া যাবে।