অন্যান্য দিনের মতো খুব গভীর রাতে নয়, রাত সাড়ে দশটা নাগাদ জুনিয়র ডক্টরস আসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা সাংবাদিক বৈঠক করে জানালেন, ১) আন্দোলনকারীরা স্বাস্থ্য ভবনের ধর্না থেকে উঠে যাচ্ছেন। ২) ওঁরা কর্মবিরতি তুলে নিচ্ছেন কিন্তু সেটা আংশিকভাবে। ৩) ওঁরা প্রয়োজনে আবারও একইভাবে রাস্তায় নামতে পারেন। যা যা বলেছেন, তারমধ্যে ক্ষীর এইটুকু। তো সেই কবে থেকেই হরতাল, মিছিল, আন্দোলন ইত্যাদির শেষে যখন একটা মীমাংসাতে আসে মানুষ, তখন আমরা যারা সেই ধারাবাহিক আন্দোলনটাকে বোঝার চেষ্টা করেছি, তার প্রতিটা স্লোগানকে আক্ষরিক অর্থের উপরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করেছি, প্রত্যেকটা দাবির ঠিক-বেঠিক মূল্যায়ন করেছি। আমরা ওই মীমাংসাসূত্র আসার পরে তা নিয়েও বসি, হিসেব নিকেশে। সত্যিই কিছু কি এল এই আন্দোলন থেকে? নাকি কেবল স্তোকবাক্যে ভরে উঠল আকাশ, বোঝার চেষ্টা করি এই আন্দোলনের প্রাপ্তি কি কেবল আন্দোলনকারীদের নাকি তা আরও বৃহত্তর সমাজের এক প্রাপ্তি। সেই নিরিখে আলোচনাটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগে আসুন দেখি ডাক্তারবাবুরা কি কাজে ফিরলেন? নাকি ফিরলেন না? আন্দোলনকারীদের তরফে দেবাশিস হালদার বলেন, ‘‘আমরা শুক্রবার মিছিলের পরে নিজের নিজের কলেজে ফিরে গিয়ে বিভাগ ভিত্তিক এসওপি তৈরি করব, মানে একটা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর তৈরি করবেন। মানে কী হলে কী কী করা হবে তার একটা লিখিত ডকুমেন্ট। এবং যেখানে যেখানে খুব প্রয়োজন, সেগুলি চিহ্নিত করা হবে। শুধু সেই অতিপ্রয়োজনীয় জায়গাগুলিতেই আমরা কাজে যোগ দেব। বাকি জায়গায় আমাদের কর্মবিরতি চলবে। প্রয়োজনে আমরা আবার পূর্ণ কর্মবিরতিতেও ফিরতে পারি।’’ আর এইখানেই বহু প্রশ্ন উঠে আসছে, আসবে। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে। ডাক্তারবাবুরা কাজে ফিরলেন? নাকি ফিরলেন না?
এমনিতে আন্দোলন শেষ হলেই প্রাপ্তিকে বড়সড় করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখাতে অভ্যস্ত নেতারা। ওই যে জঙ্গিবীরের ভঙ্গি করে খানিকবাদে বাইরে এসে, দেখাও তোমার জয়ের ফসল কাষ্ঠ হেসে। এমন মীমাংসা আমরা দেখেছি বহু। এবারে কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারেরা সেটা করেননি, আসলে নিজেরাও কি খুব শিওর যে কী কী পেলেন? সে থাক, আমাদের আলোচনা দুটো কথা নিয়ে ১) ডাক্তারবাবুরা কি কাজে ফিরলেন? ২) নাকি আন্দোলন চলবে? তো তাঁদের কথা থেকে সেটা কি খুব পরিষ্কার হল?
আরও পড়ুন: Aajke | মানুষ চাইছিল ন্যায়বিচার, এঁদের লক্ষ্য মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার
তাঁরা বলেছেন ফিরে গিয়েই তাঁরা ঠিক করবেন কোনটা জরুরি, কোনটা জরুরি নয়, সেই ভিত্তিতেই তাঁরা কাজ করবেন। এই ডাক্তারবাবুরা হলেন বিশ্বের সেই প্রথম আশ্চর্য পাওয়া কর্মচারী, যাঁরা নিজেরাই ঠিক করবেন তাঁরা কী করবেন, কী করবেন না? ভারি মজার না? আপনারা যাঁরা অফিসে, মাঠে ঘাটে চাকরি করেন, বিনিময়ে মাইনে পান, তাঁরা এরকম করা ছেড়ে দিন, ভাবতেও পারবেন? অফিসে ঢুকে ঘোষণা করতে পারবেন যে আজ থেকে আমি বা আমরাই ঠিক করে নেব, কোন কাজটা করব, কোন কাজটা করব না। হাসপাতালের বাইরে আপনাকে স্ট্রেচারে শুয়ে থাকলেই হবে না, আপনাকে এক নির্দিষ্ট ডেসিবলে গলা তুলে চিৎকার করতে হবে, যা শুনলে পরে হয়তো, হয়তো ডাক্তারবাবুরা তাঁদের স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর অনুযায়ী আপনার চিকিৎসা করতে আসবে, বা আপনার গলাতেই যদি সমস্যা থাকে তাহলে সঙ্গে রুদালি ভাড়া করে নিয়ে গেলেই সম্ভবত ডাক্তারবাবুরা সাড়া দেবেন। আর যদি রাজ্য সরকার এ নিয়ে প্রশ্ন করে, তাহলে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে থামিয়ে দেওয়ার, স্তব্ধ করে দেওয়ার হুমকি তো ওঁরা আগেই দিয়ে রেখেছেন। বলেই রেখেছেন, এটা প্রত্যাহার নয়, একটা পরিকল্পনা, যাতে যে কোনও মুহূর্তে আন্দোলন মোডে ফেরা যায়। এগুলো মানা যায় না, কিন্তু তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নিই তাহলেও কি একটা প্রশ্ন থেকেই যায় না, প্রথম দিনেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরে যখন উনি কলকাতা পুলিশ কমিশনার সমেত, ডিসি নর্থ বা আমলাদের সরিয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছিলেন, সেদিনেই কি এই পদক্ষেপ নেওয়া যেত না? অনায়াসে সেদিনই বলতেই পারতেন গতকাল যা যা বলেছেন। বলেননি কেন? পাঁজিতে কুষ্মাণ্ড ভক্ষণ নিষেধের মতো আন্দোলন আংশিকভাবে প্রত্যাহার করা নিষেধ, এমন কিছু লেখা ছিল? না হলে বোঝান, চারদিন আগে যা যা হয়েছিল, চারদিন পরে একটি সরকারি কাগজ আসা ছাড়া আর নতুন কী ঘটল যে আপনারা ক্যাম্পাসে ফিরছেন? সেদিনই তো বলতে পারতেন ওই কাগজটা পাঠান। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মাইনে পাওয়া সরকারি বা বেসরকারি কর্মচারী, অনুদান বা ভাতা পাওয়া কর্মচারী কি নিজেই ঠিক করতে পারে, তারা কোন কাজ করবে কোন কাজ করবে না? সেটা ঠিক করে নেওয়ার কথা বলার মধ্যে কতটা ঔদ্ধত্য আছে?
আসলে এই আন্দোলন পিছন থেকে চালানো এক রাজনৈতিক আন্দোলন, গায়ে কেবল অরাজনৈতিক নামাবলিটা জড়িয়ে রাখা আছে। এই আন্দোলনের প্রথম এবং একমাত্র লক্ষ্য হল বর্তমান সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করা, তাদের দ্রুত ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্ররোচনা দেওয়া যাতে করে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আরও বাড়ে। এই আন্দোলনের লক্ষ্য আবারও বলছি বিচার নয়, ন্যায়বিচারও নয়, এই আন্দোলনের একমাত্র লক্ষ্য চেয়ার। কিসসা কুর্সি কা।