১৯৯৬-এ যখন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ৩০ বছরের গঙ্গার জলবণ্টন চুক্তি হয়েছিল, সে সময় ঢাকায় এখনকার মতোই শেখ হাসিনার সরকার ছিল। দিল্লিতে ছিল এইচডি দেবগৌড়ার যুক্তফ্রন্ট সরকার। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সেই সময়ে গঙ্গার জলবণ্টন চুক্তির পক্ষে ছিলেন। ১৯৯৬ সালের চুক্তিমাফিক জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিদিন ৪০ হাজার কিউসেক করে জল পায় ভারত। ফরাক্কা ব্যারাজ থেকে ফিডার ক্যানাল হয়ে কলকাতা বন্দরে যায় সেই জল। অবশিষ্ট জল মূল ব্যারেজ হয়ে যায় বাংলাদেশে। তবে মার্চ-এপ্রিলে নদীতে জল কমতে শুরু করলে সমস্যা বাড়ে। চুক্তি অনুযায়ী, মার্চ মাসে ২০ দিন বাংলাদেশে ৩৫ হাজার কিউসেক করে জল যায়। পরবর্তী ১০ দিন ভারত পায় একই পরিমাণ জল। এপ্রিলে উল্টো। ওই মাসে ভারত ২০ দিন পায় ৩৫ হাজার কিউসেক জল। বাংলাদেশ শেষ ১০ দিন পাবে একই পরিমাণ জল। বাকি সময় নদীতে যে জলপ্রবাহ থাকবে, তা সমানভাবে পাবে দু’ দেশ। এটা হল গঙ্গার জলবণ্টন নিয়ে চুক্তি যা শেষ হবে ২০২৬ সালে। কেন এটা জরুরি? কারণ গঙ্গার জল যথেষ্ট না পেলে আমাদের কলকাতা পোর্ট এমনকী হলদিয়া পোর্টও শুকনো হয়ে যাবে, মানে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির সঙ্গে তা জড়িত। অন্যদিকে এই গঙ্গার জল বাংলাদেশে না গেলে সেখানকার চাষ আবাদ, নদীর ধারের বড় বড় শিল্প ইত্যাদির পরিবহণ সমস্যার মুখে পড়বে। তাই ২০২৬-এর আগেই শেখ হাসিনা এ নিয়ে এক রফায় আসতে চান। এরপরে রয়েছে তিস্তার জল নিয়ে চুক্তি। সিকিমে কিছু আনপ্ল্যানড জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে ওঠার ফলে নদীর অবস্থা খুব খারাপ, ফ্ল্যাশ ফ্লাড হচ্ছে, সিকিম ভাসছে, সিকিম বাংলা সীমান্তও ভাসছে, প্রভাব পড়ছে উত্তরবঙ্গেও। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে এক চুক্তি ছিল এই তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে, তা শেষ হয়েছে আর ২০১১তে এক খসড়া চুক্তিতে মমতার সায় ছিল না বলেই তা পড়ে আছে। তো এই চুক্তিগুলো নিয়ে আলোচনা হবে ভারত-বাংলাদেশের, কিন্তু সেই আলোচনার দায়রা থেকে বাদ রাখা হল পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচিত সরকারকে, সেটাই বিষয় আজকে, ভারত সরকার কি পশ্চিমবঙ্গকে জল না দিয়ে শুকিয়ে মারতে চায়?
এই চুক্তি নিয়ে বা আগামী বৈঠকে কী আলোচনা হবে তা নিয়ে একটা কথাও জানানো হয়নি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচিত সরকারকে। অথচ নিয়মমাফিক জানাতেই হবে কারণ জল আর তার ব্যবহার রাজ্যের অধিকারের মধ্যেই পড়ে, সেই কারণেই এর আগে দেবেগৌড়া এই চুক্তি করার সময়ে প্রতিটা পদক্ষেপে সঙ্গে রেখেছিলেন জ্যোতি বসুকে।
আরও পড়ুন: Aajke | ডেথ অন হুইলস, দু’ চাকার যমদূত
কিন্তু মোদিজি তো সেসব সৌজন্য বোধের ধারও ধারেন না তাই মুখ্যমন্ত্রী এক চিঠিতে সাফ জানিয়েছেন, “পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অংশগ্রহণ ছাড়া তিস্তা এবং ফরাক্কার জলবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনও রকম চুক্তিতে আমার তীব্র আপত্তি রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বার্থ নিয়ে কোনও আপস করব না। গঙ্গা এবং তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হয়তো আপনার কিছু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকারের কোনও মতামত না নিয়ে এমন একতরফা আলোচনা কাঙ্ক্ষিত বা গ্রহণযোগ্য নয়।” মমতা ওই চিঠিতেই বলেছেন, বাংলাদেশ, ভারত বা পশ্চিমবঙ্গের বহু বিষয় আছে যা দুই দেশের জন্যই জরুরি, নদী পরিবহণ, রেল বাস, ছিটমহল ইত্যাদির মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা করাই যায় কিন্তু জল অত্যন্ত মূল্যবান। প্রাণধারণের রসদ নিয়ে কোনও সমঝোতা করতে আমরা প্রস্তুত নই। আসলে এই কথাগুলো আসছে কেন? আসছে তার প্রথম কারণ হল এই আলোচনার বাইরে এক নির্বাচিত সরকারকে রাখা হয়েছে, যে সরকার তার নির্বাচক মণ্ডলীর কাছে দায়বদ্ধ। সেখানে যা হবে তা আলাপ আলোচনার ভিত্তিতেই হওয়া উচিত আর সেই আলোচনাতে যদি রাজ্য সরকারকেই না রাখা হয় তাহলে এটা মনে হতে বাধ্য যে আগামী চুক্তি পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বার্থ-বিরোধী। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, রাজ্যকে অন্ধকারে রেখে গঙ্গা বা তিস্তা নদীর জল বাঁটোয়ারা নিয়ে একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে মোদি সরকার, মমতা বলছেন এরকমটা হতে দেবেন না, আপনারা কী মনে করেন?
আজ পশ্চিমবঙ্গের ৪২টা আসনের ২৫-৩০টা বিজেপি পেয়ে গেলে মোদি সরকার আরাম সে এক বাংলা বিরোধী চুক্তিকে চাপিয়ে দিতেই পারত আমাদের উপর, কিন্তু আজ ছবিটা উল্টো, এমনকী নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাই নেই সংসদে কাজেই এই আলোচনা রাজ্যের নির্বাচিত সরকারকে বাদ দিয়ে করাই সম্ভব নয়। হ্যাঁ, এইখানেই হেরে গেছেন মোদি-শাহ, বাংলার মানুষ ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন, কিন্তু তারপরেও যদি এরকম চক্রান্ত চলতেই থাকে তাহলে আগামী বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপি সাইনবোর্ড হয়ে যাবে।