জলসাঘরের সেই বৃদ্ধ জমিদারের মতো বড্ড নিঃসঙ্গ আমাদের কাঁথির খোকাবাবু শুভেন্দু অধিকারী। এবং প্রতিদিন তাঁর নিঃসঙ্গতা বাড়ছে। অথচ স্মৃতির গোড়ায় ঘা দিয়ে সেই দিনগুলোতে ফিরুন, দুই জগাই মাধাই, এধারে মুকুল ওধারে শুভেন্দু মিলে তখন মঞ্চ কাঁপাচ্ছিলেন। হিসেব খুব সোজা, ১১৫-১২০ তো পাবই, তারপর বাকিটা তো মুকুলদার হাতযশ। অমন যে অমন দিলীপ ঘোষ তিনি কেবল একটা ঝুমঝুমির মতো প্রচারগাড়ি পেয়েছেন, ব্যস। প্রচারের সবটা আলো শুষে খাচ্ছেন শুভেন্দু। তৃণমূল ভাঙছে, তৃণমূল ভাঙছে রব চারদিকে, উনি মুচকি মুচকি হাসছেন আর বলছে যুবরাজকে জেলে পুরব। সেদিনেই রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে গ্যামাক্সিন পড়ে যেত যদি নন্দীগ্রামে হারতেন, কাজেই ২০০ পার না হোক, ৭৭ পেলেও ওই নন্দীগ্রাম আবার কিছুটা সময় দিয়েছিল শুভেন্দুকে। কিন্তু ওই একটা পকেটে আমি শের বা সওয়া শের, তাই দিয়েই তো বাংলার রাজনীতি চলে না, এক্কেবারে খুলাছুট দেওয়ার পরে নিজের মতো ঘুঁটি সাজিয়েও পপাত চ, মমার চ। ১৮-র জায়গায় কোনওক্রমে ১২। তাহলে কাকা লাভ কার? যাঁরা বসেছিলেন ফেন্সিং-এ, খানিক দূর থেকে শুভেন্দুর এলেম মাপার চেষ্টা করছিলেন, তাঁরা এবারে মাঠে নেমেছেন, কড়ায় গন্ডায় আদায় করে নেবেন। সুকান্ত জানেন উত্তরবঙ্গকে আলাদা করার দাবি ইত্যাদি ওঁর ভোটব্যাঙ্কে কিছু জুড়বে, কমবে না। ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার বিধায়ক নিশিকান্তের টার্গেট তো মহুয়া মৈত্র, তৃণমূল, কাজেই ওনার কোনও স্টেকই নেই, উনি কেবল হুকুম মাফিক বিষ ছড়াচ্ছেন। বহরমপুরের বিধায়ক সুব্রত মৈত্র জানেন, মুসলমানরা জেলা দখল করছে এসব বললে ওঁর হিন্দু ভোট বাড়বে। দিলীপ এই খেলা দূর থেকে বসে দেখছেন, মেরা নম্বর ভি আয়েগা, বসে আছেন। কিন্তু শুভেন্দু অধিকারী? এই প্রতিটা বাংলা ভাগের দাবি ওঁর স্বপ্নের এক্কেবারে দফারফা করে দিচ্ছে, উনি জানেন, কিন্তু ওই যে নিঃসঙ্গ, কিচ্ছু করার নেই। কাজেই তিনি তাকিয়ে দেখছেন, তাঁর সাধের বাগান তছনছ হয়ে যাচ্ছে, তাঁর চোখের সামনেই। আর সেটাই আমাদের বিষয়, শুভেন্দু কি ক্রমশ একলা হয়ে পড়ছেন?
লোকসভা ভোটের পরে বঙ্গ বিজেপি এখন নাথবতী অনাথবৎ। তাঁদের দিল্লির নেতারা আপাতত মহারাষ্ট্র আর হরিয়ানাতে অন্তত মুখরক্ষাও কীভাবে করা যায় সেই চিন্তাতে ঘুমোতে পারছেন না। বাংলার বকওয়াস শোনার সময় তাঁদের নেই, যা পারিস তোরা করে নে, এরকম একটা স্টান্স।
আরও পড়ুন: Aajke | বাংলাকে টুকরো টুকরো করতে চায় বিজেপি
রাজ্যের রাজ্যপাল যিনি মোটামুটি একটা প্যারালাল বিজেপি দফতর খুলে বসেছিলেন তিনি এখন নিজের পশ্চাৎদেশ বাঁচাতে ব্যস্ত। মহিলা যিনি তাঁর বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেছিলেন তিনি এখন সুপ্রিম কোর্টে গেছেন, রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখেছেন, অতএব রাজ্যপালের পক্ষে বঙ্গ বিজেপি নেতাদের কথায় কান দেওয়ার মতো মানসিকতা নেই, উনি পারসোনাল এজেন্ডা নিয়ে মাঠে আছেন কিন্তু যা করছেন তাতে বিজেপির খানিক ক্ষতি হতেই পারে, লাভ হবে না। এবং সেই রকম এক মুহূর্তে বঙ্গ বিজেপির বিভিন্ন নেতা বাংলা ভাগের পুরনো দাবিগুলোকে সামনে রেখে তাঁদের অন্তত ভেসে থাকার ব্যবস্থা করছেন, বাংলা ভাগ চাইছেন, অনন্ত মহারাজ থেকে বহরমপুরের বিধায়ক সুব্রত মৈত্র। তাহলে আমাদের কাঁথির খোকাবাবু কী করবেন? সুকান্ত, অনন্ত, সুব্রত মৈত্রদের ছক হল বাংলা ভাগের দাবির ফলে দক্ষিণবঙ্গের বিজেপি ভোটে ধস নামে তো নামুক, উত্তরবঙ্গে তো খানিক লাভ হতেই পারে, কাজেই তাঁরা সেই দাবি প্রকাশ্যেই তুলছেন। মমতা বা তৃণমূল সেই দাবির বিরোধিতা করছেন, মানুষকে বলছেন বিজেপি আবার বাংলাকে টুকরো করতে চায়। আর আমাদের কাঁথির খোকাবাবু, এসব নিয়ে সরগরম বাজারে তিনি এক্কেবারে বোবা মেরে গেছেন। কারণ তাঁর বিরোধিতা দলের মধ্যের ইকুয়েশনকে নড়বড়ে করে দেবে, বিরোধিতা না করলে তমলুক কাঁথিও বাঁচানো সম্ভব হবে না, সব মিলিয়ে আমাদের শুভেন্দুবাবু বড্ড বিপদে এবং খেয়াল করে দেখুন বড্ড একলা। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে বাংলা ভাগ নিয়ে অনন্ত মহারাজ থেকে সুকান্ত থেকে ঝাড়খণ্ডের নিশিকান্ত দুবে বা বহরমপুরের বিধায়ক সুব্রত মিত্র সরব, কিন্তু শুভেন্দু অধিকারী এ নিয়ে একটা কথাও বলতে রাজি নন। কেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
রাজ্য সভাপতি প্রকাশ্যেই শুভেন্দু অধিকারী যা বলছেন, যা বলেছেন তার তীব্র বিরোধিতা করেই বিবৃতিও দিয়েছেন, দিলীপ ঘোষ এবং তাঁর লবি সমাজমাধ্যমে শুভেন্দুকে চ্যালেঞ্জ করছেন। বাংলা ভাগের এই ইস্যু যে দক্ষিণবঙ্গের এখনও অবশিষ্ট বিজেপি পকেটগুলোকে চুরমার করে দেবে এ নিয়ে শুভেন্দু যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তিনি তো স্বাধীন তমলুক বা তাম্রলিপ্তের দাবি করতে পারবেন না, তাহলে? ধস নামছে, সেটা দেখতে হবে বসে বসে, তিনি বড্ড একলা, ভীষণ একলা।