প্রথমে একটা ভিডিও দেখাই, অনুপম খেরের ভিডিও, তিনি আরজি কর ধর্ষণ হত্যাকাণ্ডে বিচলিত হয়ে এই রেকর্ডিং তাঁর সমাজমাধ্যমে দিয়েছেন। এবারে আলোচনা শুরু করি। বহু মানুষ আছেন যাকে বলে আন্তর্জাতিক, মাঝেমধ্যে কথা শুরু করলে খেই ধরাটাও কঠিন হয়ে ওঠে। ব্রাজিলের অ্যামাজনের জঙ্গল কেটে কীভাবে অক্সিজেন কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তার ফলে কীভাবে ফুসফুসের অসুখ বাড়ছে ইত্যাদি নিয়ে বুঝিয়ে বলতে পারেন। কেউ কেউ ব্রাজিল মানে পেলে আর অ্যামাজন মানে দেবের সিনেমা, এরকম এক ধারণা নিয়ে বেঁচেবর্তে থাকেন। ঠিক আছে, এঁদের নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। বেশিরভাগ মানুষের এসব নিয়ে ভাবনার সময় কোথায়? সেই দইওয়ালার কথার মতো, দই কিনবে না তো ডাকছ কেন? আমার বেলা বইয়ে দাও কেন? সেইরকম, সারা দিনের পেটের লড়াই সামলাতে সামলাতে আর সময় নেই। এরাই সংখ্যায় বিরাট। কিন্তু এই অসম্ভব নাকেমুখে কিছু গুঁজে পেটের তাগিদে বের হনেবালাদের দল কিন্তু ঘাড়ের উপর অন্যকিছু এসে পড়লে ভাবে, চিন্তা করে, প্রতিবাদ করে। আর এদের মধ্যে মধ্যবিত্ত মানুষজন তো এই বিষয়ে খানিক এগিয়ে, এদের হাত ধরেই নবজাগরণ এসেছে, এদের হাত ধরেই স্বাধীনতা বা তথাকথিত স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কিন্তু তাদের এই প্রতিবাদ সবটাই নিজের আশপাশকে ঘিরে। বাংলায় এক ধর্ষণ তাদের কাঁদায়, ভাবায়, তারা রাস্তায় নামে, ক্ষুব্ধ হয়, ক্ষোভ প্রকাশ করে, এবং একবার নয়, বহুবার। এরাই সেই নন্দীগ্রামে সূর্যোদয়ের পরের দিনে রাজপথে জোয়ার এনেছিল, এরাই ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ে ডাল চাল আর জামা কালেকশনের জন্য রাস্তাতেই ছিল, এরাই রশিদ আলি দিবসে চৌরঙ্গিতে, এরাই এই সেদিনের রিক্লেইম দ্য নাইটের বিভিন্ন জমায়েতে হাজির ছিল। কিন্তু রাজ্যের বাইরের বিষয় ওঁদের টানে? হয়তো আলোড়িত হন, হয়তো খবরও রাখেন পেটে লড়াইয়ের ফাঁকে ফাঁকে কিন্তু রাস্তায় নামার তাগিদ বোধ করেন না। সেই কোন প্রত্যন্ত উত্তর-পশ্চিমে চিত্রাঙ্গদার রাজ্যে নারীর সম্ভ্রম ভুলুণ্ঠিত, ওঁরা জানেন, ক্ষুব্ধ কিন্তু রাস্তায় নামেন না। এটা দোষেরও নয়। কারণ যে কোনও মানুষের একাত্ম হওয়ার তো একটা সীমা তো থাকেই। কিন্তু বাংলার বাইরের? বার্লিন থেকে, লন্ডন থেকে, বেঙ্গালুরু থেকে, দিল্লি থেকে, লিবার্টি যেখানে স্ট্যাচু হয়েই আছে সেই আমেরিকা থেকে এই আরজি করের ধর্ষণ আর প্রতিবাদের খবর এল এবং আসছে। তাঁরা ছিলেন কোথায় যখন মণিপুরে উলঙ্গ করে প্যারেড করানো হচ্ছিল ধর্ষিতা মহিলাকে? যখন হাথরসে জ্বলছিল মেয়ের লাশ মাঝরাতে? যখন বিলকিস বানোর ধর্ষকদের গলায় মালা পরিয়ে মিষ্টি খাওয়ানো হচ্ছিল তখন আপনাদের প্রতিবাদ কোথায় ছিল? সেটাই বিষয় আজকে, আজ বাংলার এই ঘটনার প্রতিবাদের পিছনে কি তাহলে অন্য গল্প আছে?
মুম্বই অভিনেতা অভিনেত্রীদের কান্না জড়ানো প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল আরজি কর কাণ্ডের পরে। অনুপম খের তো শব্দই খুঁজে পাচ্ছিলেন না, এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় তাঁর আত্মা কেঁপে কেঁপে উঠেছে, তাই কুছ তো বোলনা হি হোগা, কুছ তো কহনা পড়েগা, তিনি কয়েক দিনের চেষ্টার পরে নাকি এক ভিডিও রেকর্ডিং করে উঠতে পারছেন এবং তারপরে এক চার-পাঁচ মিনিটের ভিডিও রেকর্ডিং পাঠিয়েছেন। বার্লিনে এই আরজি কর কাণ্ডে ধর্ষিতা, মৃত ডাক্তারের জন্য স্থানীয় ভারতীয়রা মোমবাতি মিছিল করেছেন, একই রকম ছবি এসেছে আমেরিকা থেকে।
আরও পড়ুন: Aajke | রাশি রাশি ফেক নিউজের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে ধর্ষিতার আর্তনাদ
এই গোটা হলিউড, টলিউড, বলিউড কিন্তু চুপ করে দেখে গেছে ১০০ দিনের বেশি সময় ধরে চলতে থাকা স্টেট স্পন্সসর্ড দাঙ্গা, দেখেছে ধর্ষণের পরে ধর্ষিতাকে নিয়ে নগ্ন প্যারেড, দেখেছে কার্গিল যুদ্ধে লড়া জওয়ানের স্ত্রীকে নগ্ন করে হাঁটানোর ভিডিও। জানা যাচ্ছে যে ওই দাঙ্গায় সরাসরি ইন্ধন দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন্দ্র সিং। কিন্তু তাঁরা একটা কথাও বলেননি, কোনও প্রতিবাদ করেননি। আজ আরজি কর কাণ্ডে কেঁদে উঠেছে অনুপম খেরের বুক, কাঁদারই তো কথা, কিন্তু মণিপুর? হাথরস? উন্নাও? গোধরা? তখন কাঁদে না? আর যদি না কাঁদে তাহলে আপনি একটি নির্ভেজাল ভাঁড়, যিনি ক্যামেরার সামনে এক নির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে রাজনীতি করছেন। শুভেন্দু অধিকারী বা অগ্নিমিত্রা পলেরও যে ধক আছে, যাঁরা রাজনীতি করব বলেই মণিপুর হাথরসে চুপ থেকে আরজি করে এসে ডুকরে কেঁদে ওঠেন, আপনার, অনুপম খের, আপনার সেটাও নেই। আমার পাড়ার সেই বাচ্চা মেয়েটা যখন রিক্লেইম দ্য নাইটে পথে নামে তার সততার সামনে আপনি এক বিকিয়ে যাওয়া প্রচারযন্ত্রের চেয়ে বেশি কিছু নয়। আমাদের প্রশ্ন ছিল আমাদের দর্শকদের কাছে, বলিউড আর্টিস্টরা, বিদেশ থেকে, দেশের অন্য প্রান্ত থেকে কিছু মানুষ গর্জে উঠলেন এই আরজি কর ধর্ষণ বা হত্যা নিয়ে, যাঁরা মণিপুরের গণধর্ষণ, মহিলাদের নগ্ন করে প্যারেড করানো নিয়ে একটা শব্দও খরচ করেননি, আপনাদের মতামত কী? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
গরিব সাধারণ মধ্যবিত্ত রুখে দাঁড়ান শেষ অবস্থায়, সেটা তাঁর ধৈর্যের সীমা ভাঙার পরে আর যখন বিষয়টাকে নিজের সঙ্গে রিলেট করতে পারেন, মেলাতে পারেন। কিন্তু শিক্ষিত কিছু মানুষ প্রতিবাদের ব্যবসা করেন, এই বিষয়ে প্রতিবাদ করলে ওই সুযোগ আর সুবিধেগুলো পাওয়া যাবে, এই হিপোক্রিট, দোগলা মানুষজনদের চিনুন। নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করুন আরজি করের এই জঘন্য ঘটনার, কিন্তু এই মহামান্যদের প্রতিবাদের ব্যবসাকেও চিনুন, বুঝুন।