মহুয়া মৈত্র বা ডেরেক ও’ব্রায়েনরা কি খুব তৃণমূল তৃণমূল বলে মনেও হয়? একটু আলাদা ব্রাত্য বসুও ধীরে ধীরে নিজেকে তৃণমূলের মতো করেই গড়েপিটে নিয়েছেন। কিন্তু ডেরেক তাঁর বাক্য শুরু করার আগে অনুপ্রেরণা, শেষ করার আগে অনুপ্রেরণা ইত্যাদি বলেন কি? মহুয়া মৈত্র কি দিদির পায়রা হব গোছের কোনও বিবৃতি আজও দিয়েছেন। আপনি বলতেই পারেন সে তো অভিষেকও বলেন না, অভিষেকও দলীয় সভায় ঢুকেই মমতার পাশখানটিতে বসার চেষ্টা চালিয়ে যান না, বক্তৃতার শুরুতে আগে মধ্যে পেছনে শেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম নেন না। কিন্তু দলের আর দুজন সাংসদ আর ভাইপোকে এক করে দেখা কি ঠিক হবে? তাই ওই নামটা বাদই রইল। বাকিদের মধ্যে খুব দু’ একজনই এমন আছেন যাঁরা ওই সদা গদগদ ভাবটি রেখে দল করেন না, যা করেন এক আদর্শ বোধ থেকেই করেন। রাজনীতি ছেড়েই দেবেন কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে আনকোয়েশ্চেনেবল লয়ালটি পাওয়ার আশা দলনেত্রীরও নেই। দুজনেই অতি শিক্ষিত, দু’ তিনটে ভাষায় দক্ষতা আছে। ডেরেক এবং মহুয়া নিয়মিত হোমওয়ার্ক করেন। এসবের পরে যখন মহুয়াকে নিয়ে সংসদে প্রশ্ন উঠল, যখন বলা হল তিনি টাকার বদলে সংসদে প্রশ্ন করেছেন, বলা হল এক ব্যবসায়ীর কাছে তাঁর সংসদ অ্যাকাউন্টের লগ ইন পাসওয়ার্ড দিয়েছে, তাঁকে সংসদের এথিকস কমিটি ডেকেছে, তখন এক পক্ষ থেকে বলা শুরু হল যে উনি ভয়ঙ্কর অন্যায় করেছেন। সংসদ অ্যাকাউন্টের লগ ইন পাসওয়ার্ড কাউকে দেওয়ার মানে তো দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা আর অন্যদিকে কিছু মানুষ, তা মূলত বামপন্থী দলের, তাঁরা বলতে শুরু করলেন মহুয়া মৈত্রের পাশে দল নেই, দলনেত্রী নেই। আজ সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, মহুয়া মৈত্রের পাশে দল নেই?
আরও পড়ুন: Aajke | পশ্চিমবাংলার সংখ্যালঘু ভোট কোন দিকে?
মাত্র গতকাল দেশের সংসদের সচিবালয় থেকে জানানো হয়েছে যে এখন থেকে সাংসদ তাঁর অ্যাকাউন্টের লগ ইন আইডি আর পাসওয়ার্ড কাউকে দিতে পারবেন না। তো এর আগে কী ছিল? বলা ছিল যে সাংসদ বা তাঁর অথরাইজড পারসন অর্থাৎ তাঁর হয়ে কেউ এই লগ ইন আইডি পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে পারবে। তাহলে অভিযোগটা কীসের? এবং দীর্ঘকাল ধরেই সাংসদদের লগ ইন পাসওয়ার্ড নিয়ে দল, দলের কর্মী, আপ্ত সহায়ক, টাইপিস্টরা সংসদে তোলার জন্য প্রশ্ন পোস্ট করেছেন, সাংসদের টিএ, ডিএ বিল আপলোড করেছেন, দীর্ঘকাল ধরেই এটাই ছিল রীতি। মাত্র গতকাল তার বদল হয়েছে, বলা হয়েছে লগ ইন আইডি আর পাসওয়ার্ড অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবেন না।
সাংসদরা ফাঁপড়ে পড়বেন নিশ্চিত, এবার থেকে তাঁদেরই টিএ ডিএ থেকে বিভিন্ন হিসেব, ট্রেন প্লেনের টিকিট ইত্যাদি, বাংলোর বিষয়ে কমিউনিকেশন সবই নিজেদের করতে হবে, অন্তত আপলোড তো নিজেদেরই করতে হবে। কিন্তু এতদিন সে নিয়ম তো ছিল না, তাহলে? তাহলে মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে দোষটা কী? সব্বাই জানে আসল কারণটা কী। লাগাতার আদানির বিরুদ্ধে কথা বলা আপ নেতা সঞ্জয় সিং জেলে, রাহুল গান্ধীর সদস্যতা প্রায় কেড়ে নেওয়া হয়েছিল আর মহুয়া মৈত্রকে সংসদ থেকে বের করার প্রক্রিয়া সমাপ্ত। মানে ওসব লগ ইন পাসওয়ার্ড ইত্যাদি ফালতু কথা, আদানির বিরুদ্ধে গেলে মোদি-শাহ আপনাকে জেলে পুরবে, না হলে কম সে কম সংসদে বসতে দেবে না। অন্যদিকে আরেক অভিযোগ, মহুয়া মৈত্রের পাশে দল নেই। কারণ অভিষেক বলেছেন মহুয়া মৈত্রের ব্যাপার উনিই বুঝে নেবেন। মমতা কিছুই বলেননি ইত্যাদি ইত্যাদি। আচ্ছা মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, কতটা গম্ভীর তা মমতার মতো এতবারের সাংসদ জানেন না? জানেন না যে এটা অভিযোগের জন্যই অভিযোগ। এটা শুধু মমতা কেন, অভিষেকও জানেন, দলের প্রায় সব্বাই জানেন, অন্যান্য সাংসদেরাও জানেন। এটাও জানেন, এথিকস কমিটি বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে যদি স্পিকারও বহিষ্কারের সিদ্ধান্তই নেন, তাহলেও বড়জোর ওই শীতকালীন অধিবেশনে মহুয়া মৈত্র থাকতে পারবেন না কিন্তু কৃষ্ণনগরের আসনে ২০২৪-এ আগের থেকে বেশি ভোটেই জিতে আসবেন আবার। সারা দেশ এখন মহুয়া মৈত্রের নাম জানে, তাঁর বিরুদ্ধে এক লাগসই প্রার্থী দাঁড় করানোটাই বিজেপির কাছে সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। দু’ নম্বর কথা হল এমনিতে কিছুদিন আগেও আমিও বলেছি তৃণমূল দলে একটাই পোস্ট আকি সবই ল্যাম্পপোস্ট। কিন্তু সময় বদলাচ্ছে, তৃণমূলও এখন বেশ শক্তপোক্ত সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করার দিকে মন দিয়েছে, সংগঠন লাগবে বিজেপির বিরুদ্ধে এটা তাদের মাথায় ঢুকেছে। সেরকম সময়ে নদিয়ার দায়িত্ব মহুয়ার হাতে তুলে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহুয়ার পাশেই দাঁড়ালেন, এটাও তো পরিষ্কার। কাজেই ঘোলা জলে মাছ না ধরে সুজন চক্কোত্তি বরং গণশক্তির সম্পাদক বদলের দিকে মন দিন। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, মহুয়া মৈত্রকে নদিয়ায় দলের সভাপতি করা হল, এটাই কি প্রমাণ করে না যে সংসদে এথিকস কমিটির রিপোর্টের পরেও তৃণমূল দল মহুয়া মৈত্রের পাশেই আছে? কী বলছেন মানুষজন শুনুন।
মহুয়া মৈত্র বিজেপি বিরোধী যে কোনও দলের কাছে এক অ্যাসেট। ভাষার উপর দখল এবং বিজেপি বিরোধিতার জায়গায় এক স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই তিনি রাজনীতিতে নেমেছেন তাঁর বিরাট কেরিয়ার ছেড়ে। দেশের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছেন প্রথমবার নির্বাচিত এই সাংসদ। এসব তথ্য আর হিসেব কি তৃণমূলের কাছে নেই? না, সবটা মেলে না কিন্তু এখনই তৃণমূল মহুয়া মিত্রকে ছেড়ে দেওয়ার মতো ভুল করবে না, আপাতত তৃণমূল তার পূর্ণ সমর্থন নিয়েই মহুয়া মিত্রের সঙ্গেই আছে।