বাড়িতে গণেশ পুজো, নেমন্তন্ন করেছেন নরেন্দ্র মোদিকে, সেটা নাকি ব্যক্তিগত, বলেছেন আমাদের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের চিফ জাস্টিস, ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। ব্যক্তিগত আমন্ত্রণে যদি সব দলের নেতাদের ডাকতেন, বোঝা যেত। কিন্তু এই বাছাই করে ডাকা সন্দেহজনক, অনেকেই বলেছেন, আমরাও মনে করি। বিচার ব্যবস্থার এক আপাত নিরপেক্ষ ছবিটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যও অন্তত এই কাজ করা উচিত নয়, যা তিনি করলেন। কিন্তু আজকের আলোচনা তা নিয়ে নয়। আজকের আলোচনা সুপ্রিম কোর্টের গতবারের শুনানি নিয়ে। সেই শুনানির দুটো কথা নিয়ে। কারণ হুজুর ধর্মাবতারেরা তো আম আদমি নন, যাহা বলিবেন ভাবিয়াই বলিবেন, যাহা বলিবেন সত্য বলিবেন, এটাই মানুষের চাহিদা। কাজেই মুখ ফস্কে বলে ফেলেছি, এমন কথা বলার তো জো নেই। তো যে দুটো কথা গত শুনানিতে শুনেছি, তার ১ নম্বরটা হল, কিছু একটা লেখা বা কাগজ দেখে চন্দ্রচুড় সাহেব বললেন এটা তো খুব সাংঘাতিক। ব্যস, এদিকে লেখা শুরু হয়ে গেল, গোটা মামলা এতদিন ভুল পথে চলছিল, আসল দোষীর দিকে এইবার নজর পড়েছে, আষাঢ়ে গল্প বানানো শুরু হয়ে গেল। তিনি কি ওই শব্দ ক’টা না বললে বিচার ব্যবস্থা বানের জলে ভেসে যেত? আর দু’ নম্বর কথা হচ্ছে, উনি ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার সর্বোচ্চ পদে বসে আছেন, সেই তিনি চেয়ারে বসেই বললেন, ১৫ দিন আগে অর্ডার দেওয়া হয়েছে, এখনও কেবল ৩৬টা সিসিটিভি লাগানো হয়েছে? কপিল সিব্বাল তখন বলছেন মাই লর্ড, লাগানোর আগে তো জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। বিচারপতি বলছেন ১০০ কোটি টাকা স্যাংশন হয়েছে, কিন্তু ভেরি স্লো ভেরি স্লো। এত দেরি করে কাজ কেন হচ্ছে? আজ সেটাই বিষয় আজকে, বিচার, সুপ্রিম কোর্ট এবং চন্দ্রচূড় সাহেব।
চন্দ্রচূড় সাহেব যদি আমেরিকা বা ইউকে থেকে আসতেন, যদি এনআরআই হতেন, বুঝতাম যে ওঁরা তো ভারতের কর্মসংস্কৃতি জানেন না, বোঝেন না তাই বলেছেন, জানলে এমন মন্তব্য করতেন না। কিন্তু ইনি তো যাকে বলে ব্যবস্থার মাথায় বসে থাকা মানুষ। যে বিচার ব্যবস্থায় সিভিল আর ক্রিমিনাল মামলা মিলিয়ে ২০২২ সালের, হ্যাঁ ২০২৪ এর নয়, ২০২২ সালের মামলা পড়ে আছে ১৪৬৯২৯৬, মানে প্রায় ১৫ লক্ষ মামলা, আজ সেই সংখ্যাটা ২০ লক্ষ ৩৭ হাজার। এর মধ্যে আজ থেকে ২৪ বছর আগের ৮৯০০ মামলা পড়ে আছে, মীমাংসা হয়নি।
আরও পড়ুন: Aajke | কংগ্রেস-তৃণমূল কংগ্রেস নতুন সমীকরণ?
আরও শুনবেন? ১৯৫২ সালের একটা মামলা এখনও পেন্ডিং, ধরে নেওয়া যাক এক সবল মানুষ, মানে সমর্থ জওয়ান ২৫ বছরের একটি ছেলে সেই মামলা করেছিলেন, তাঁর বয়স এখন ৯৬ হওয়ার কথা, জানি না সেই মামলাকারী বেঁচেন আছে কি না। কিন্তু আমাদের মহামান্য বিচারপতি ১৫ দিনে কেন ৬০০ সিসিটিভি লাগানো হল না তাই নিয়ে মন্তব্য করছেন, ভেরি স্লো ভেরি স্লো। হুজুর-এ-আলম, আপনার আদালতে ৭১ বছর ধরে মামলা পড়ে আছে, আপনার মনে হয় না আর সামান্য একটু গতিতে মামলা চলা উচিত? না না, ওঁর হক আছে মন্তব্য করার, বলাই যেত তাড়াতাড়ি করুন, বলাই যেত যে একটা লেজিটিমেট টাইম পিরিয়ডের মধ্যে কাজ শুরু করুন, কিন্তু ভেরি স্লো? হুজুর তাহলে আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে কোন বিশেষণ দিয়ে বর্ণনা করা যাবে? সরকারি প্রসিডিওরে সবক’টা বিধিনিষেধ মেনে না চললে সিবিআই বা ইডি ক্যাঁক করে গলা চেপে ধরবে, করলে সময় লাগবে, এই বাস্তব অবস্থাটা না বুজে যদি মহামান্য বিচারপতি বিচারকের আসনে বসেই ওই মন্তব্য করেন তাহলে এই উপঢৌকনে লালিত পালিত সংবাদমাধ্যমের আর দোষ কী? তেনারা পেখম তুলে নাচিলেন, বিচারপতি ক্রুদ্ধ, বিচারপতি বলিলেন ভেরি স্লো, বিচারপতি বুঝিয়া ফেলিয়াছেন কোথাও নিশ্চিত ঘাপলা আছে, হুঁ হুঁ বাওয়া…। আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনার ওই আপাত নির্বিরোধী মন্তব্যের ফল এটাই। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, রাজ্য এক বড়সড় বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে ঠিক এই সময়ে রাজ্য সরকারের ত্রাণ, পুনর্বাসনের দিকে মন দেওয়া উচিত নাকি আরজি করে বাথরুম রেস্টরুম আর সিসিটিভিতেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন?
যদি নজর দিতেই হয় তাহলে হঠাৎ এই স্লো স্লো কমেন্টস ছেড়ে হুজুর-এ-আলমরা একটু আমাদের সরকারি কাজের পদ্ধতিগুলোর দিকে নজর দিন। প্রতিটা সরকারি কাজে অসংখ্য কাগজ, ফর্ম, বিভিন্ন রকমের গড়িমসি করার বিরাট সুযোগ, স্বচ্ছতার অভাব আর এক ১০০ শতাংশ দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক পরিবেশ এর জন্য দায়ী। এদের একটার, কেবল একটার দিকে তাকিয়ে এই ব্যবস্থাকে ঠিক করতে বলার উদ্দেশ্য হল আসলে এই ব্যবস্থাটাকেই টিকিয়ে রাখার চেষ্টা। যদি সত্যিই ব্যবস্থাটাতে গতি আনতে হয় তাহলে খোলনলচে বদল করার সিদ্ধান্তটা আগে নিন, তারপর কথা হবে, না হলে তা কেবল এক উদ্দেশ্যহীন অনর্গল কমেন্ট হিসেবেই ইতিহাসে থেকে যাবে।