সাতসকালে উঠেই খবর পাওয়া গেল, জুনিয়র ডাক্তারেরা আবার কর্মবিরতির ঘোষণা করেছেন। অনির্দিষ্টকালের জন্য। আবার তাঁদের দাবিপত্র সামনে। দাবিতে নতুন কিছু আছে? একটা কথাও নেই যা নিয়ে আলোচনা হয়নি। ওঁরা এখনই বিচার চাইছেন, এখনই। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নজরেই সিবিআই তদন্ত হচ্ছে, ওঁরা জানিয়েছেন তা প্রোট্রাকটেড, বাংলা মানে লম্বা টানা হচ্ছে। হ্যাঁ, সত্যি তো এমনিতেই বিচার এক সময়ের ব্যাপার, কারণ সুবিচারের প্রথম কথাই হল ১০০ জন অপরাধী ছাড়া পেলেও একজন নিরপরাধ যেন শাস্তি না পায়। কাজেই বিচারে সময় লাগে, চট বিচার পট শাস্তি তো তালিবানরা দেয়, ধর্ষণ করেছে, গুলি করে মেরে ফেল। জুনিয়র ডাক্তারেরা কি চাইছেন তালিবানি শাসন? সর্বোচ্চ বিচারপতি সমেত তিনজন সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকরা বসে এই মামলা নিয়ে আলোচনা করছেন, জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি নিয়েও কথা বলছেন, ওঁরা জানিয়ে দিলেন বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার বিরুদ্ধে আবার কর্মবিরতি। পরের দাবি স্বাস্থ্য সচিবের পদত্যাগ। এর আগেই কলকাতা পুলিশের কমিশনার, ডিসি নর্থ, স্বাস্থ্য দফতরের দুজন আমলাকে সরানো হয়েছিল, তাঁরা কাজে যোগ দিলেন। এখন দাবি স্বাস্থ্য সচিবকেও সরাতে হবে। এর আগেই দাবি করেছিলেন ডাক্তারবাবুরা কেন্দ্রীয়ভাবে রেফারেল সিস্টেম, মানে জেলা বা মহকুমা স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে তারচেয়ে বড় হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থাটা করতে হবে। ১৫ দিন কাটল না, তাঁরা সেই একই দাবি নিয়ে আবার কর্মবিরতিতে। রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে, কলকাতা সংলগ্ন এলাকাতে ডেঙ্গি সংক্রমণ বাড়ছে, পুজো এসে গেছে, এর কোনওটাই ডাক্তারবাবুদের বিচলিত করতে পারেনি, তাঁরা নেমেছেন আন্দোলনে, কর্মবিরতিতে। সেটাই বিষয় আজকে, পুজো আসছে, সত্যের জয় হোক, মিথ্যের অবসান, জীবনে আসুক উৎসব।
যে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রায় ৩০ শতাংশ দেড়, দুই, আড়াই কোটি টাকা দিয়ে ডাক্তারি ডিগ্রি নিয়েছেন, তাঁদের মাথায় রাজ্যের বানভাসি মানুষের কথা থাকবে কেন? কেন তাঁরা ভাববেন রামা কৈবর্ত, শ্যামা বাগদি বা সুলেমানের কথা? কেন তাঁরা ভাববেন ওই বানভাসি অঞ্চলে বছরের অর্ধেক আয় হারিয়ে ফেলা বানভাসি মানুষদের কথা? তাঁরা ভাববেন না এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু একটা চক্ষুলজ্জাও তো থাকে। এঁদেরর তাও নেই। একধারে কোটি টাকা দিয়ে ডাক্তার হওয়া আর অন্য ধারে কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগে গড়ে ওঠা কর্পোরেট হাসপাতাল, সব মিলিয়ে এক পয়সাওলাদের হেলথ সিস্টেমে গরিবরা মরে মরুক, তা নিয়ে ওঁদের চিন্তাই নেই। আছেন আড়ে সাত আট হাজার জুনিয়র ডাক্তার, জেনারেল বডি মিটিংয়ের নামে জনা ৫০ ডাক্তারেরা মিলে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
আরও পড়ুন: Aajke | কর্মবিরতির নামে সরকারকে ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে
মাত্র গতকালই এঁদের আইনী পরামর্শদাতা খুব পরিষ্কার সর্বোচ্চ আদালতে জানিয়েছেন যে ডাক্তারবাবুরা কাজে যোগ দিয়েছেন, আদালত আরও সুস্পষ্টভাবে বলেছে যে জরুরি এবং দরকারি সমস্ত কাজে তাঁদের যোগ দিতে হবে। গতকাল বিকেল ৫টাতেও তাঁদের আইনজীবীরা অন্য কোনও অভিযোগ জানাননি, কিন্তু রাতে ডাক্তারবাবুরা বৈঠক করার পরে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন, মর শালারা। যাদের পয়সা আছে তাঁদের জন্য খোলাই আছে কর্পোরেট হাসপাতাল, খোলা থাকবে নার্সিং হোম। যাঁদের পয়সা নেই তাঁরা চিকিৎসা না পেলেও কিচ্ছু এসে যায় না এই ডাক্তারদের। ভাবতে ভয় লাগে বছর পাঁচ সাত পরে এই অসংবেদনশীল মানুষগুলোই আপনার আমার স্বাস্থ্যের ঠিকাদার। যাঁরা এরপরেও এই জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনকে সমর্থন করছেন, তাঁরা ভাবুন, কার পক্ষে আর কাদের বিপক্ষে আপনারা দাঁড়াচ্ছেন? একটা নির্বাচিত সরকার সাধারণভাবে দমনমূলক ব্যবস্থা নিতে চায় না, এসমা জারি করতে চায় না, চায় না লাঠি গুলি দিয়ে আন্দোলন ভাঙতে, সেটারই কি সুযোগ নিচ্ছেন এঁরা? আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, এত বৈঠক এত আলোচনার পরে কলকাতা পুলিশ কমিশনারের মতো পদ থেকে বিনীত গোয়েলকে সরিয়ে দেওয়ার পরে যাঁরা কাজে যোগ দিলেন তাঁরাই এক সপ্তাহের মধ্যে আবার কর্মবিরতিতে। সরকার কী করবে? সরকার কি মুখ বুজে সহ্য করে যাবে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন?
লেবু কচলালে তেতো হয়, ডাক্তারবাবুরা সম্ভবত এটা জানেন না। ওঁদের আন্দোলনের হাজার খামতি থাকা সত্ত্বেও কেবল ওই তিলোত্তমার ন্যায়বিচারের দিকে চেয়েও বহু মানুষ তাঁদেরকে সমর্থন করেছিলেন, এবার সেই সমর্থনও তাঁরা খোয়াবেন। আগামী শুনানির দিনে আবার নিশ্চয়ই কোনও নতুন যুক্তি নিয়ে তাঁদের আইনজীবী সর্বোচ্চ আদালতে দাঁড়াবেন, কিন্তু এবারে তিলোত্তমার বিচারের জন্য নয়, লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকারের কথা মাথায় রেখেই আমরাও বসে থাকব আমদের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের দিকে। কিন্তু তার মধ্যেই পুজো এসে গেল, সব মিলিয়ে বিস্বাদ লাগছে। যদিও শেষ ক’দিনে বাজারে মানুষ গেছেন, যদিও পুজোর সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু চিন্তা তো রয়েই গেল। তবুও সব ভুলেই বলব জীবনে আসুক উৎসব। আগামী কিছুদিন আপাতত ছুটি, পরে আবার ফিরে আসব আজকে নিয়ে, পুজোর শুভেচ্ছা, আদর আর প্রণাম।