বিশ্বকর্মা জমিয়েই দিল মনে হচ্ছে, পাড়ার মোড়ে পরিচিত ছবি, ঢাকের শব্দকে মাঝেমধ্যেই ছাপিয়ে যাচ্ছে ডিজে। আন্দোলনে সারারাত কাটানো ছোট ফ্যাক্টরির মালিক খাসির মাংস কিনছেন, তাকালাম, না বলিনি এটা যে, ক’দিন আগেই ফেসবুকে লিখলেন এবারে উৎসব না, তার কী হল? বিশ্বাস করুন জিজ্ঞেs করিনি, কিন্তু উনি সম্ভবত চোখের এই সাধারণ ভাষা পড়ে ফেলেছেন, বললেন আসলে ১৩ জন ওয়ার্কার, তাদের তো একটা দাবি থাকে তাই একটু। আমি বললাম, না না ওদের কথা ভাবা উচিত, ওঁরা তো সন্দীপ ঘোষের সহকারী নন। উনি বললেন, হ্যাঁ তা তো বটেই। সন্ধেয় আসবেন, ওই সামান্য কিছু লোকজনকে ডেকেছি। অত্যন্ত নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর শ্রাদ্ধের ওই মৎস্যমুখে গিয়েছিলাম, আমি তো যতটা সম্ভব গম্ভীর মুখেই গেছি কিন্তু গিয়ে দেখি ফিস্ট চলছে। হ্যাঁ, এটাই জীবন কালীদা, বইতেই থাকে নিজের ছন্দে, থেমে গেলে শ্রাদ্ধ হবে। তো যে কথা বলছিলাম, গতকালের পরে বহু মানুষ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন, তাই সকালে তিনদিনের অবিরল বারিধারার পরে রোদ এসেছে, আজই বাজারে কিশোরভারতী এসেছে, শোকবৃত্তান্ত লিখে যাঁরা ক্লান্ত, সেই সংবাদমাধ্যমেও বিজ্ঞাপন বিভাগ নতুন এনার্জি নিয়ে মাঠে। নতুন ইভেন্টের খোঁজ চলছে, আজই রেস্তরাঁর পুজোভোজের মেনু ফাইনাল হবে, মহালয়া থেকেই চালু, খোঁজ নিচ্ছেন ২ অক্টোবর খাসি পাওয়া যাবে? নাকি পয়লাতেই কিনে রাখতে হবে? এসবের মাঝেই জিবুদা, গড়িয়াহাটের হকার, বাড়ি ফিরে একগাল হাসি, বলেছেন, শেষ, সব মেনে নিলেন মমতা, কাল থেকে সব নর্মাল। জিবুদার বউয়ের মুখ থেকে সরেছে কালো মেঘ, তাই সেটাই বিষয় আজকে, এবার পুজো নামুক বাংলায়।
যখন পুরুষরা কেবল গোহারা হেরেছেন তাই নয়, ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়েছেন, মাঝমাঠে যাত্রাপালার ভিলেনের মতো মহিষাসুর হা হা করে হাসছে, তখন এর তার কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মধু পান করতে করতে এক মহিলা এক্কেবারে ফ্যামিলি সুদ্ধু সঙ্গে নিয়ে সেই অসুরকে বধ করছে, নারীত্বের এমন উদযাপন আর কোথায় আছে? কোন ধর্ম, কোন সভ্যতায় এমন আছে? সে সমতলের মানুষই নয়, সেই পর্বতকন্যা ভূলোক দ্যুলোক জয়ী এক পুরুষকে উচিত শিক্ষা দিচ্ছে, তার অন্যায়ের জন্য এমন উদযাপনে না বললেন কারা? যাঁরা নারীদের রাত দখলের লড়াইয়ে নেমেছিলেন, বলা উচিত ছিল এবার আরও বড় করে দুর্গাপুজো হবে, মহিলারা নিন এবারের দুর্গাপুজোর ভার, ওমা, সেই মহিলারা লিখলেন এবার পুজো নয়।
আরও পড়ুন: আন্দোলন নয়, ছ্যাবলামো হচ্ছে
আসলে শিকড় নেই মাটিতে, সেই কবেই ঋত্বিক বলেছিলেন এই মিথ, পুরাণকে বাদ দিলে হবে না, এর মধ্যেই আমাদের শিকড় আছে, এর থেকেই আমাদের সমাজের ভিত্তি গড়ে উঠেছে, আমরা খারাপ বলতে অসুর বলি, ভালো বলতে দেবতা, তারও ভিত্তি ওই পুরাণ আর মিথে। আমাদের কোনও কিছুই বাদ দিলে চলবে না, সত্যজিৎবাবু ‘দেবী’ তৈরি করেছিলেন, তাঁর ছবিতেও দুর্গাপুজো ঘুরে ঘুরে এসেছে, অথচ সেই অর্থে বাম মানসিকতায় এখনও উৎসবের বোধ নেই। উৎসবকে নিছক আনন্দ বা ক্যাওড়ামি ধরে নিয়েই পুজো প্যান্ডেলের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন বিক্রি করার মধ্যেই নিজেদের শুদ্ধতা বজায় রাখা মানুষজনই এই না পুজোর ডাক দিয়েছেন। এবং মজার কথা দেখুন পুজোতে যা যা লাগে, সেই পদ্মফুল থেকে শিউলি আশ্বিনের শারদপ্রাতে কেউ চাক বা না চাক তারা হাজির। একটা রাফ এস্টিমেট বলছে ২০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয় আমাদের এই শারদ উৎসবে, এবং সেটাও খুব ছোট ছোট লেনদেন, আম্বানির বিয়ে নয় যে একটা লেনদেনের মূল্য ৭-১০-৩০ কোটি টাকা, এখানে ৫ টাকার ফুচকা থেকে ১২০০ টাকার শাড়ি বা ১৮০০০ টাকার দুর্গাঠাকুর কেনাবেচা হয়, কাজেই বহু বহু মানুষের স্বার্থ জড়িয়ে আছে এই উৎসবের সঙ্গে। যে নির্বোধরা হঠাৎ এই না উৎসবের এলিটিজমে মেতেছেন, তাঁদের বলব অনেক হয়েছে এবারে থামুন। আমাদের এক তিলোত্তমার জন্য আমাদের মগজ মনের রক্তক্ষরণ কম হয়নি, আমরাও সেই নৃশংস ঘটনার বিচার চাই শাস্তি চাই কিন্তু তার মানে রাজ্যের ১০ কোটি মানুষের সারা বছরের আনন্দ উৎসবকে ম্লান করেই সেই বিচার চাইতে হবে? প্যান্ডেলের পাশেই থাকুক প্রতিবাদের মঞ্চ, প্যান্ডেলের পাশেই থাকুক অভয়া কাউন্টার, এসব তো করাই যায় কিন্তু উৎসব আসুক নেমে, বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ুক। আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্রেফ একটাই কথা, এসে গেল দুগগাপুজো, কী কী প্ল্যান আছে? না, এই প্রশ্নের ল্যাজাতে গোড়েতে আর কিচ্ছু ঝোলাইনি, শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
মানুষ জীবন খুঁজে পেতেই বাঁচে, শহরে হাসপাতালের সংখ্যা শ্মশানের চেয়ে অনেক অনেক কম হয়, বেশিরভাগ মানুষ তাদের দেখা প্রথম মৃত্যুর কথা মনেই করতে পারে না, এটাই মানুষের মস্তিষ্কের গড়ন, জোর করে তাকে বিমর্ষ করে রাখা যায় না, হাসি কান্না হীরা পান্না দোলে ভালে, তার মধ্যেই মানুষ গায় কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ, দিবারাত্রি নাচে মুক্তি, নাচে বন্ধ, সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ। মম চিত্তে নিতি নৃত্যে, কে যে নাচে তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ। আজ থেকে শুরু পুজোর গল্প।