নেই কাজ তো খই ভাজ বলে একটা কথা অনেকেই বলেন। কেসটা কী? মাঠের ধান পল দিয়ে খামারে রাখা, ক’দিন পরে ঝাড়া হবে, গরুটা বিইয়েছে তাও একমাস হল, দুধ হচ্ছে ৫-৬ লিটার, খেতে লাউ, শশা, পালং শাক, দেখলে মন ভরে যায়। পুকুরে খ্যাপলা ফেললেই এবেলার খাবার মতো মাছ উঠছে, সেও তো তুলছে ছোট ছেলে। তো গিন্নির কাজ কী? ওদিকে বাড়ির গিন্নি হাতে হাত দিয়ে বসে থাকবে তাও তো হয় না, ৮৫ বছরের অশক্ত শাশুড়ি গিন্নিমার এই বসে থাকা দেখে ফেলবেই, সুর করে করে জানাবেই বাড়ির বউ-ঝিরা আজকাল আর গতরটিও নাড়ায় না। অতএব, নেই কাজ তো খই ভাজ, চাড্ডি ধান এনে খই ভাজতে বসে গিন্নি, দাওয়ায় বসা শাশুড়ি, বা ঘরের কর্তারা দেখে বড় গিন্নি বসে নেই, কাজ করছে। এই হল গল্প। তেমন হল আমাদের মিডিয়া, সংবাদমাধ্যম। খবর নেই, কিন্তু সনসনিখেজ, সেনসেশনাল নিউজ দিতে হবে, ক্রমাগত মানুষের উত্তেজনাকে জাগিয়ে রাখতে হবে, কেবল সন্ধেবেলার কলতলার কাজিয়াতেই হবে না, সারাদিন ধরে টিআরপির পারদ চড়াতে গেলে কিছু তো করতে হবে, অন্তত করার ভান তো করতেই হবে, তাই ওই একই ব্যাপার, নেই কাজ তো খই ভাজ। তাকিয়ে দেখুন খবরের কাগজ বা টিভি চ্যানেলগুলোর দিকে, বিরাট করে খবর ছাপা হয়েছে, মমতা হাতে নিলেন দলের ভার। এর মানে কী? এতদিন কার হাতে ছিল দলের ভার? কে বলতেন শেষ কথাটা, যে কোনও নির্বাচনের সময়ে প্রার্থী তালিকাতে কার সিলমোহর পড়ার পরেই তা ঘোষণা করা হত? কোন হরিদাসী পাল বা মান্তু কুমারী হালদার এসবের দায়িত্বে ছিলেন? হঠাৎ বিরাট খবর, মমতাই দায়িত্ব নিচ্ছেন দলের। কাজেই আসুন সেটা নিয়ে আমরাও খানিক কথা বলি, সেটাই বিষয় আজকে, মমতাই শেষ কথা।
আচ্ছা পৃথিবিতে একটা, আর একটা রাজনৈতিক দল দেখাতে পারবেন, যে দলের প্রতিষ্ঠাতা নেতা বা নেত্রী নিজের দলের নির্বাচনী চিহ্ন এঁকেছেন, দলের পতাকা তৈরি করেছেন আর তারপরে তা ছড়িয়ে গেছে লক্ষ কোটি মানুষের কাছে? এক এবং একমাত্র উদাহরণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল দলটা এতটাই তাঁর, একটা ইনসেপারেবল এনটিটি, অবিচ্ছেদ্য অস্তিত্ব। তাঁকে আর তৃণমূল দলকে আলাদা করার ক্ষমতা স্বয়ং ইশ্বরেরও নেই।
আরও পড়ুন: Aajke | শুভেন্দু অধিকারী হয় বোকা, নয় মূর্খ
সেই দিনটার কথা মনে করিয়ে দিই, নতুন দল তৈরি হয়েছে, সামনেই নির্বাচন, মমতা ঘাসফুল এঁকে ফেলেছেন, সোমেন মিত্র উত্তরবঙ্গে যাচ্ছেন, কোনও একজন সাংবাদিক তাঁকে ওই নির্বাচনী প্রতীক দেখিয়েছিলেন। সেই নেতা প্রাথমিকভাবে যাঁর বিরুদ্ধে লড়াই করেই দল ছেড়েছিলেন মমতা, তৈরি করেছিলেন নতুন দল, সেই সোমেন মিত্র সেদিন বলেছিলেন এমন উদ্ভট প্রতীক চিহ্ন আর দেখিনি, হেসেছিলেন। ডেসটিনি কাকে বলে, সেই সোমেন মিত্র ক’বছর পরেই ওই জোড়াফুলে ঘাসফুল চিহ্ন নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে ডায়মন্ড হারবার থেকে জিতে দিল্লি গিয়েছিলেন। দলে অপমানিত সোমেন মিত্রকেও দলে ঠাঁই দিয়েছিলেন মমতা, তাঁর পাশে থাকা দুর্দিনের সঙ্গীরা একটা কথাও বলেননি, বলেও কোনও লাভ হত না, কারণ দলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানুষ একটিই। আর যাঁরা মমতাকে চেনেন, তাঁরা জানেন উনি সপাটে ছক্কা মারেন স্ট্রেট ব্যাটে, কোনও ফালতু কায়দাবাজি নেই, উনি যা বলতে চান সেইও মেসেজ লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার হয়েই দলের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়। তো সেই হেন নেত্রী নাকি দলের দায়িত্ব নিলেন! তো প্রশ্ন তো উঠবেই, খুব সাধারণ প্রশ্ন, দলটা ছিল কার কাছে? তিনি কি কোথাও একদিনের জন্যও দলকে কারও জিম্মাতে ছেড়েছিলেন? তাহলে এমন বোকা বোকা হেডিং, এমন বোকা বোকা ব্রেকিং নিউজ আসছে কেন? উনিই বলবেন শেষ কথা, মমতাই দলের দায়িত্বে, সেটা জানিয়ে দিলেন। কাকে ভাই? কাকে? কার হাত থেকে কবে তিনি এই দায়িত্ব নিলেন? দলের একটা হাফ কি কোয়ার্টার সিদ্ধান্তও তাঁর অসম্মতিতে নেওয়া হয়নি কোনও দিন। সেসব নিয়ে একটা কথাও কিন্তু লেখা হচ্ছে না, কেবল একটা ইস্যু তৈরি করা হচ্ছে, যেন দলের মধ্যে মারকাটারি চলছে, দল দুই ভাগ হওয়ার মুখে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাদের মনে হয় একবারের জন্যও যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দলের দায়িত্ব অন্য কারও উপরে ছেড়েছিলেন? আপনাদের কি মনে হয় যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সায় ছাড়া তৃণমূল দলে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব? আপনাদের কি একবারের জন্য মনে হয় যে তৃণমূল দলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে কথা বলার কেউ আছে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
অনেক আঞ্চলিক দল আছে যা একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা, অভিনেতা, বা কোনও দলের বড় নেতা তৈরি করেছেন, কিন্তু সেগুলোর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধায়ের তৃণমূলের সঙ্গে তুলনা করলে ভুল হয়ে যাবে। এখানে উনিই এক এবং অদ্বিতীয়। অতি বোকা বা মূর্খও এই দলে থেকে নেত্রী মমতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে যাবে না, শুভেন্দু দলের মধ্যে থাকাকালীন একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারেননি, অমন অনর্গল বাজে বকতে পারা রুদ্রনীলও নয়, পিছনে বিজেপির খুঁটিতে ল্যাজটা বাঁধার পরেই মমতার বিরুদ্ধে কিছু বলতে পেরেছেন। এ দলের পতাকা থেকে দলের নিয়মকানুন সব কিছুর শেষ কথা ওই এক মমতা। কাজেই বিগ্রহকে চ্যালেঞ্জ করে যেমন মন্দিরের পূজারী হওয়া যায় না, তেমনিই তৃণমূল দলে থেকে মমতার বিরোধিতা অসম্ভব। যাঁরা এই খবর ছাপছেন, বানাচ্ছেন, গেলাচ্ছেন তাঁদের আসলে ওই নেই কাজ তো খই ভাজ, কাজ নেই তাই একটা ইস্যু তৈরি করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।