চিরদিন শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা যায় না, ইতিহাস সে কথা বলে। কিন্তু শাসন ক্ষমতার মধ্যে কিছু ভাইরাস, কিছু ব্যাকটেরিয়া থাকে যা থেকে নিজেদের বাঁচানো বড্ড কঠিন, আর তাই কেউই চিরটা কাল ক্ষমতায় থাকে না। যখন একটা খবর লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছতেই বছরখানেক লেগে যেত, তখন শাসন ক্ষমতার সময়ের পরিধি বেশি ছিল, এক এক রাজত্ব চলেছে ২০০-২৫০-৩০০-৫০০ বছর ধরে, তারপর মানুষের সমর্থন সরে গেছে, বিদ্রোহ বিপ্লবে সেই সাম্রাজ্য, সেই শাসনের অবসান হয়েছে। আধুনিক সময়ে মুহূর্তের মধ্যে তথ্য ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে, মুহূর্তের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ বুঝে ফেলছে শাসকের আসল চেহারা, কাজেই শাসন ক্ষমতা ক্রমশ ক্ষণস্থায়ী হচ্ছে। কিন্তু সেই একই কমিউনিকেশনকে কাজে লাগিয়ে, সেই একই তথ্য পৌঁছে যাওয়ার এই সরল থিওরি কাজে লাগিয়ে শাসকদল খানিক মেরামতিরও সুযোগ পাচ্ছে। আমরা দেখলাম অখিল গিরি একজন মহিলা বন আধিকারিককে নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করলেন, তাঁর সঙ্গে থাকা লোকজনই সেই ভিডিও ভাইরাল করে দিলেন। মানুষের মনে এই মন্ত্রী, এই সরকারের বিরুদ্ধে এক ক্ষোভ জন্ম নিচ্ছে, কিন্তু তা দানা বাঁধার আগেই দ্রুতগতিতে তৃণমূল দল ব্যবস্থা নিল। মন্ত্রীকে বলা হল পদত্যাগ করুন, ক্ষমা চান, মানে দুটোর একটা নয়, দুটোই করতে হবে, তাহলে অন্তত দলে থাকতে পারবেন। মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, ক্ষমা চাইবেন কি না তা আজ জানা যাবে, না চাইলে দলে রাখা হবে কি না তাও আজই জানা যাবে। হ্যাঁ যে দ্রুততার সঙ্গে একটা খবর ভাইরাল হল, তার চেয়েও দ্রুততায় পরের খবর ভাইরাল হল, মানুষের কাছে লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার মেসেজ, সেটাই আমাদের বিষয় আজকে বাঁদরামি চলবে না, জানালেন মমতা।
দেশে এমন এক সরকার শাসন করবে যাদের আমলে চুরি হবে না, ধর্ষণ হবে না, মন্ত্রী চুরি করবে না, শাসকদলের নেতারা অসভ্যতা করবেন না, রাজনৈতিক নেতারা চুরি করবেন না, এরকমটা মাইরি বলছি, আমি আশা করি না এবং আমি ১০০ শতাংশ নিশ্চিত যে একজন মানুষও এই ঢপের কথা বিশ্বাস করবেন না।
আরও পড়ুন: Aajke | মোদি–দিলু ঘোষের জন্মদিন ক’টা?
কিন্তু এইসব ঘটনা ঘটলে যদি ক্ষমতায় থাকা সরকার ব্যবস্থা নেয়? যদি চোরদের ধরার জন্য পুলিশ সক্রিয় হয়, ১০টা চুরির ৭টা ধরা পড়ে, যদি ধর্ষণের অভিযোগ যার নামে তাকে জেলে পাঠানো হয়, যদি মন্ত্রী চুরি করলে তাকে জেলে পোরা হয়, জবাবদিহি করতে হয়, শাসকদলের কেউ মাস্তানি করলে তাকেও পুলিশ গিয়ে ধরে? তাহলে মানুষ সেই সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলবে তো নাই বরং সেই সরকারের জনসমর্থন বেড়ে যাবে। এটাকেই রাজধর্ম বলে। কথাটা বহুল প্রচারিত হয়েছিল কবে? যখন গোধরা ঘটনার পরে গুজরাটে মুসলমানদের ভোটার লিস্ট ধরে ধরে মারা হল, সেই গণহত্যার পরে অটল বিহারী বাজপেয়ী বলেছিলেন রাজধর্ম পালন করো। এক কান দিয়ে শুনেছিলেন মোদিজি, অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়েছিলেন। দুনিয়ার বেশিরভাগ শাসকই এটাই করে থাকেন, এবং এই নিষ্ক্রিয়তাই ক্ষোভের জন্ম দেয়। আমরা বাম জমানাতে এরকম ভূরি ভূরি অভিযোগের কথা শুনেছি, এমনকী এই তৃণমূল জমানাতেও কম শুনেছি নাকি? কিন্তু সম্ভবত হুঁশ ফিরেছে, রাজধর্ম পালন না করলে মানুষ ঠিক সময়ে ভিটেমাটি চাটি করে দেবে, কিউকি আপ কিরায়েদার হ্যায়, জাতি মকান থোড়ি হ্যায়? আপনি ভাড়াটে, বাড়ির মালিক তো নন, কাজেই সময়মতো ইভিএম-এ তার প্রভাব পড়বেই। সম্ভবত সেটাই মাথায় রেখে তৃণমূল তার চেহারা পাল্টাচ্ছে। এক মন্ত্রীকে একজন সরকারি আধিকারককে খারাপ কথা বলার জন্য তাকে পদত্যাগ করতে হবে, ক্ষমা চাইতে হবে, এরকম টাফ ডিসিশন এর আগে কোনও সরকারই কি নিয়েছে? আমার জানা নেই। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে একজন সরকারি আধিকারিককে একজন মন্ত্রী খারাপ কথা বলেছেন, হুমকি দিয়েছেন এবং তারজন্য সেই মন্ত্রীকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছে এরকম আর কোনও দৃষ্টান্ত আপনাদের জানা আছে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
তৃণমূল সময়ে সময়ে তাদের বদলাচ্ছে, একটা সময়ে যে দল বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধেছিল তারা এখন দেশের বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম। যে দল একটা ক্লাবের মতো চলত, এখন তার এক কর্পোরেট স্ট্রাকচার তৈরি হয়ে গেছে। একটা দল যেখানে নেতাদের প্রায় যা খুশি করার অধিকার ছিল আজ তারাই স্ক্যানারের তলায়, বেচাল হলেই মাথায় কোপ পড়ছে। দিদি খুব একটা বদলেছেন? না, তেমনটা নয়, কিন্তু তৃণমূল দল? বদলে গেছে। উল্টে দেখুন, পাল্টে গেছে।