আজ ৮ তারিখ, রাত পোহালেই সেই অভিশপ্ত সকালের তিন মাস ছুঁয়ে ফেলব আমরা। এক যন্ত্রণা আর অপমান, আমার সহনাগরিক সহোদরার, আত্মজার ধর্ষণ আর খুন আমাদের নাগরিক জীবনে উথাল পাথাল আবেগ এনেছিল। মানুষের সেই আবেগ ছিল পবিত্র, সেই ক্রোধ ছিল যথার্থ, সেই পথে নামা ছিল প্রয়োজনীয়। কিন্তু চিতার আগুনে রুটি সেঁকে নেওয়ার লোকজনও তো কম নেই। এক পবিত্র আবেগকে সামনে রেখে নিজেদের নানান ইচ্ছেপূরণ তো আমরা একবার দেখিনি, বারবার দেখেছি। এবারেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। মিথ্যের পর মিথ্যে মিথ্যের পর মিথ্যে মিথ্যের পর মিথ্যে দিয়ে ক্রমশ বদলে যাওয়া ন্যারেটিভ উঠে আসছিল। দেড়শো গ্রাম বীর্য থেকে রক্তমাখা গ্লাভস, গণধর্ষণ থেকে পেলভিক আর কলার বোন টুকরো টুকরো হওয়ার কল্পকথারা দখল নিচ্ছিল মানুষের মস্তিষ্ক, বিবেচনা বোধের। ফলে যা ছিল এক ব্যথার বর্হিপ্রকাশ, ছিল সম্মিলিতভাবেই নারী সুরক্ষার দাবি বা লিঙ্গ সাম্যের অধিকারের কথা, তা এই ক্রমাগত মিথ্যে ন্যারেটিভকে সামনে রেখে হয়ে উঠল ক্ষমতা দখলের, সরকার বদলের আন্দোলন, দাবি এক দফা এক মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ। এই স্লোগান দিয়ে স্বপ্ন দেখলেন কেউ কেউ, নবান্নর উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে মমতা ব্যানার্জির হেলিকপ্টার, স্বপ্নের পোলাওতে তো ঘি কম দিতে নেই, শুভেন্দু নিজেকে দেখলেন মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে আর সেলিম অ্যান্ড কোম্পানি দেখলেন অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার। এমনকী তৃণমূল দলেরও কেউ কেউ সদ্য হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের পট পরিবর্তনকে মাথায় রেখেই আগেভাগে জাহাজ থেকে লাফ দিলেন, দেওয়ার চেষ্টা করলেন, দেবেন কি না ভাবতে শুরু করলেন। আর আমোদগেঁড়ে মিডিয়াতে তো নতুন মন্ত্রিসভার চেহারা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়ে গেল। নিজেই নারী নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত কালো চশমা রাজ্যপালও আসরে নেমে পড়লেন, বাংলাদেশের কাঠামো সামনে রেখে আমাদের কাঁথির খোকাবাবু ছাত্র সমাজ নামে এক বকচ্ছপকে সামনে রেখে ক্ষমতা দখলের কাজে হাত দিলেন আর সিপিএম, কমরেড সেলিম সুজন এবং আন্দোলনের দিন কেটে যায়, রাত ভেসে যায়, এমন কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন অতিবামেরা পিছন থেকে হাওয়া দিলেন জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনকে, তাদের পাশে সিভিল সোসাইটির কিছু লোকজনকে জড়ো করে আবার অষ্টম বামফ্রন্ট গড়ে তোলো, আদতে এটাই ছিল লক্ষ্য। কিন্তু আজ ৯০ দিন পরে সব ধোঁয়াশা কেটে গেছে, সাত দিনে বিচার আর অষ্টম দিনে ফাঁসির দাবি তোলার পরে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের চিফ জাস্টিস ৯০ দিনের মাথায় জানালেন, দাঁড়ান বিচার শুরু হোক, তার পরে অন্য কথা হবে। মানে এখনও বিচার প্রক্রিয়ার প্রাথমিক কাজ চলছে, বিচার শুরু হবে। ডাক্তারেরা আমরণ অনশন, যেখানে অসুস্থ হলেই হাসপাতালে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল, সেটাও শেষ করে কাজে ফিরেছেন। এই ধর্ষণ আর খুনের মামলায় সিবিআই তাদের প্রাথমিক চার্জশিটে এখনও ওই সঞ্জয় রায় ছাড়া আর কারও নামই আনেননি। দুর্গাপুজো, কালীপুজো আর ভাইফোঁটা শেষ করে কালীঘাটে এখন যুবরাজের জন্মদিন পালন করা হচ্ছে। কাজেই সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, তিন মাসের আন্দোলন ইত্যাদি সামলে মমতা অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
৯ তারিখের এই জঘন্য ঘটনা যখন সবাইকেই ভাবাচ্ছিল, সবাই যখন শোক সামলে এমন এক ঘটনায় তাদের ক্রোধ, তাঁদের আবেগকে ভাষা দেওয়ার চেষ্টা করছেন, সেই সময়েই কয়েকজন ডাক দিলেন রাত দখলের। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সেই ডাক পৌঁছে গেল বহু মানুষের কাছে। অন্তত শহর আর শহরতলির মানুষজন দলমত নির্বিশেষে বেরিয়ে এলেন রাস্তায়, হাতে মোমবাতি, গলায় নারী সুরক্ষার দাবি, লিঙ্গ সাম্যের অধিকারের কথাও বললেন অনেকেই। আর সেদিনেই কিছু মানুষের পরিকল্পনায় আরজি করের সামনে ঘটে গেল ভাঙচুর। হ্যাঁ সেটাই ছিল শুরুয়াত। এরপর থেকে গুজব আর মিথ্যের সুনামি আছড়ে পড়ল, যে সুনামিকে কাজে লাগিয়ে রাত দখল আর দিন বদলের নামে আসলে গদি দখলের স্বপ্নে মাতাল হলেন কিছু মানুষ।
আরও পড়ুন: Aajke | জাস্টিস ফর ধর্ষক খুনি সঞ্জয় রায়: সিপিএম
ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই যে অপরাধীকে প্রমাণ সমেত গ্রেফতার করা হল, তাকে আড়াল করে এক বৃহত্তর, আরও বিরাট ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব এসে হাজির হল, দলবদ্ধ ধর্ষণ, পেলভিক বোন ভাঙা, প্রমাণ লোপাটের জন্য বাথরুম ভাঙা, জোর করে মৃতদেহ পুড়িয়ে দেওয়ার মতো অভিযোগ তখন ছড়িয়ে পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। ঠিক সেই সময়েই জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠনকে সামনে রেখে সিপিএম আর দায়িত্বজ্ঞানহীন কিছু অতিবামেরা কর্মবিরতি আর অবস্থানে গেলেন, শুভেন্দু অধিকারী ছাত্র সমাজের নামে নবান্ন অভিযানের ডাক দিলেন। আর ঠিক এই সময়েই এক বিনোদন সংস্থার উসকানিতে মাঠে নেমে পড়লেন টলিপাড়ার অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে কিছু তথাকথিত সেলিব্রেটিরা, কারও কারও নিজেদের পুজোর ছবির প্রচারের তাগিদও ছিল। আর যথেষ্ট অর্থ পাওয়ার পরেও যে মিডিয়া হাউস ২১ বা ২৪ এর নির্বাচনেও তেমন কিছুই করে দেখাতে পারেনি সেই তেনারা ঝাঁপিয়ে পড়লেন, চলো কিছু করে দেখাই। নবান্ন থেকে সামান্য ‘ওকে’ মেসেজ আসলে, জমির চরিত্র বদলাতে পারলেই যে জমি হয়ে উঠবে ৫০০/৬০০ কোটির খাজানা, সেই জলা জমির আদত মালিকের নিরানন্দ মন আপাতত রেগে আগুন তেলে বেগুন, কাজেই তেনারা নামলেন এই সুযোগে সরকার ফেলে নিজেদের সরকার আনতে। টেক্কা দিয়ে মিথ্যে কথা বলা শুরু হল। তাঁদের কৃপাধন্য সেলিব্রিটি, নায়ক গায়ক থেকে কলমচিরা নামলেন পথে, শাসক দলেও তাঁদের এজেন্ট আছে বইকি। ধরুন জহর সরকার, যিনি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের দুর্নীতির দায়ে জেলে যাওয়ার পরেও দিব্য রাজ্যসভা আলো করেই বসে ছিলেন, তাঁর বিবেক জেগে উঠল, দল পাশে না থাকলে কাউন্সিলার নির্বাচনেও যিনি জামানত হারাবেন সেই সুখেন্দুশেখর রায়ও বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন। বচ্ছরকার উৎসবকে বাতিল করে দ্রোহকালের সূচনা হোক এমন আহাম্মক স্লোগানও উঠল। কিন্তু একটা সময়ের পর থেকে যাবতীয় আন্দোলনের বর্শামুখ হয়ে উঠল জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠন এবং এটাই ছিল এই আন্দোলনের সবথেকে দুর্বল ভুল সিদ্ধান্ত। এই আন্দোলন আরও ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ ছিল, যদি তা আদতে হয়ে উঠত নারী সুরক্ষার লড়াই, যদি তা হয়ে উঠত লিঙ্গ সাম্যের অধিকারের লড়াই, তাহলে সেই অধিকার নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে বসতেই পারতেন রিমিঝিম মহাশ্বেতা শতাব্দীরা, তা না হয়ে ডাক্তারদের সিসিটিভি, ডাক্তারদের রেস্ট রুম, ডাক্তারদের সুরক্ষার বিষয় নিয়ে আলোচনার মুখে রইলেন কিছু কর্পোরেট ডাক্তার মুখ আর কিঞ্জল, অনিকেত, দেবাশিসেরা। মমতা এটাই চাইছিলেন। নারায়ণ ব্যানার্জি বা কুণাল সরকারদের নিজেদের নানা এজেন্ডা আছে, নানান বাধ্যবাধকতা আছে, ওঁদের সামলানো যে কোনও প্রশাসনের বাঁয়ে হাত কা খেল, কাজেই ওঁদের গলায় অন্য সুর বের করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। ট্র্যাক টু-এর এই খেলায় সিদ্ধহস্ত মমতা সরকার, সেই একই খেলায় বালিগঞ্জ থানাতে শ্বশুর মশাইয়ের নারী নির্যাতনের মামলার নড়াচড়ার খবর কি পেয়েছিলেন কিঞ্জল নন্দ? হঠাৎ গলায় অমন চড়া অরাজনৈতিক সুর কি এমনিই বেরিয়েছিল? জানা নেই। কিন্তু এক বিরাট সিভিল সোসাইটির আন্দোলন, নারী নির্যাতন বিরোধী আন্দোলন, লিঙ্গ সাম্য অধিকারের আন্দোলন গণ স্বাস্থ্যের দাবি নিয়ে আন্দোলন হয়ে উঠল হাতে গোনা কিছু জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন, তাও আবার তাদের কর্মবিরতির ফলে বিরাট সংখ্যক প্রান্তিক মানুষদের বঞ্চনার বিনিময়ে। কাজেই সেদিনই ঘটে গিয়েছিল এই আন্দোলনের পরিসমাপ্তির সূচনা, যা শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হল মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায়, সেখানে বেড়াল যেমন ইঁদুর নিয়ে খেলা করে, কতকটা সেই মেজাজে মুখ্যমন্ত্রী এই অর্বাচীনদের মুখোমুখি হলেন, কাগজ দেখিয়ে জানিয়ে দিলেন অভয়ার বিচারের আড়ালে, কর্মবিরতির সুযোগ নিয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্য সাথীর টাকা পেয়েছে সিনিয়র রেসিডেন্ট ডাক্তারেরা। আর অন্যদিকে দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা, তাঁদের নিজেদের সতীর্থরা নাকি ১০ পাওয়ারও যোগ্য নন, তাঁরা নাকি টুকে পাশ করেছেন, এসব বলে জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যেই সমান্তরাল সংগঠন গড়ে তোলার বীজ পুঁতে দিলেন তাঁরা। যা আপাতত বীজ থেকে চারাগাছ, বলাই বাহুল্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলেই তা গাছ হয়ে উঠবে। এবং সব কাটিয়ে মমতা আপাতত আবার স্বমহিমায়, সামনে ৬টা আসনে উপনির্বাচন, ফলাফল আসার পরে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী মমতাকে দেখতে পাব। শান্তনু সেন কালীঘাটে গেছেন, সুখেন্দুশেখর রায়ও যাবেন। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই ৯০ দিন ধরে রাস্তা জোড়া আন্দোলন আর ডাক্তারদের কর্মবিরতি সামলে নিয়ে মমতার ভাবমূর্তি কি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল নাকি এই আন্দোলনে সরকার, তৃণমূল দল জনপ্রিয়তা হারিয়েছে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
এই ৯০ দিনের আন্দোলন ইতিহাসে থেকে যাবে, এ নিয়ে অনেক আলোচনা হবে, সমালোচনা হবে, নানান পণ্ডিত নানান মতামত দেবেন, কিন্তু যেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তা হল এই দীর্ঘ বিরাট আন্দোলন চলাকালীন সরকারের ধৈর্য ধরে রাখা। এর অর্ধেক তীব্রতার আন্দোলনে কংগ্রেস বিজেপি সরকারের কথা বাদই দিলাম, বাম সরকারও নির্বিচারে লাঠি গুলি চালিয়েছে। এই আন্দোলনের এক শরিক এসইউসিআই-এর নেতা নিজেই জানিয়েছেন জ্যোতি বসুর পুলিশ কীভাবে লাঠি চালিয়ে ছত্রভঙ্গ করেছিল জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থান আন্দোলনকে। অনেকবার নানান প্ররোচনা সত্ত্বেও মমতা সরকার লাঠি গুলি চালায়নি, এটা এক বড় প্রাপ্তি। প্রথম প্রাপ্তি যদি হয় শুরুয়াতি দিনগুলোতে মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদ, তাহলে দ্বিতীয় বড় প্রাপ্তি হল সরকারের দমন পীড়নের রাস্তায় না যাওয়া, আন্দোলনের পাশাপাশি এই কথাও লেখা থাকবে ইতিহাসে।