একজন বাচিক শিল্পীকে আমি চিনি, কবিতা আবৃত্তি করেন, বিভিন্ন ফাংশনে অ্যাঙ্কারিং করেন, এটাই ওনার পেশা। তিনি ক’দিন আগেই বাচিক শিল্পীদের বিচার চাই মিছিলে হেঁটেছেন, তিনিও বিচার চান। কিন্তু তাঁরই সমাজমাধ্যম পোস্টে দেখলাম, প্রতিবাদ চাই কিন্তু এ আবহে এবারে পুজোর কাজ হাতে আসছে না, তাঁর জায়েজ সংশয়, এবারেও কি সেই করোনাকালের মতো হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে? তাঁর আক্ষেপ বড়দের ঠিক কিছু জুটে যাবে কিন্তু আমাদের মতো ছোটদের কী হবে? তাঁর পোস্টে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন প্রতিবাদীরা, তোমার ঘরে কন্যে নেই? উনি শেষ লাইনে লিখেছেন, কী করব? খিদে পায় যে। আমার কিছু দায় আছে, পুজোর সময় তাদের সামান্য কিছু, মানে ওই একটা টি শার্ট, একটা বাজেট শাড়ি, একটা হাফহাতা জামা, এরকম খান পাঁচ ছয় দিতেই হয়। করোনার সময়েও দিয়েছি। তো গিয়েছিলাম কিনতে সেগুলোই। সন্ধে নামছে গড়িয়াহাটে। হাজার দেড়েক টাকা চোকানোর পরে সেই দোকানদার টাকাটা মাথায় ছোঁয়ালেন। কেন ভাই? এটাই বউনি। ওই আন্দোলন চলছে না। খদ্দের নেই বললেই চলে। এরপর তিনি ওই মেয়েটির ধর্ষণ যে ওই কলেজের প্রিন্সিপালই করেছেন, তাই আন্দোলন হচ্ছে, ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করলেন। বললেন এবারে শেষ হলে ভালো। রবিবারেও বাজার ফাঁকা। আর সাতদিন পরে বিশ্বকর্মা পুজো, রীতি ইত্যাদি বাদ দিন, বিহার, ঝাড়খণ্ডে মূর্তি চলে যেত এতদিনে, কুমোরটুলির শিল্পীরা আন্দোলনে, যাঁরা কাঠামো তৈরি করেন, তাঁরা টাকা পাননি। সনাতন দিন্দা ছেড়েছেন তাঁর পদ, তিনিও আন্দোলনে, শোলার মুকুট আর সাজ নিয়ে বসে আছেন হুগলির শোলা শিল্পীরা। তাঁদের কাছেও খবর লালবাজারের পুলিশ আর ডাক্তার মিলে ধর্ষণ আর খুন করে একটা বেচারা সিভিকের উপর সেই দায় চাপাতে চেয়েছিল বলে আন্দোলন চলছে। মাল আদৌ যাবে কি না, পয়সা পাব কি না? জানা নেই। তার মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের আজকের শুনানিতে বলা হল, ডাক্তারবাবুরা কাজে যোগ দিন, মুখ্যমন্ত্রী বললেন উৎসবে ফিরুন আর সেটাই বিষয় আজকে, উৎসবে ফিরুন বললেন মমতা।
চারিদিকে প্রতিবাদ আর বিচার চাই, আর সেই বিচার চাই আর প্রতিবাদকে ঘিরে ততোধিক গুজব, ফেক নিউজ আর হাস্যকর রটনা। এমনকী ছাড়া হল না আমাদের দেশের চিফ জাস্টিসকেও, তিনিও নাকি ম্যানেজ হয়ে গেছেন, কে করেছে ম্যানেজ? একটা ছবি প্রমাণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে, চিফ জাস্টিস চন্দ্রচূড় এক অনুষ্ঠানে কলকাতায় এসেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীও সেই অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন, সেটাই নাকি সেটিংয়ে প্রমাণ।
আরও পড়ুন: Aajke | লাশ চাই লাশ চাই? কাপালিক শুভেন্দুর?
খবরের কাগজে রোজ নতুন নতুন তত্ত্ব, নতুন নতুন প্রমাণ লোপাটের গল্প দিয়ে ধুনি জ্বালিয়ে রাখা হচ্ছে আর সেই উত্তাপে গা সেঁকে নিতে রোজ রাতদখল আর দিনদখল চলছে। হোক প্রতিবাদ, একজন ডাক্তার তার কর্মস্থলে ধর্ষিতা হয়েছেন, তাঁকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে, তার প্রতিবাদ হবে না? কিন্তু সেই প্রতিবাদ আরও লক্ষ মানুষের মুখের খাবার কেড়ে নেবে? সুপ্রিম কোর্টের দেখরেখে বিচার হচ্ছে, তদন্ত করছে সিবিআই আর সেই বিচার কবে শেষ হবে তার জন্য বাংলার মানুষ উৎসব ভুলে শোকপালন করবে? শোক কার নেই? যে কোনও সুস্থ মানুষ এই ঘটনায় স্তম্ভিত, শোকাহত, এমন একজনও নেই যিনি এই ঘটনার প্রতিবাদ করেননি। কিন্তু কতদিন? আজ পর্যন্ত সিবিআই এক কুঁচো কাগজও এনে হাজির করতে পারেনি যাতে বোঝা যায় যে রাজ্য সরকার বা পুলিশ প্রমাণ লোপাটের কাজ করেছে, কিন্তু সেই একই প্রচার চলছে। কিসের বিনিময়ে এই মিথ্যা প্রচার? ধারণাও আছে এই শারদোৎসবে কত মানুষের রোজগার জড়িয়ে, সেগুলো নিয়ে ছেলেখেলা করার অধিকার দিল কে? কলকাতা তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে দুটো ক্লাব বলেছে টাকা নেবে না, খুব ভালো কথা, তার মানে বাকিরা নেবে। যাঁদের মনে হবে তাঁরা উৎসবে মাতবেন, যাঁদের মনে হবে তাঁরা ঘরে বসে থাকবেন? ভণ্ডামি বন্ধ করুন। ১৩ দিন পরে শ্রাদ্ধে পারশে মাছের ঝাল আর খাসির মাংস খেয়ে ঢেকুর তোলা বাঙালিকে শোকের কথা বলবেন না। এরাই সেই বাঙালি যাঁরা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে টানা তিন দিন অরন্ধনের ডাক দিয়েছিলেন, এরাই সেই বাঙালি যারা গত ১৪ তারিখে দলমত নির্বিশেষে রাস্তায় নেমে ঘটনার প্রতিবাদ করেছিল। চলুক না সেই প্রতিবাদ, তা বলে বচ্ছরভরের উৎসব বাতিল করতে হবে কেন? আর সেটা মাথায় রেখেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, এবার উৎসবে ফিরুন। ভুলটা কোথায়? সেটাই আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তদন্ত চলছে, সুপ্রিম কোর্টের দেখরেখে, প্রতিবাদও চলুক, কিন্তু শারদীয়া উৎসব এত মানুষের পেটের ব্যাপার, বাংলার অর্থনীতির ব্যাপার, তা কি বন্ধ থাকবে? মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন উৎসবে ফিরুন, উনি কি ভুল বলেছেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
আবার বলছি, মৃত্যু শেষ কথা নয়, মৃত্যুকে আঁকড়ে ধরে জীবন চলে না। যে মৃত্যু হঠাৎই বজ্রপাতের মতো নেমে আসে, তা কিছুদিনের মধ্যেই স্মৃতি থেকেই উবে যায়। কত ভয়ঙ্কর মৃত্যু আর অন্যায় আমরা আমাদের এই ছোট্ট জীবনেই দেখেছি, কত অনায়াসে সে সব চলে গেছে। এই তো ক’দিন আগে করোনা, ভাই, বন্ধু, আত্মীয় স্বজন দমবন্ধ মনে হচ্ছিল, কিন্তু আজ সেই স্মৃতি ক’জন ধরে রেখেছেন। জীবন মৃত্যুর চেয়ে অনেক অনেক বড়, তাই জীবন জীবনকেই বেছে নেয়, মুখ্যমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন, উৎসবে ফিরুন।