মহিলাদের উপর অত্যাচার এবং তা নিয়ে আলোচনা খুব নতুন কিছু নয়। ২০১৪-তে যে নরেন্দ্র মোদির সরকার এসেছিল, তারও প্রেক্ষিতে মানুষের এক প্রবল বিক্ষোভ ছিল এক নির্ভয়াকে ঘিরে, তার ধর্ষণ আর মৃত্যু গোটা সমাজকে নাড়িয়ে ছেড়ে দিয়েছিল। এবং কেবল নির্ভয়াই নয়, সেই গোধরায় বিলকিস বানো, হাথরসে, উন্নাওতে, কাঠুয়াতে, কামদুনি বা পার্ক স্ট্রিটে, হায়দরাবাদে, নাগপুরে, মুম্বইতে সর্বত্র ধর্ষণ, নারীত্বের অবমাননার বিভিন্ন ঘটনা আমরা শুনেছি, জেনেছি। মণিপুরে তা এক চরম জায়গাতে গেছে, কেবল ধর্ষণ নয়, ধর্ষণ করে তাকে উলঙ্গ করে প্যারেড করানো হয়েছে। আর এই মুহূর্তের হিসেব বলছে, প্রতি ১৫ মিনিটে একজন ধর্ষিতা হচ্ছে আমাদের দেশে, মানে আপনারা বসে যতক্ষণে এই অনুষ্ঠান আমার কথা শুনবেন, ততক্ষণে একজন মহিলা ধর্ষিতা হচ্ছেন বা হয়েছেন। ধর্ষণের শ্রেণিবিন্যাস আছে, অনেকের মানতে অসুবিধে হলেও এটাই সত্যি যে এই ধর্ষণ ওই ডাক্তার মেয়েটির না হয়ে ক্যানিং গোসাবা বা মুর্শিদাবাদের গ্রাম থেকে আসা কোনও মেয়ের হলে এই বিরাট প্রতিবাদ হত না, এর আগে হয়নি। এই হত্যা আর ধর্ষণ যা আরজি করে হয়েছে তা জঘন্য, তারপরে যেভাবে অধ্যক্ষকে আড়াল করার চেষ্টা হয়েছে তা আরও খারাপ। কিন্তু এই ঘটনা এই প্রথম নয়, এ রাজ্যেই বানতলার ঘটনা আমরা দেখেছি, এ রাজ্যেই সিঙ্গুরে তাপসি মালিকের ঘটনা আমরা দেখেছি, তখনও দাবি উঠেছে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের। উঠুক কিন্তু যেটা আলোচনার সেটা হল আমাদের একটা হোলিস্টিক অ্যাপ্রোচ দরকার এই মহিলাদের উপর বাড়তে থাকা অত্যাচার, নিগ্রহ আর ধর্ষণকে নিয়ে। তার প্রথম কারণ হল আজও প্রতি ১৫ মিনিটে একজন মহিলা ধর্ষিতা হচ্ছে আমাদের এই দেশে, আর এই দেশের বিরাট সংখ্যক জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধেও এই নারী নিগ্রহ আর ধর্ষণের অভিযোগ আছে আর তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সংখ্যার জনপ্রতিনিধি বিজেপি দলের। কাজেই গোটা দেশ, প্রত্যেক রাজনৈতিক দল, প্রত্যেক সামাজিক সংগঠনের মানুষজন, প্রত্যেক নাগরিককেই ভাবতে হবে, হোয়াট ইজ টু বি ডান, কী করতে হবে। সেই প্রেক্ষিতেই বিভিন্ন স্তরে ভাবনা চিন্তা চলছে, সেটাই বিষয় আজকে, ধর্ষণ রুখতে আইন চান মমতা।
প্রত্যেকবার একজন ধর্ষিতা হবেন, খুন হবেন, মানুষ পথে নামবেন, স্তব্ধ হবে জীবনযাত্রা, হাসপাতালে হলে বন্ধ হবে রোগীদের পরিষেবা, এ কি চলতে পারে নাকি? তাই মুখ্যমন্ত্রী যে চিঠি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে তা এক জরুরি জাতীয় আলোচনার বিষয়। বেশ কিছু জিনিস সেখানে ঠিক করতেই হবে, আর এটাই তো সেই সময় যেখানে এক অত্যন্ত খারাপ সময়কে কাজে লাগিয়ে আগামিদিনের জন্য এক সুন্দর রূপরেখা তৈরি করার শুরুয়াত হতেই পারে।
আরও পড়ুন: Aajke | কাজ বন্ধ করে ডাক্তারবাবুরা আন্দোলন করতে পারেন?
ধর্ষণের হিসেব সবার জানা আছে, কিন্তু ধর্ষণের তিনটে দিক আছে, প্রথম হল ধর্ষণের সামাজিক প্রেক্ষিত। যে ছেলেটি তার বোনকে বাঁচাতে মরে যেতেও রাজি আছে তাকে দেখেছি অনায়াসে অন্য একটি মেয়েকে অশ্লীল কথা বলতে, প্রস্তাব দিতে, তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গায়ে হাত দিতে। তারমানে এই যে ফ্র্যাকচার্ড মরালিটি, ভাঙাচোরা নীতিবোধ, সেই জায়গার সমস্যাকে আগে দূর করতে হবে। মা নয়, বোন নয়, স্ত্রী নয়, একজন মহিলার সম্ভ্রম, একজন মহিলার ইচ্ছে, তার সম্মতি সবটার কথা তাকে জানতে হবে, তাকে সম্মান করতে হবে প্রত্যেক মহিলাকে। তার বাবাকে বুঝতে হবে ছেলের সামনে বা পেছনেও মাকে মারলে ছেলের মধ্যে সেই অত্যাচারের বীজ রোপণ হয়, তারপর সে-ই হয়ে ওঠে এক ধর্ষক, তখন মাথায় হাত দিয়ে সেই বাবা-মা ভাবতে বসে কোন শিক্ষার অভাবে ছেলেটা ধর্ষক হয়ে গেল? এরপরেই আছে ধর্ষণের মতো জায়গাই না থাকা, যদি এক সামাজিক প্রশাসনিক পাহারাদারি থাকে তাহলে ধর্ষণ কমে যাবে বইকী। ধরুন এই আরজি করেই মহিলা ডাক্তারদের জন্য আলাদা রেস্টরুম যদি থাকত, এই ঘটনা সম্ভবত হতই না। আর ঘটনা ঘটলে সেই প্রতিষ্ঠান সেই থানা, সেই জায়গার দায়িত্বে থাকা লোকজনকে সরিয়ে দেওয়ার, সাসপেনশনে রাখার একটা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর যদি থাকে তাহলেও অনেক সমস্যা দূর হবে। এক্ষেত্রে ঘটনা হওয়ার পরেই অধ্যক্ষ, সুপার, ডিপার্টমেন্টাল হেডকে সরে যেতে হত, মাসখানেকের মধ্যে দোষী ধরা পড়ে গেলে, চার্জশিট এলে তাঁদের আবার ফিরিয়ে আনা হত, এরকম হলে এত কনফিউশন তৈরি হত না। আর শেষ ব্যাপারটা হল বিচার এবং শাস্তি, বিচার যদি চলতেই থাকে, চলতেই থাকে তাহলে মানুষের মনে হবেই যে অপরাধীকে এই ব্যবস্থায় শাস্তি দেওয়াই যায় না, কাজেই বিচার। এই মহিলা নিপীড়নের ধর্ষণের বিচারের একটা নির্দিষ্ট সময় থাকা উচিত, তাহলে সেটা মানুষের কাছে একটা ডেটারেন্স হয়ে দাঁড়ায়, অপরাধী একবার অন্তত ভাবে। সেগুলোই বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী, আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন ধর্ষণের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধীকে ১৫ দিনের মধ্যে বিচার করে শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা করা হোক, আপনাদের মত কী?
শাস্তি দিয়ে ধর্ষণের সংখ্যা কমানো যায়, খানিকটা কন্ট্রোল করার মতো আর কী, কিন্তু আসল সমস্যা আরও গভীরে, পিতৃতান্ত্রিক এই ব্যবস্থার পরতে পরতে রয়েছে এই নারী আর পুরুষ সম্পর্কে দুটো আলাদা মাপকাঠি। সেই মাপকাঠিতেই এক পুরুষের হাত-পা কেটে খসে গেলেও সে বীর, সে যোদ্ধা, সে বিছানাতে শুয়েও সম্ভ্রম জাগায়। আর একজন ধর্ষিতা মহিলা মনে করে তার সর্বস্ব গেছে, সমাজ তাকে মনে করায় তার বেঁচে থাকার আর কোনও কারণই নেই, আসলে এই সতীত্ব, এই শুচিবোধ এক চাপিয়ে দেওয়া জিনিস, যা সীতাকে বাধ্য করেছিল অগ্নিপরীক্ষা দিতে। আমি সীতাকেও পুজো করব, আমি সতীত্বের জয়গান গাইব, আমি রাজপুত রমণীদের জহরব্রতকে অগ্নিস্নান পুণ্য বলে মানব আর ধর্ষণের বিরুদ্ধে রিক্লেইম দ্য নাইটে নামব, একসঙ্গে হয় না। সেটাই বুঝতে হবে আমাদের প্রত্যেককে। কেবলমাত্র জনমানসে নিজের মহিমা বজায় রাখতে মর্যাদাপুরুষোত্তম রাম নিজের বিবাহীত স্ত্রীকে ত্যাগ করতে পারেন, সেটাই ধর্ম, দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজের বিবাহিত স্ত্রীকে অস্বীকার করতে পারেন আর দেশে মহিলাদের উপর অত্যাচার বন্ধ করার কথা বলেন, তা হবে না। সমস্যা অনেক গভীরে, বুঝতে হবে।