চার্লি চ্যাপলিনের মসিয়েঁ ভর্দুঁর সেই কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছে, “One murder makes a villain… millions a hero. Numbers sanctify my good friend.” একটা হত্যা তোমাকে অপরাধী করে তুলবে, লক্ষ হত্যা তোমাকে জাতীয় নায়কের আখ্যা দেবে, বন্ধু আমার, সংখ্যা সবকিছুকে পবিত্র করে তোলে। কেন মনে পড়ছে? সেই ২০১১-র নির্ভয়া কাণ্ডের বিরুদ্ধে বিরাট জনমতের কাঁধে ভর দিয়ে যে সরকার এল। সেই সরকার আসার পর থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জঘন্য ধর্ষণ আর হত্যাকাণ্ডের বহু ঘটনা ঘটেছে। কেবল ঘটেছে নয়, সেগুলোর জন্য বেশ কিছু জায়গায় দায়ী শাসকদল বিজেপি। হাথরস থেকে উন্নাও থেকে কাঠুয়া থেকে বিভিন্ন জায়গার ঘটনা আমাদের চোখের সামনে আছে, আছে আশারাম বাপু বা বাবা রাম রহিমের ঘটনা, যারা ধর্ষণ খুনের দায়ে জেলে কিন্তু অনায়াসে প্যারোল পায়, জেল থেকে ছাড়া পেলে গলায় মালা পরানো হয়, মিষ্টি খাওয়ানো হয়। মণিপুরে বিজেপি শাসিত রাজ্যে কেবল ধর্ষণ নয়, ধর্ষণের পরে নগ্ন করে প্যারেড করানো হয়। কোন রাজ্যে হয়নি এই ধরনের ধর্ষণ বা হত্যা? আর সেগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিল না তাদের প্রশ্রয়দাতারা, যারা আকণ্ঠ দুর্নীতিতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকে? কোথাও দেখেছেন এই আন্দোলন? কোথাও আছে রাত দখল। বলতেই পারেন বাংলার শিল্পী কবি বুদ্ধিজীবীরা বেশি সচেতন, তো সেই তাঁরা নিজের রাজ্যের বাইরে কোনও খবর রাখেন না। যে বাঙালি কবি বুদ্ধিজীবী শিল্পী তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম বলে পথে নেমেছে, তারা মণিপুরের ব্যাপারে চুপ আর আরজি করের ব্যাপারে শেষ দেখে ছাড়ব। তাঁদের কেউ মোদি-শাহের পদত্যাগ চাননি কিন্তু মমতা ব্যানার্জির পদত্যাগ চাইছেন, এটা কোন ধরনের দ্বিচারিতা? সেই আবহেই অন্য সুর বাঁধলেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই, যা বললেন সেটাই বিষয় আজকে, মোদি-শাহের পদত্যাগ চাই: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
দেশে প্রতিদিন গড়ে ৯০টা ধর্ষণ হয়, হ্যাঁ এটাই মোদি-শাহ সরকারের দেওয়া তথ্য। কিন্তু ওই গান আছে না, সব মরণ নয় সমান। না, মরণ যেমন সমান নয় ঠিক সেইরকমই সব ধর্ষণও বোধহয় সমান নয়। প্রত্যন্ত গ্রামের একটা মেয়েকে গণধর্ষণ করে পুলিশকে দিয়ে দেহ পুড়িয়ে দেওয়া আর এক ডাক্তারকে ধর্ষণ আর হত্যা করার মধ্যে যে বিশাল ফারাক তা আমাদের সচেতন সমাজ চোখে আঙুল দিয়েই দেখিয়ে দিচ্ছে। সেদিন হাথরস বা মণিপুরের গণধর্ষণের বিরুদ্ধে কেউ তাঁদের অমন শখের সাধের জাতীয় পুরস্কার ফেরত দেননি, কিন্তু সেই তাঁরাই এখন এই বাংলার আরজি করের ঘটনার পরে ফেরত দিচ্ছেন তাঁদের পুরস্কার।
আরও পড়ুন: Aajke | মুখ সামলে: অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
যাঁরা হাথরস থেকে উন্নাও হয়ে মণিপুর নিয়ে একটা কথাও বলেননি তাঁরা আজ প্রতিবাদে ফেটে পড়ছেন, দেখে মনে হচ্ছে আরব বসন্তের কথা। অনেকেই বলছেন এই প্রতিবাদ, রাতদখল, মিছিল, অবস্থান সবটাই এক স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার, কিন্তু খেয়াল করে দেখুন এর পিছনে একটা পরিচিত ছক আছে, এক জ্যামিতির মতো নির্দিষ্ট ছক ধরেই আন্দোলন এগোচ্ছে। ধাপে ধাপে আন্দোলনকে উচ্চগ্রামে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, মুড়ি মিছরির মতো ফেক নিউজ জুড়ে দেওয়া হচ্ছে, একে একে মুখ বেরিয়ে আসছে সামনে। স্লোগান কারেকশন হচ্ছে, কোর্স কারেকশন হচ্ছে, সবটা যেন এক ওয়ার রুম খুলে, একটাই ঘর থেকে যেভাবে একজন জেনারেল তার সৈন্যবাহিনীকে চালায় সেরকম ভাবে বহু দূরে কোনও নিশ্চিন্ত ডেরা থেকে এই আন্দোলনকে চালানো হচ্ছে। সুদূর গ্রাম থেকে আসা রোগীরা ফিরে যাচ্ছেন, বেসরকারি হাসপাতালে ৪০ শতাংশ ব্যবসা বেড়েছে, ডাক্তারবাবুরা শিরদাঁড়া হাতে করে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পুজোর পশরা নিয়ে হাপিত্যেশ করছেন গড়িয়াহাট, হাতিবাগানের হকারেরা, এদিকে প্রতিবাদীদের হাতে প্ল্যাকার্ড এবার পুজোয় জামা নয় বিচার চাই। গত ১০ বছরে সিবিআই তদন্তের সাকসেস রেট ২২ শতাংশের কম, মানে ১০০টা মামলাতে ২২টায় কিনারা করতে পেরেছেন, কিন্তু আন্দোলনকারীদের কী ভরসা এই সিবিআই-এর উপর। কারা নবান্ন অভিযান করছেন? বাংলা বনধ ডাকছেন? যাদের রাজ্যে ক’দিন আগেই কেবল গরুর মাংস আছে বলে এক বাঙালি ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হল, কেউ একটা কথাও বলেছেন? কোনও প্রতিবাদ? পুরস্কার ফেরত? না, ন-এ আ-কার না। ঠিক সেই সময়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দাবি তুললেন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহের পদত্যাগ চাই। হ্যাঁ, গড়ে ৯০টা ধর্ষণ যে দেশে হয়, সে দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গদিতে বসে থাকার দরকারটা কোথায়? আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, যদি একটা ধর্ষণ খুনের অভিযোগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাওয়া হয়, তাহলে প্রতিদিন গড়ে ৯০টা ধর্ষণের জন্য প্রধানমন্ত্রী আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেন পদত্যাগ করবেন না? শুনুন মানুষজন কী জবাব দিয়েছেন।
৯ তারিখে ধর্ষণ আর খুন হয়েছে, ১০ তারিখে মূল অভিযুক্ত গ্রেফতার, যার পরে সিবিআই-এর তদন্তের ২৬ দিন চলে যাওয়ার পরেও আর অন্য কোনও তথ্য আমাদের সামনে আসেনি। দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে আরজি করের অধ্যক্ষকে কিন্তু তার সঙ্গে রাজ্য সরকারের, বা মুখ্যমন্ত্রীর জড়িত থাকার কোনও তথ্য এখনও পর্যন্ত নেই। এদিকে জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা তাঁদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, এফআইআর তো দূরের কথা, মুখ্যমন্ত্রী নিজেই তাদের আন্দোলনকে সমর্থন করছেন, রাজ্য বিধানসভায় ধর্ষণ সংক্রান্ত বিল আনা হয়েছে, তদন্তের ভার সিবিআই-এর উপর এবং সেটাও সুপ্রিম কোর্টের অধীনে। এরপরেও যদি মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি উঠতেই থাকে তাহলে বুঝতে হবে ডাল মে কুছ নহি, বহত কুছ কালা হ্যায়।