গণতন্ত্রের চারটে স্তম্ভ, চারটে পিলার। আইনসভা, মানুষের রায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আইন তৈরি করবেন, দেশের বাজেট তৈরি করবেন, দেশের অর্থনীতির দিশা দেখাবেন। প্রশাসন দ্বিতীয় স্তম্ভ, যাঁরা সেই আইনকে প্রয়োগ করবেন, যাঁরা আইন ভাঙবেন তাঁদের জেলে পুরবেন, তদন্ত করে বিচারের সময় সেই তথ্য হাজির করবেন। বিচার ব্যবস্থা, আইন এবং সংবিধান যাতে লঙ্ঘিত না হয়, তা দেখবেন, প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করবেন আর চতুর্থ স্তম্ভ হল সংবাদমাধ্যম যা মানুষের কথা তুলে ধরবে, সরকারের কথা, প্রশাসনের কথা, তাদের গাফিলতি বা দুর্নীতির কথা, তাদের ভালো কাজের কথা তুলে ধরবে। আইনসভা কী করছে আপনারা জানেন, জানেন প্রশাসন বা বিচার ব্যবস্থার কথা। আজ আলোচনা গণতন্ত্রের এই চতুর্থ স্তম্ভটিকে নিয়ে, আলোচনার প্রেক্ষিত এই আরজি কর ধর্ষণ আর হত্যার ঘটনা, তাকে ঘিরে মানুষের আবেগ, প্রতিবাদ, আন্দোলন। সংবাদমাধ্যমের এক বড় অংশ আজ ব্যোমকেশ, কিরীটী, ফেলুদা, নিদেনপক্ষে মিতিন মাসী। তা সাংবাদিকদের নিয়ে তেমন এক পপুলার পার্সেপশন আছে বইকী, বহু ফিল্ম রহস্য গল্পে সাংবাদিককে ভিলেনের সঙ্গে লড়তেও দেখা গেছে। আসলে সাংবাদিক তথ্য এনে হাজির করবে, তথ্যের বিশ্লেষণ করবে, সেটাই সাংবাদিকের কাজ, সে গোয়েন্দা নয়, সে অ্যাকটিভিস্ট নয়, সে সাংবাদিক, কিন্তু এই আরজি কর ঘটনায় সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা প্রায় ফাঁসুড়ের। সংবাদপত্র, সংবাদমাধ্যম নিজেরাই তদন্তকারী আর বিচারকের ভূমিকাতে নেমে পড়েছেন। সেটাই বিষয় আজকে, সংবাদমাধ্যম নিজেরাই তদন্ত করছে, বিচারও করছে, শাস্তির নিদানও দিচ্ছে।
সেই ৯ তারিখে একটা ঘটনা ঘটেছে, আমরা আমাদের চ্যানেলে, আমাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একটানা দেখিয়ে যাচ্ছি, আমাদের সাংবাদিকরা তথ্য এনে হাজির করছেন, বহু ক্ষেত্রে তা অনেকের আগেই এনে হাজির করছেন। সেগুলো কী? ১) কলকাতা পুলিশ একটা ইয়ারফোন আর সিসিটিভির সূত্র ধরে মূল অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়কে গ্রেফতার করেছে। ২) সুরতহাল বা ইনকোয়েস্ট রিপোর্ট অনুযায়ী মৃতার পেলভিক বোন বা কলার বোন ভাঙা ছিল না। ৩) পোস্টমর্টেম রিপোর্টে যা বলা হয়েছে তাতে করে ওই অপরাধের সময়ে একের বেশি মানুষ থাকার সম্ভাবনা নাকচ করেছে এমনকী সিবিআইও। ৪) মেয়েটির নখ থেকে, মুখের লালা থেকে, ছেলেটির গায়ের রেজিস্ট্যান্ট মার্ক থেকে সবকিছু এবং তার ডিএনএ টেস্ট সাফ বলে দিচ্ছে সেদিনে ধর্ষণ করেছিল এই সঞ্জয় রায়, খুন করেছিল এই সঞ্জয় রায়। অথচ আপনি সংবাদমাধ্যম দেখুন, মাথা গুলিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: Aajke | সিবিআইকে চেপে ধর, জাস্টিস ফর আরজি কর
প্রত্যেকটা খবরের আগে লাগানো হচ্ছে বিস্ফোরক, প্রতিটা শব্দের আগে। সংবাদপত্রের পোকা, রোজ ৩-৪ ঘণ্টা টিভিতে বাংলা চ্যানেল দেখেন এক ভদ্রলোক, বাজারে গিয়ে বলে ফেলেছেন এক কেজি বিস্ফোরক ঢ্যাঁড়শ দিন তো। হ্যাঁ ব্যাপারটা এতটাই হাস্যকর। তদন্তমূলক সাংবাদিকতা যে হয় না তা তো নয়, কিন্তু সে তদন্তের তো মাথামুন্ডু থাকবে, প্রতিটা ভিডিওর পরে বলা হচ্ছে আমরা কিন্তু এই ভিডিওর সত্যাসত্যের দায় নিচ্ছি না, বলে সেই ভাইরাল ভিডিও চালিয়ে টিআরপি তুলে বিজ্ঞাপন তুলে সেই টাকা ঘরে তুলছে। মানে ভিডিওর দায় নিচ্ছে না কিন্তু তার থেকে আয়ে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স বাড়ছে তাতে আপত্তি নেই। কোথাকার কে কাকে ফোন করছে, সে অডিও কার, কে তার দায় নিচ্ছে জানা নেই। তা এনে হাজির করানো হল এবং তারপরে হনুমানের ল্যাজে আগুন লাগানোর পরে সেই ছটফটে হনুমানের মতোই অ্যাঙ্কর লাফাচ্ছেন, চিৎকার করছেন, লক্ষ্য কিন্তু একটাই মমতার পদত্যাগ চাই। লাল জামা পরা কে? কে ? কে? প্রতিবার ঝনাৎ করে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। বল না ভাই কে? ছবি বার কর, বাকি অন্য কিছুর প্রমাণ? কিচ্ছু নেই, গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করতে করতে আরেক সরকার বিরোধী সংগঠনের দাবি লেখা একটা কাগজ তুলে ধরছে, এই দেখুন এখানে বলা হচ্ছে ওই লাল জামাপরা মানুষটা হল অভীক দে। ওদিকে সিবিআই আজ ২০ দিন পরেও কি সেই অভীক দে-কে ডেকেছে? জিজ্ঞাসাবাদটুকুও করেছে? করেনি। এই সংবাদমাধ্যম বলেছে চাদরের কথা, চাদরের রংয়ের কথা, এরাই শোনাচ্ছে আরজি করের স্বাস্থ্যকর্মী আর মৃতার বাবা মায়ের ফোন কল, যা ছাপার আগে, টেলিকাস্ট করার আগে জানিয়েই দিচ্ছে এটা যে তাদেরই তা কিন্তু তারা জানে না, তার দায় ওনাদের নয়, কিন্তু বিজ্ঞাপন বাবদ আয়ের সবটাই ওনাদের। এবং ক্রমাগত সেই একই প্রচার চলছে, কলকাতা পুলিশ কিছু প্রচারের বিরুদ্ধে যেই জবাব দিতে শুরু করল, ব্যস, আইনের বই নিয়ে খাড়া করিয়ে দেওয়া হল একদল আইনজীবীদের। তাঁরা ঘাড় বেঁকিয়ে বললেন, না, পুলিশ তো এই কাজ করতে পারে না। মানে হল সংবাদমাধ্যম উদোম মিথ্যে বলে যাবে, কিন্তু পুলিশ ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকবে, এটাই নাকি আইন, এটাই নাকি দস্তুর। আসলে এক মিডিয়া ট্রায়াল চলছে, মিডিয়া নিজেই তথ্য আনছে, নিজেরাই বিচার করছে, নিজেরাই শাস্তির নিদান দিচ্ছে। এ বড় ভয়ঙ্কর। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, যে ভিডিও বা অডিও ফুটেজের দায় সংবাদমাধ্যম নিচ্ছে না, উল্টে সাফ জানিয়েই দিচ্ছে যে এই ভিডিও বা অডিও টেপ সত্যি না মিথ্যে আমরা জানিই না, সেটা চালিয়েই তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মিডিয়া ট্রায়াল চালাচ্ছে, সেটাকে আপনারা কোন চোখে দেখছেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
গণতন্ত্রের সবকটা স্তম্ভ যে খুব ঠিকঠাক দাঁড়িয়ে আছে তা নয়, গলদ তো আইনসভাতে আছে, আছে প্রশাসনে, আছে বিচার ব্যবস্থাতেও। কিন্তু মানুষের এক সরাসরি নজরদারি ব্যবস্থা হল এই চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যম, যার কাঁধে আছে বাকি তিন স্তম্ভের পবিত্রতাকে রক্ষার দায়িত্ব। সে যদি আজ চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেয়, তাহলে সে দেশের, সে রাষ্ট্রের মানুষের কপালে অনেক দুর্ভোগ আছে, তা বলাই বাহুল্য।